ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

তেলের পর আসছে বিদ্যুতের আধিপত্য

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১২ আগস্ট ২০১৮

 তেলের পর আসছে বিদ্যুতের আধিপত্য

তেল বিংশ শতাব্দীর রাজনীতি থেকে শুরু করে অনেক কিছুরই চরিত্র নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ফরাসী নেতা জর্জ ক্লিমেন সুর ভাষায়, যুদ্ধের সময় পেট্রোলিয়াম হলো রক্তের মতো অপরিহার্য। আর শান্তির সময় তেল, শেয়ারবাজার, ব্যাংকের আমানতের ওপর আধিপত্য করেছে এবং সমস্ত দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এই তেলের আধিপত্য ও প্রভাব ম্লান থেকে ম্লানতর হয়ে পড়বে। সস্তায় লভ্য প্রাকৃতিক গ্যাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বৈদ্যুতিক বাহনের ব্যবহার এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগের ফলে জ্বালানি শক্তির পছন্দের উৎসটি হবে বিদ্যুত। এ এক শুভ সংবাদ এবং স্বাগত জানানোর মতই ব্যাপার। বিদ্যুতের যুগ ২ ট্রিলিয়ন ডলারের তেল বাণিজ্যের প্রভাব খর্ব করবে, যেসব স্থান তেলের কারণে বিশ্ব উত্তেজনাকে উৎসে পরিণত হয়েছে সেগুলোর সংখ্যা কমে আসবে, জ্বালানি উৎপাদন স্থানীয়দের হাতে চলে যাবে এবং বিদ্যুতশক্তি গরিব মানুষের কাছে আরও বেশি সহজলভ্য হয়ে উঠবে। এর ফলে বিশ্বের পরিবেশ অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ ও নিরাপদ হবে। তবে সেই অবস্থাটিতে পৌঁছতে পারাই হলো সমস্যা। সেটা যে শুধু তেল উৎপাদনকারীদের জন্য তাই নয়, উপরন্তু সবার জন্যই এই উত্তরণ পর্ব এক কঠিন ও বিঘœসংকুল হয়ে দাঁড়াতে পারে। তেল ও বিদ্যুত দুটি বিপরীতধর্মী গষেণার বিষয়। তেল এক বিষ্ময়কর জ্বালানি। কয়লার যে ওজন সেই তুলনায় সমপরিমাণ ওজনের তেল অনেক বেশি জ্বালানি শক্তি ধারণ করে থাকে। পরিমাণের দিক থেকেও এতে প্রাকৃতিক গ্যাসের তুলনায় বেশি ইন্ধন শক্তি আছে। বলাবাহুল্য, তেল ও গ্যাস উভয়েই আবার বিদ্যুত শক্তির প্রধান উৎস। তেল জাহাজযোগে পাঠানো, মজুদ করা এবং পেট্রোল থেকে শুরু করে প্লাস্টিক এমনকি ভেষজ সামগ্রী পর্যন্ত নানাবিধ পরিশোধিত পণ্যে রূপান্তরিত করা সহজ। কিন্তু ভৌগোলিক কারণে এটি শুধু সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় পাওয়া যায়Ñ সর্বত্র নয়। এর উৎপাদন গুটিকয়েক হাতে কেন্দ্রীভূত। উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে শুরু করে ওপেক ও রাশিয়া পর্যন্ত তেলের ওলিগোপলিস্টিক সরবরাহকারীরা দাম চড়া রাখার লক্ষ্যে বাজারে তেলের সরবরাহ সর্বক্ষণ কম রাখার চেষ্টা করে আসছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে তেল কেন্দ্রীভূত থাকা ও তেল ব্যবসায়ে কার্টেল সৃষ্টি হওয়ার ফলে সহজেই তেল সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে এবং তেল সম্পদে সমৃদ্ধ সরকারগুলো দুর্নীতিতে সহজেই জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে বিদ্যুত তেলের চাইতে কম ভোক্তাবান্ধব। এটা মজুত করা কঠিন। দীর্ঘ দূরত্বে স্থানান্তরকালে বিদ্যুতশক্তি নষ্ট হয়। এর ট্রান্সমিশন ও বিতরণের জন্য প্রয়োজন নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা। তবে অন্য আর সবদিক দিয়ে এটি অধিকতর শান্তিপূর্ণ জগতের প্রতিশ্রুতি বহন করে। বিদ্যুতের ওপর মনোপলি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। কারণ প্রাকৃতিক গ্যাস ও পরমাণু শক্তি থেকে শুরু করে সৌরশক্তি, হাইড্রো ও বায়োমাস পর্যন্ত অসংখ্য সূত্র থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। উৎপাদনের জন্য জ্বালানি হিসেবে যত বেশি এই উৎসগুলো কয়লা ও তেলের স্থান দখল করে নেবে ততবেশি জ্বালানি বিশুদ্ধ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেবে। আবহাওয়ার সঠিক অবস্থা বিরাজ করলে ভৌগোলিক দিক দিয়েও এগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাপ্তিযোগ্য। জার্মানরা থেকে শুরু করে কেনীয়রা পর্যন্ত যে কেউ বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারে। নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য শুধু বিশেষ ধরনের প্রযুক্তিই নয়, বিরল কিছু মৃত্তিকা ও খনিজ উপাদানও প্রয়োজন হয় সেগুলোর ওপর সৌরপ্যানেল ও বায়ু টার্বাইনগুলো নির্ভর করে থাকে। এসব প্রযুক্তি এবং বিরল মৃত্তিকা ও খনিজ উপাদান সংরক্ষণবাদী নীতির ও বাণিজ্য যুদ্ধের আওতায় চলে আসতে পারে। বিশ্বের এই শ্রেণীর বিরল মৃত্তিকার ৮৫ শতাংশ উৎপাদন করে চীন। সেই চীন ওপেকের মতো কৌশল অবলম্বন করে ২০১০ সালে এই বিরল মৃত্তিকার রফতানি কোটার ওপর দারুণ কড়াকড়ি আরোপ করেছিল। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনা সৌর প্যানেল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। তথাপি বিদ্যুত উৎপাদন ও মজুদের সঙ্গে যুক্ত অপরিহার্য উপাদানগুলো তেলের মতো পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় না। এগুলোর মজুদ থাকলে এর বেশির ভাগ অংশ পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা যায়। তাছাড়া বিদ্যুত উৎপাদনে মনোপলি বা একাধিপত্য প্রতিষ্ঠাও ব্যর্থ করে দেয়া যায়। নবায়নযোগ্য সূত্র থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য যেসব বিরল উপাদান দরকারÑযেমন ধরুন বিরল মৃত্তিকা সেটাও আসলে বিরল হয়। এগুলোর একটি সেরিয়াম প্রায় জিংকের মতোই সহজলভ্য। নবায়নযোগ্য উৎসব থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করতে গেলে অনেক সময় আঞ্চলিক গ্রিডের প্রয়োজন হয় যাতে করে যেখানে এই বিদ্যুতের প্রাচুর্য আছে সেখান থেকে তা বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই সব এলাকায় যেখানে রয়েছে এর ঘাটতি। এ থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে ওঠার সুযোগ থাকে। রাশিয়া তার প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরোপে সরবরাহ করতে গিয়ে যেমন পাইপলাইন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুত নিয়েও ঠিক তেমনি অবস্থা ঘটতে পারে। এর চেয়েও বড় সম্ভাবনা হলো এই যে সরবরাহ বিভিন্নমুখী করার জন্য গ্রিডগুলো যেহেতু পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে তাই পরস্পরের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল দেশগুলো এই উপসংহারে পৌঁছাবে যে বাজারে কারসাজি করতে যাওয়া আত্মপরাজয়ের নামান্তর। আর যাই হোক না কেন বিদ্যুত তো আর প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো নয় যে তা মাটির তলে মজুত করে রাখা সম্ভব। বিদ্যুতনির্ভর বিশ্ব তাই বাঞ্ছনীয়। তবে দুটো কারণে সে অবস্থায় পৌঁছতে পারা একই সঙ্গে কঠিন ও জটিল। কারণ এর মধ্যে যে ভূ-রাজনীতি জড়িত তা আরও জটিল রূপ ধারণ করবে। গত জানুয়ারি মাসে একটি আন্তর্জাতিক কমিশনের পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে যে বিদ্যুতনির্ভর বিশ্বে পৌঁছতে পারলে দুনিয়াটা অধিকতর শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল হয়ে উঠবে। হাইড্রোকার্বন তো সবখানে নেই। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যেতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসের সম্মিলিত চেষ্টা থাকলে উন্নয়নের সুযোগ সবার জন্যই উন্মুক্ত হবে এবং প্রযুক্তিরও অংশীদার সবাইকে করা যাবে। বিদ্যুত উৎপাদনের উৎসগুলো অধিকতর ছড়িয়ে পড়লে যেমনটি ঘটেছে জার্মানি, চীন ও ক্যালিফোর্নিয়ার ক্ষেত্রে, সেক্ষেত্রে অঞ্চলগুলো জ্বালানিতে অধিকতর স্বনির্ভর হবে যার নাম দেয়া হয়েছে জ্বালানির গণতন্ত্রায়ণ। আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চল মিনি গ্রিড ও রুফটপ সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বর্ধিত জ্বালানি লাভের ফলে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়ে চলা সত্ত্বেও জ্বালানির ঘাটতি কমে আসবে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে প্রথমে কয়লা এবং তারপর তেল জ্বালানিতে উত্তরণের ফলে বিশ্বের চেহারা বদলে গিয়েছিল। এখন সর্বশেষ এই নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আহরিত বিদ্যুত জ্বালানিতে উত্তরণেও সমান সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×