ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এক অকাল প্রয়াত লেখক-নির্মাতা

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ১০ আগস্ট ২০১৮

এক অকাল প্রয়াত লেখক-নির্মাতা

তারেক শাহরিয়ার (১৯৬১-আগস্ট ১৯৯৮) সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু বলা আমার পক্ষে সহজ নয়। তাকে চিনতাম দীর্ঘদিন; তিনিও আমাকে চিনতেন। কিন্তু তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ হয়নি কখনও। কোনদিন তার বাসায় যাইনি। ঢাকা শহরের কোথায় কোথায় থাকতেন তাও ঠিকমতো জানতাম না। সাহিত্য আসর, পিকনিক অথবা অন্য কোন উপলক্ষে তার সঙ্গে দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়াÑ না, তাও হয়নি। তারেকের সঙ্গে দেখা হতো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, কখনওবা বাংলামোটরের জহুরা মার্কেটের সান্ধ্যকালীন আড্ডায়। শেষদিকে আসতেন শাহবাগের আজিজ মার্কেটে। আমরা কুশল বিনিময় করতাম। আমাকে দেখলেই তিনি স্মিত হাসতেন। অনেক অর্থবোধক ছিল সেই হাসি। মাঝে মাঝে কথা হতো। সেটা ১৯৮৭/৮৮/৮৯ সালের কথা। তারেক তখন গল্প লিখতেন। রীতিমতো নিমজ্জিত ছিলেন গল্পে। আর আমার মাথা তখন ছিল কবিতার স্বপ্নে ঠাসা। তখন পর্যন্ত আমি বাংলা গদ্য খুব একটা পড়িনি। অল্প কয়েকটা নামী বাংলা উপন্যাস এবং শ’খানেক ছোটগল্প পড়েছি। প্রধানত কবিতাই ছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান। পরিচয়ের আগে, মনে আছে, তারেকের একটি মাত্র গল্প আমার, পড়া হয়েছিল। লেখাটির নাম ছিল ‘আকলিমা চরিত মানস’। ১৯৮৭’র ফেব্রুয়ারি মাসে বেরোয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আবহমান উলুধ্বনি’। বইটির একটি কপি আমি তারেককে দিয়েছিলাম। তারপর বহুদিন আমাদের দেখা হয়নি। অনেক পরে শাহবাগে এক সন্ধ্যায় ‘থ্যাঙ্কস’সহ হ্যান্ডশেক করেছিলেন আমার সঙ্গে। শুধু বলেছিলেন, ‘আপনার কবিতা পড়তেছি; ভাল্লাগতেছে।’ তারপর আবার সেই ব্যাখ্যাতীত হাসি। ১৯৮৬/৮৭’র দিকে শাহবাগে লেখক-শিল্পীদের আড্ডা হতো পিজি হাসপাতালের রাস্তাসংলগ্ন মূল ভবনের নিচতলার হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে। ‘রেখায়ন’ নামের এক সুপরিচিত দোকানের পাশেই ছিল ‘পাপ্পু রেস্টুরেন্ট’। আমরা কবি যশপ্রার্থীর দল বসতাম ওখানেই। আসতেন মোহাম্মদ সামাদ, তুষার দাশ, ফরিদ কবির, মোহাম্মদ সাদিক এবং অনেকেই। তারেক শাহরিয়ারের আড্ডার সার্কেল ছিল আলাদা। তিনি বসতেন সেলিম মোরশেদ, হাবিব ওয়াহিদ, পারভেজ হোসেন প্রমুখের সঙ্গে। হঠাৎ হঠাৎ আসতেন পিজি হাসপাতালের দিকে। সঙ্গে থাকতেন গল্পকার সেলিম মোরশেদ কিংবা তপনজ্যোতি বড়ুয়া। সে সময় আমিও ওদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। ততদিনে তারেকের সঙ্গে আমার এক ধরনের সখ্য গড়ে উঠেছে। বুঝতে পারি, সেটার সূত্রপাত হয় তাকে আমার স্বরচিত বই দেয়া এবং সাহিত্য, বিশেষত গল্প নিয়ে আমাদের অনিয়মিত কথাবার্তাকে কেন্দ্র করে। তারেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কটা মধুর হয়ে ওঠার আগেই আমি ঢাকা শহর ছেড়ে যাই ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। তারপর জীবিকা সূত্রে আমি মুন্সীগঞ্জ, ঘোড়াশাল, শ্রীমঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি স্থানে থাকি। ঢাকার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ অনিয়মিত হয়ে আসে। অনেকদিন পর পর তারেকের সঙ্গে দেখা হতো। তবে বেইলি রোডের নাটকপাড়ায় বা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণের চলচ্চিত্র উৎসবে তার দেখা মিলতই। মাঝখানে অনেক বছর তারেক গল্প লেখেনি কিংবা লিখলেও হয়ত ছাপতে দেয়নি। কেননা, দীর্ঘদিন তার নতুন গল্প কোথাও প্রকাশিত হতে দেখিনি। আসলে ভেতরে ভেতরে তিনি বিবর্তিত হচ্ছিলেন চলচ্চিত্রকার হিসেবে। তার সৃজনশীলতা ছোটগল্প থেকে চমৎকারভাবে বাঁক নিয়েছে সিনেমার দিকে। আমি ভাবতাম, হয়ত এটাই তার নিয়তি ছিল। হতে পারে গল্পকারের চেয়েও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন এই অস্থির, প্রাণবন্ত, আত্মপ্রত্যয়ী, বিবেকী মানুষটি। মৃত্যুর মাসখানেক আগে তারেকের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল আজিজ মার্কেটের নিচ তলায়। ব্যস্তভাবে কোথাও যাচ্ছিলেন। তারপরও কিছুক্ষণ কথা হয়। অল্প কিছুদিন আগেই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তার নির্মিত ছবি ‘কালিঘর’ দেখেছি। যথেষ্ট মুনশিয়ানার স্বাক্ষর ছিল ওই ডকুমেন্টারিতে। সে কথা বলায় তারেক মাথা দুলিয়ে বিনীত হেসেছিলেন। ছোটগল্পের প্রসঙ্গ তোলায় বলেছিলেন, আÑর গল্প! সব প্রতিভাবান লেখকের চাপে...। বাক্য শেষ হয়নি। দ্রুত অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। না, তাকে মোটেই অসুস্থ মনে হয়নি আমার। ও রকম সুন্দর স্বাস্থ্যসম্পন্ন মানুষটির ভেতরে গোপনে গোপনে অসুখ নামের দানবটি বেড়ে উঠেছিল ভয়ঙ্কররূপে, ভাবতে কেমন লাগে আজও! আমাদের সমসাময়িক লেখক বন্ধুদের মধ্যে তারেকই সম্ভবত প্রথম যিনি বিনা নোটিসে পৃথিবীর সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছেন। তারেক শাহরিয়ারের ৪-৫টি গল্প আমি পড়েছিলাম। এর মধ্যে তিনটি প্রকাশিত হয়েছে কবি-গল্পকার আনওয়ার আহমেদ সম্পাদিত ‘রূপম’ পত্রিকায়। গল্প তিনটির প্রকাশকাল ১৯৮৬। তরুণ কথাসাহিত্যিক হিসেবে তখনই মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন তারেক। প্রাথমিক সাফল্য বলতে যা বোঝায় তা তিনি পেয়েছিলেন। ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের এক যুবক লেখায় যে পরিমিতি, সংবেদ ও স্টাইল প্রদর্শন করতে পেরেছিলেন তা এদেশে ওই বয়সী ছেলেমেয়ের মধ্যে দুর্লভ। জীবনকে তাকের খুব কাছ থেকে দেখায় বিশ্বাসী ছিলেন। তার গল্পের জগত তারই অভিজ্ঞতার উচ্চাকাক্সক্ষী উদ্ভাস। প্রতিদিনের জীবনযন্ত্রণা যেমন নগরের রাস্তা, যানবাহন ও যাত্রীদের মানসভূমির বিশ্বস্ত চিত্রনের ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে ‘কুত্তাপচা গন্ধের পিছে তিনটি মাছি ধায়’ গল্পে, তেমনি নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ দুটি মানসবিভ্রান্ত, বেকার, বিপর্যস্ত যুবকের জীবন চেতনার তীক্ষè প্রতিফলন ঘটেছে ‘হেঁটে যায় দুজন মানুষ’ গল্পে। এখানে তার গদ্যের নমুনা হিসেবে কয়েকটি পঙক্তি তুলে দিলামÑ ক. ‘বক্ররেখার উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে সময়’ (হেঁটে যায় দুজন মানুষ) খ. ‘জেদী কিশোরের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে বৃষ্টি ছুটে আসছে’। (ওই) গ. ‘মেঘ চিরে নতুন আধুলির মতো রোদ নেমেছে মাঠে, আমাদের পৃথিবীতে এখন বিকেল’। (ওই) ঘ. ‘ওর হাসির শব্দ ব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে আমার কানের পাশ দিয়ে চলে যায়।’ (ওই) ঙ. ‘দুর্গন্ধটা সহস্র সহস্র আলপিন হয়ে, পাঁচজন যাত্রীর মগজ থেকে উদ্দাম নৃত্য করতে করতে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে যায়। পাকস্থলী, নাড়িভুঁড়ি সবকিছু খোঁচাতে থাকে জোরেÑ ভীষণ জোরে’ (কুত্তাপচা গন্ধের পিছে তিনটি মাছি ধায়)। ‘বৃত্ত’ এবং ‘আকলিমা চরিত মানস’-এ তারেক শাহরিয়ার পরিণততর জীবনদৃষ্টি উপহার দিতে পেরেছেন। এসব গল্প কেবল ক্ষুব্ধ-বিপন্ন জীবনের প্রতিবিম্ব নয়, তা নদী তীরবর্তী শ্রমজীবী মানুষের নিরন্তর, অস্থিসংগ্রামের দলিলও বটে। নদীর দ্বারা সর্বস্বান্ত হওয়ার টেনশন কিংবা সব হারানোর পরের মনোকষ্ট এখানে অন্তরঙ্গ ভাষ্যে পরিস্ফুট। আকলিমার স্বামী পঙ্গু। সেই স্বামীর দ্বারা সে নির্যাতিত। বিরূপ আবহাওয়া, পিঠের ব্যথা এবং অসহযোগী পারিপাশ্বিক অবস্থা আকলিমার মর্মযাতনার কারণ; যা ভাত-কাপড়ের কষ্টের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এসব বিষয় গল্পে চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। পাশাপাশি জনৈক ফকির বুড়ির রূপকথাসুলভ আবির্ভাব ও তিরোধান বিষয়ক জনশ্রুতি গল্পটিকে ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ করেছে। লেখকের পর্যবেক্ষণী দৃষ্টি এক্ষেত্রে বেশ তীব্র। ফলে ‘মোষের শ্বাস-প্রশ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দ, মোষের শিং-এ বসে থাকা ফিঙে পাখি কিংবা বেজির এক দৌড়ে গর্তে ঢোকার দৃশ্য‘ এসব তার চোখ এড়ায়নি। ফকি বুড়ির আবির্ভাব সম্বন্ধে গল্পকার বলছেন, ‘বুড়ি এসেছিল আটটি গ্রাম পেরিয়ে। কাঁধে ঝুলছিল মরণের চিহ্ন সংবলিত মঙ্গলবারের ফাঁসির দড়ি। ওই দড়ি সংগ্রহ করার জন্য বুড়ি গিয়েছিল দূর গ্রামে। গ্রামবাংলার ছবি তারেকের সৃষ্টিশীল কলমে অঙ্কিত হয়েছে স্বতন্ত্র ভাষায় ‘দু’ধারে বাঁশঝাড়। মাঝখানে পায়ে হাঁটাপথ। বাড়িঘরের হেঁসেল থেকে আসা ধোঁয়া কঞ্চির মাথায় কু-লী পাকিয়ে ঝুলছে, অন্ধকার দাঁড়িয়ে আছে বাঁশের সঙ্গে পিঠ রেখে। মাটি আর পচা পানির গন্ধ মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে কীটপতঙ্গ। আরেক জায়গায় আকলিমার মানসিক অবস্থা বর্ণিত এভাবেÑ ‘নেতিবোধ থেকে ছিটকে আসা বিষণœতা চক্রাকারে ঘোরে, হাহাকার গড়ায়।’ একই গল্পে লেখক নানা জিনিসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। কবিতার মতো উপর থেকে নিচে ছোট ছোট বাক্য সাজিয়েছেন। মাকড়শার জাল। হা হয়ে থাকা মেঝে। একদলা ফ্যাকাশে আলো। ক্ষয়ে যাওয়া ইট। যেন মুভি ক্যামেরা দ্রুত এক বস্তু থেকে আরেক বস্তুর ওপর গিয়ে পড়ছে। সিনেমাসুলভ এই টেকনিক লেখক বেশ কার্যকরভাবে প্রয়োগ করেছেন তার একাধিক গল্পে। কথাসাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রে নিজেকে লিপ্ত করার পেছনে কি ধরনের চিন্তা-ভাবনা কাজ করেছিল তারেকের মনে, আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে ভাল বলতে পারবেন তারাই যারা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু তারেক তার রচিত গল্পে সিনেমার টেকনিক ব্যবহার করেছেন সচেতনভাবেই। ওই বয়সে যে রকম জীবনমনস্কতা আর যে ধরনের গল্পভাষা তিনি অর্জন করেছিলেন তাতে ধারণা করি, পরবর্তী বছরগুলোতে গল্প নিয়ে মেতে থাকতে পারলে কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতেন। কিন্তু তারেক শাহরিয়ার কয়েকটি গল্প লেখার পর লেখকতা আর করলেনই না। হয়ত সিনেমাকে তার বেশি শক্তিশালী মাধ্যম মনে হয়েছিল। ঠিক আছে, একজন শিল্পীর এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতারূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সকল প্রাথমিক আয়োজন যখন তিনি সম্পন্ন করেছিলেন ঠিক তখনই তার জীবনমঞ্চের যবনিকাপাত হলো। এর চেয়ে বড় দুর্ঘটনা আর কি হতে পারে?
×