ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

ছাত্র আন্দোলন সড়ক নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও সচেতনতা

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৩ আগস্ট ২০১৮

ছাত্র আন্দোলন সড়ক নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও সচেতনতা

ছাত্র আন্দোলন সড়ক নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা সচেতনতা সৃষ্টিতে জাতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর এক নতুন বাঁকে নিয়ে যাবে। সমাজে, রাষ্ট্রে, ঘটনা, দুর্ঘটনা কত কিছুই ঘটে থাকে। কত ঘটনা হিসাবভুক্ত হয় না, ইতিহাসে থাকে না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে মিছিল সেক্ষেত্রে চিত্রটা যেন পারিবারিক বলয় থেকে সমাজে ও রাষ্ট্রে বিস্তৃতি লাভ করে তা যেন মহাশোকের প্লাবন বয়ে দেয়ার পরিণতির উদ্ভব ঘটার অবস্থা। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় এত লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন যে তাকে মৃত্যুর মিছিল হিসেবেই আখ্যায়িত করা যেতে পারে। সড়ক পথের বিশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তাহীনতা যেন ভয়াবহ দুর্যোগে পরিণত হতে যাচ্ছিল। এমনি এক কঠিন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বিবেকের কাছে দায় এড়িয়ে যারা বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার হুলি খেলায় মেতে উঠেছিল তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী ছাত্ররা রাস্তায় আন্দোলনে নেমে পড়ে। একে আন্দোলনে না বলে নিরাপত্তার জন্য মহড়া বলা যেতে পারে। ছাত্রদের এ আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ কেউ এটাকে সরকার উচ্ছেদের পদক্ষেপ, ক্ষোভ, অসন্তোষ বলতে চেষ্টা করেছেন, কেউবা বিরোধীদলীয় রাজনীতির ভূমিকা বলে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলন আপামর জনগণের সুখের ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার আন্দোলন। এই আন্দোলনকে কোনভাবে বিকৃত বা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বরং জাতি যেভাবে শৃৃঙ্খলা জ্ঞান বিবর্জিত হয়ে অসচেতনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে ডুবে যাচ্ছিল- সেই অমানিশার ঘোর কাটাতে ছাত্র সমাজ যে ভূমিকা রেখেছে তা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিকতার মানদ-েই নিরুপিত হবে। এই আন্দোলন আসলে সরকার বা বিরোধী দল কারও পক্ষের না, বিপক্ষের নয় বরং এ দাবি সর্বসাধারণের এবং তাকে জনগণের পক্ষের আন্দোলন বলেই মনে হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তাদের নতুন ধারার অহিংস আন্দোলন এর মধ্য দিয়ে দেশের সুশীল সমাজ, মন্ত্রী, এমপি, পেশাজীবী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সর্বোপরি রাষ্ট্রের সামনে এক শিক্ষণীয় উদাহরণ তৈরি করেছে। এ উদাহরণ শৃঙ্খলার এবং সচেতনতাবোধের উদাহরণ। ঘুমিয়ে পড়া জাতিকে শৃঙ্খলা ও সচেতনায় উজ্জীবিত করার উদাহরণ। আন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীরা ট্রাফিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যে সেবা দেশবাসীকে দিয়েছে তাতে অনেকের সেবার মানকে ম্লান করে দিয়েছে। তাদের দাবিতে আজ বিপরীতে লাইসেন্স ও ফিটনেস নবায়নের ধুম পড়েছে। সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। এমনকি পথচারীরা রাস্তা পারাপারে সতর্কতা ও নিয়ম রক্ষায় সচেতন হয়ে উঠেছে। যা অনেকেই করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতেই প্রস্তাবিত সড়ক নিরাপত্তা আইন দ্রুত মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বহুমুখী সফল আন্দোলনের সম্প্রতি যোগ হলো সড়কের বিশৃঙ্খলা ও মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের যুগান্তকারী এক অনন্য আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। গঠনতান্ত্রিক আন্দোলন, নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন কোন অর্থেই খারাপ নয়। তবে এসব আন্দোলনকে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন সুষ্ঠু ও সুন্দর আন্দোলন পরিচালনার মূল নায়ক। তিনি যেখানে অনিয়ম দেখেছেন, নৈরাজ্য দেখেছেন এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দেখেছেন সেখানেই সোচ্চার হয়েছেন এবং তা মোকাবেলা করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালীন অবিভক্ত ভারতের নেতা জওহরলাল নেহরুর সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্রাবাসের অব্যবস্থার কথা বলেছেন। দেশ বিভাগের আগে ও পরে স্বৈরাচারী সরকারের তোপের মুখে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন। সেই সূত্র ধরে যদি আমরা দেখি, তা হলে অবশ্যই বলতে হবে যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমাদের ছাত্র আন্দোলনের অনেক গৌরবগাথা আছে। সেই গৌরবময় ইতিহাসের মাধ্যমে ছাত্র সমাজ জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছে। যে ছাত্র রাজনীতি ছিল এককালের অনুকরণীয় আদর্শ তা আজ যেন ভূলুণ্ঠিত, অবদমিত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আজ যে ছাত্র সমাজ বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক পরিসরে পরিণত করেছেন। খেলার পুতুলের ঘুঁটির মতো করে তাদের ব্যবহার করতে চেষ্টা করছেন। আজ বর্তমান ছাত্র সমাজের অনেকেই লেজুরবৃত্তির আবর্তে আবর্তিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধারা পর্যন্ত অর্জিত বাঙালী জাতীয়তাবোধের ধারাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। কিন্তু পর্যায় ক্রমিক সামরিক অভ্যুত্থান, সেনাশাসন, স্বৈরশাসন ইত্যাদির কারণে ছাত্র রাজনীতি বা আন্দোলন যেন এক অবক্ষয়ী নিতে ছাত্র সমাজ তাদের অর্জিত সুনামকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বার্থান্বেষী বা সুবিধাভোগী রাজনীতির ধারার লেজুরবৃত্তির মাধ্যমে বিতর্কিত ও কালিমালিপ্ত করে তুলেছেন। যদি বাড়িয়ে বলা হয়, তাহলে বলতে হবে যে টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজির মতো কলঙ্কের তিলক মাথায় নিয়ে এক কালো অধ্যায়ই রচিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বিগত কয়েক দশক থেকে সংগঠিত ছাত্র রাজনীতি বলতে যা বোঝায় তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছেÑ ছাত্র সমাজ আর নির্বাচন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন সংগঠিত ও সুসংহত ছাত্র সংসদ উপহার দিতে পারছে না এবং সে পরিবেশ তৈরি করতেও সক্ষম হচ্ছে না। পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে ছাত্র সমাজকে এক, অভিন্ন ছাতার নিচে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। উল্লেখ্য, এই আন্দোলনের মাঝপথে এ দেশেরই কুচক্রীমহল ছাত্রদের এ আন্দোলনকে ইস্যু করে দেশে নৈরাজ্য, খুনোখুনি সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। মরিয়া হয়ে উঠছে দেশকে অচল করে দেবার ষড়যন্ত্রে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভাল-মন্দ দুটি ভাগে বিভক্ত করে দেয়ার এ যেন এক কুৎসিত ষড়যন্ত্র। তবে সাম্প্রতিক আন্দোলন যে ইস্যুতে হয়েছে তাতে ছাত্র সমাজ তাদের হৃত গৌরব অনেকটাই পুনরুদ্ধার করেছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা আঙ্গুল তুলে যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি যারা বেআইনীভাবে লাইসেন্সবিহীন গাড়ি নামিয়েছেন তাদের মুখোমুখি হয়েছেন এবং তাদের আইনভঙ্গকারী আখ্যায়িত করে লজ্জার ফাঁদে ফেলে দিয়েছেন। এই চিত্রে সাধারণ জনগণ খুশিই হয়েছেন। এই কার্যক্রমকে প্রকারান্তরে উৎসাহিত করে অনেক অভিভাবকগণ, মায়েরা তাদের কিশোর ছেলেমেয়েদের রাস্তার শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে আন্দোলন বা পদক্ষেপ তাকে স্বাগত জানিয়ে ছেলেমেয়েদের বাড়ি ফেরা অবধি গাইড করেছেন। কিন্তু এই সুন্দর কার্যক্রমকে পুঁজি করে অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্য কেউ কেউ নেতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টির উস্কানি দিতেও তৎপর ছিলেন। কেউবা তাদের এই সুনাম অর্জন করা অবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে শান্তিপ্রিয় ছেলেমেয়েদের হেনস্তা করতেও পিছপা হননি। কিন্তু তাদের এই কুৎসিত তদারকি ও ঘৃণ্য কার্যক্রমকে সফল হতে দেয়া যাবে না। ছাত্রদের সব দাবি বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। তাই আমাদের উচিত কোন উস্কানি দাতা, মদদতাতার ছোবলে পড়ে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যেন না পাড়ে। স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে সব কিছুকে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে অগ্রসর হতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের ফিরে যেতে হবে তাদের শ্রেণীকক্ষে। মন দিতে হবে পড়াশোনায়। কেননা আজকের ছাত্র সমাজ যদি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হতে পারেÑ তা হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবেই বা কি করে? এই আন্দোলন থেকে আমাদের যেন বোধোদয় ঘটে। শপথ নিতে হবে সঠিক নেতৃত্বের। শৃঙ্খলা ও সচেতনার মাধ্যমে সুন্দর সমাজ বির্নিমাণে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। লেখক : গবেষক [email protected]
×