ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নেপাল থেকে বিদ্যুত ॥ জলবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে সমঝোতা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ আগস্ট ২০১৮

নেপাল থেকে বিদ্যুত ॥ জলবিদ্যুত  কেন্দ্র  নির্মাণে  সমঝোতা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের সীমানা পেরিয়ে এবার প্রতিবেশী দেশ নেপালে বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। দেশটির জলরাশিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনের দীর্ঘ আলোচনার পর শুক্রবার কাঠমান্ডুতে দুই দেশ এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী খাদগা প্রসাদ অলি বলছেন এই সহযোগিতা বাংলাদেশ নেপালের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করবে। দেশের বাইরে নেপাল এবং ভুটানে জল বিদ্যুত উৎপাদনে সরকার এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। বিদ্যুত বিভাগের এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছেন। জল বিদ্যুত নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন হওয়ায় এ ক্ষেত্রে ঋণ প্রাপ্তিও সহজ। বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরেই নেপালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করে আসছে। প্রবিবেশী দেশের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ শুরু থেকেই বিভিন্ন দেশের জ্বালানি শক্তিকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়। আঞ্চলিক সহযোগিতার বড় ক্ষেত্র সার্কে বিষয়টি উত্থাপন এবং একটি ফ্রেম ওয়ার্ক সৃষ্টি করে বাংলাদেশ জ্বালানি সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে সফল হয়। সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের পক্ষে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং নেপালের পক্ষে দেশটির জ্বালানি, পানি সম্পদ ও সেচ বিষয়ক মন্ত্রী বর্ষমন পণ অনন্ত স্বাক্ষর করেন। বলা হচ্ছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সুদৃঢ় করে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। এ সমঝোতার মূল লক্ষ্য বিনিয়োগ ও বিদ্যুত উন্নয়ন প্রকল্পের উন্নয়নসহ বিদ্যুত খাতে উভয়পক্ষের সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। এর আগে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুতখাতে সহযোগিতার জন্য সমঝোতা হয়। এই সমঝোতার ভিত্তিতে উভয় দেশ এর মধ্যে আন্তঃবিদ্যুত সংযোগ, বিদ্যুত আমদানি ছাড়াও বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এ ছাড়া ভারতে বাংলাদেশ যৌথ মালিকানায় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। এমওইউ সই অনুষ্ঠানে নসরুল হামিদ বলেন, ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে নয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করবে। ভারত থেকে ইতোমধ্যে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হচ্ছে এবং আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। নেপালে জলবিদ্যুত উৎপাদনের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় বাংলাদেশ নেপাল থেকে জলবিদ্যুত আমদানি করতে চায়। এতে উভয় দেশ উপকৃত হবে। তিনি বলেন, এই চুক্তি বিদ্যুত খাতের জন্য একটি প্লাটফর্ম বা কাঠামো তৈরি করবে যা বিদ্যুত বিনিময়, বিদ্যুত বাণিজ্য, গ্রিড সংযোগ, জলবিদ্যুত উন্নয়ন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। সহযোগিতাটি উভয় দেশকে লাভবান করবে এবং বিদ্যুত খাত সম্পর্কে উভয় দেশের জনগণ ও বেসরকারী সংস্থাকে উৎসাহিত করবে। এই সফরে নেপাল থেকে বাংলাদেশে জলবিদ্যুত আমদানি, যৌথ বিনিয়োগে নেপালে জলবিদ্যুত প্রকল্প স্থাপন ও বাংলাদেশের বিদ্যুত আমদানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সোলার হোম সিস্টেম প্রসারে নেপালকে বাংলাদেশের সহযোগিতা, নেপালের আপার কারনালি জলবিদ্যুত প্রকল্প হতে ৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত আমদানি ইত্যাদি বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আলোচনায় বলেন, জলবিদ্যুত উৎপাদনে বাংলাদেশ নেপালে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক। এ বিনিয়োগে উভয় দেশ উপকৃত হবে। আগামী ৬ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য বিদ্যুত ও জ্বালানি সপ্তাহ-২০১৮ এ নেপালের জ্বালানি, পানি সম্পদ ও সেচ বিষয়ক মন্ত্রীসহ একটি প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশে সফরের আমন্ত্রণ জানান। নেপালের জ্বালানি, পানি সম্পদ ও সেচ বিষয়ক মন্ত্রী বর্ষমন পণ অনন্ত বলেছেন, বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে নেপাল বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে নিয়েছে। বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত অভিজ্ঞতা নেপালের প্রয়োজন। বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প বাস্তবায়ন, সোলার হোম সিস্টেম, নেট মিটারিং, এলপিজি, এলএনজি ইত্যাদি ব্যাখা করে বলেন নেপালে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এলপিজি কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ সময় অন্যান্যের মাঝে নেপালের জ্বালানি, পানি সম্পদ ও সেচ বিষয়ক সচিব অনুপ কুমার উপাধ্যায়, নেপালের বিদ্যুত উন্নয়ন বিভাগের মহাপরিচালক নবিন রাজ সিং ও নেপাল বিদ্যুত কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুলমান ঘিসিং এবং বাংলাদেশের নেপালে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মাশফী বিনতে শামস, বিদ্যুত বিভাগের যুগ্ম সচিব ফায়েজুল আমীন ও আইপিপি সেলের পরিচালক মাহবুবুল আলম উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র বলছে, ভারত তার দেশের ভূ-খন্ড ব্যবহার এর প্রতিবেশী দেশে বিদ্যুত আদান প্রদানের ক্ষেত্রে প্রকল্পে দেশটির (ভারত) অংশীদারিত্ব থাকার কথা উল্লেখ করে নীতিমালা করেছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের সহায়তা ছাড়া নেপাল থেকে বিদ্যুত আমদানি সম্ভব নয়। এই জটিলতা নিরসনে নেপাল এবং বাংলাদেশ মিলে ভারতকে অনুরোধ করা হবে। এই অনুরোধে ভারতের ভূ-খন্ড ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে ভারতের সংশ্লিষ্ট কোম্পানি শুধুমাত্র বিদ্যুত পরিবহনের জন্য হুইলিং চার্জ (সঞ্চালনের অর্থ) পেতে পারে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী এমওইউ সই করার পরও ভারতের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক আলোচনার কথাই জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্র ভারত সরকার তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনলে বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে সহযোগিতা ফলপ্রসূ হবে। অন্যথায় ভারতের সরকারী বা বেসরকারী কোন কোম্পানিকে প্রকল্পের অংশীদারিত্ব দিতে হবে। এমওইউ সই হওয়ার পর ভারতের মতো নেপালের সঙ্গে যৌথ স্টিয়ারিং কমিটি ও ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। ফলে দেশটির বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। নেপালে জিএমআর নামে ভারতীয় একটি কোম্পানি জলবিদ্যুত উৎপাদন করছে। তারা বাংলাদেশে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত বিক্রির প্রস্তাবও দিয়েছে সরকারকে। এ ছাড়া ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পাানি এনভিভিএন নেপাল থেকে ৫০০ হতে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত বাংলাদেশে বিক্রি করতে আগ্রহী। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার অথবা বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদী বিদ্যুত বিক্রয় চুক্তি সইয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। নেপালে ৩০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুত উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলেও দেশটি বর্তমানে সামান্য পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করছে। এখানেও ভারতের বিভিন্ন কোম্পানি কয়েকটি জলবিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন নেপাল এবং ভুটানের উদ্যোগের সঙ্গে মিয়ানমারকে যুক্ত করতে পারলে আরও বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। দেশটিতে আরও ৪০ হাজার মেগাওয়াটের জলবিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। অবশ্য মিয়ানমার এরই মধ্যে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করছে। যারা এসব বিষয়ে আগে থেকে পারদর্শী। আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে এখনও বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে কোন আলোচনা করেনি। তবে চীনা কোম্পানিগুলো মিয়ানমারের সঙ্গে ইতোমধ্যে কয়েকটি চুক্তি করেছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত ॥ সমঝোতা স্মারক সই করার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী খাদগা প্রসাদ অলির সঙ্গে সাক্ষাত করতে তার কার্যালয়ে যান নসরুল হামিদ। এ সময় খাদগা প্রসাদ বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে তার সরকারের আন্তরিকতার কথা তুলে ধরেন। নেপালের প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুতখাতে সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশ-নেপাল সমঝোতা স্মারক স্বাগত জানিয়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুই দেশের সরকারী পর্যায়ে বা যৌথ বিনিয়োগ বা বেসরকারী খাত এ চুক্তির হাত ধরে জলবিদ্যুত প্রকল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ-নেপাল সহযোগিতার সম্পর্ক দৃঢ় করবে। তিনি পানি ব্যবস্থাপনা, বাঁধ নির্মাণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, জলবিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে তার সরকারের পরিকল্পনা আলোচনা করেন। নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতে সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক কার্যকর করতে উচ্চ পর্যায়ের মতবিনিময়, বিদ্যুত বাণিজ্যের জন্য ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল ত্রি-পাক্ষিক চুক্তি প্রয়োজন। পরিশেষে তিনি দারিদ্র্য বিনোচনে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুত খাতের উন্নয়নের জন্য সরকার গৃহীত কার্যক্রম নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করে বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা গেলে এ অঞ্চলের উন্নয়ন দ্রুত হবে। নেপালের জলবিদ্যুত বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো যেতে পারে আবার শীতকালে বাংলাদেশও নেপালকে বিদ্যুত দিতে পারে।
×