ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদি যুবরাজ আসলে কি করতে চান

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১৩ আগস্ট ২০১৮

 সৌদি যুবরাজ আসলে কি করতে চান

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান কার্যত সে দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যদিও তাঁর পিতা বাদশাহ সালমান সিংহাসনে অধিষ্ঠিত তথাপি ৮২ বছর বয়স্ক এই বাদশাহর শরীর ভাল নয় এবং সে কারণে তার পক্ষ থেকে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ করে চলেছেন এই যুবরাজ। এই ক্ষমতাবলে শুরু থেকেই তিনি সৌদি আরবের আধুনিকায়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির প্রাধান্য পুনর্প্রতিষ্ঠার এক উচ্চাভিলাষী ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিকল্পনা নিয়েছেন। পিতা বিন সালমান বাদশাহ হওয়ার তিন বছরের মধ্যে যুবরাজ দেশটির অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নির্মমভাবে সংহত করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদারিকীকরণ চালু করেছেন এবং এই অঞ্চলজুড়ে ইরানের সঙ্গে প্রক্সিযুদ্ধের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছেন যার অন্যতম পরিণতি হলো পার্শ্ববর্তী ইয়েমেনে সামরিক সঙ্কট। তিনি তেল রফতানির ওপর দেশটির নির্ভরতা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠে পেট্রোলিয়াম-উত্তর ভবিষ্যতের জন্য অর্থনীতিকে বিভিন্নমুখী করে তুলতে চাইছেন। তার পরিকল্পনা সফল হলে বিশ্বের অন্যতম পশ্চাদমুখী স্বৈরতন্ত্রের দেশটি তেল রফতানিকারকের ভূমিকা থেকে বৈশ্বিক অগ্রগতির শক্তিতে পরিণত হবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে আকস্মিক পরিবর্তনের ফল অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। তিনি যেভাবে সবকিছু তাড়াহুড়া করছেন তাতে তার বিপদাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। যুবরাজ মোহাম্মদের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার নাম ‘ভিশন ২০৩০’। হতে চার পাশের জগতের সঙ্গে সৌদি আরবের সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সামঞ্জস্য বিধান করার প্রতিশ্রুতি আছে। এই পরিকল্পনা এমন এক সময় নেয়া হয়েছে যখন ইয়েমেনে সৌদি বোমাবর্ষণ চলছে, যখন সৌদি ব্লগাররা জেলে রয়েছে, যখন প্রতি চারজন সৌদি নাগরিকের তিনজন এখনও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতনের চেক পাচ্ছে অথচ প্রকৃত চাকরির ৮৪ শতাংশ কাজ করছে বিদেশীরা। যাদের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যুবরাজের বিপুল অর্থ প্রয়োজন। সেই অর্থের সন্ধানে তিনি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। পরিকল্পনা করা যতটা সহজ এর বাস্তবায়ন ততটা কঠিন। কারণ তেলের দাম পড়ছে। অন্যদিকে ক্রমস্ফীত যুব জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদা ততই বাড়ছে। এর জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সংস্কার এবং তার জন্য অর্থেরও দরকার। তবে তাঁর এই সংস্কারের পথে বিরোধিতা আসতে পারে। অংশত এর কারণ সৌদিরা নিজেরাই পরিবর্তনবিমুখ। এক শতাব্দী আগে যা ছিল দারিদ্র্যপীড়িত এক মরুর দেশ তেল সম্পদের বদৌলতে কয়েক দশকের মধ্যে সেই দেশটিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে। সেটা দেশটির অবকাঠামো ও বাহ্যিক চেহারায়। তরুণ সম্প্রদায় বাদে বাকি সৌদিদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন সে গতিতে হয়নি। স্বয়ং মোহাম্মদ বিন সালমান বলেন, তাদের এ কথা বোঝাতেই বেশ বেগ পেতে হয় যে আরও অনেক কিছু করা বাকি আছে। যুবরাজ শুধু যে তেলের ওপর দেশটির নির্ভরশীলতা বাদ দেয়ার কথা বলছেন তা নয়, ধর্মীয় মৌলবাদ রফতানিও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই ধর্মীয় মৌলবাদ কয়েক দশক ধরে আল কায়েদা, তালেবান, আইসিস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ইন্ধন যুগিয়েছে। ‘টাইম’ সাময়িকীর কাছে তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি যে সৌদি আরবসহ গুটিকয়েক দেশে ইসলামের যে চর্চা করা হচ্ছে তা প্রকৃত ইসলামের চর্চা নয়। বরং ১৯৭৯ সালের পর যারা ইসলামকে হাইজ্যাক করেছে এটা হলো তাদেরই চর্চা।’ কিন্তু তারপরও এই যুবরাজ গত সেপ্টেম্বর থেকে অহিংস পথের অনুসারী কয়েক ডজন ইমাম ও ইসলামী বুদ্ধিজীবীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে যে, তার সংস্কার কার্যক্রম আসলে ভিন্নমত দলনের একটা মুখোশ কিনা। প্রশ্ন উঠেছে এই জন্য যে আজ সৌদিদের একাংশ বিশেষ করে তরুণ সমাজ নিজেদের দেশ নিয়ে অধিকতর স্বচ্ছন্দবোধ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো জনগণের দুর্ভোগ-দুর্গতি বিদ্যমান আছে এবং রাজনৈতিক দমন নির্যাতনও কমেনি। কাজেই একে গণতান্ত্রিক সংস্কার বলা যায় না। তবে যুবরাজ মোহাম্মদের মার্কিন সমর্থকের অভাব নেই। এদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রভাবশালী জামাতা জাবেড় কুশনারও আছেন। উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠা ইরানের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে সৌদি আরবকে ব্যবহারের জন্য ট্রাম্প যুবরাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন। কিন্তু যুবরাজ এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? কেননা তার বাবা সালমানের মৃত্যু হলে কিংবা তিনি সিংহাসন ত্যাগ করলে সিংহাসনটা শত শত মধ্যবাসী শাহজাদাদের এক নতুন প্রজন্মের হাতে গিয়ে পড়ত। তাদের চেয়ে বয়সে তরুণ হলেন মোহাম্মদ। তাই তিনি সময় নষ্ট করতে চাননি। সিংহাসনটা বাগানোর পথ পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন। তার এই তাড়াহুড়োভাব দেশটির নাজুক অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমান বাদশাহ সালমান ২০১৫ সালে সিংহাসনে আরোহণের সময় সৌদি তেল অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছিল প্রতি ব্যারেল তেলের দাম এক শ’ ডলার থেকে নেমে এসেছিল ৫০ ডলারে। সৌদি আরবের নগদ অর্থের যে বিশাল ভা-ার ছিল তা কয়েক বছরের মধ্যে নিঃশেষিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র প্রাকৃতিক গ্যাস ও শেল অয়েলের বদৌলতে জ্বালানির দিক দিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এক সময় রিয়াদকে বড় প্রয়োজন হলেও এখন আর সেই প্রয়োজনটা তেমন নেই। রিয়াদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ লক্ষণীয়ভাবে কম দেখা দিতে লাগল। আরও উদ্বেগের ব্যাপার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওবামা সৌদি আরবের জাত শত্রু ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য লাগাতার ইচ্ছা প্রকাশ করে চলেছিলেন যা আগের কোন প্রেসিডেন্ট করেননি। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের পথের কাঁটা হয়ে থাকলেও আইসিসকে ধ্বংস করতে আমেরিকার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। এই অবস্থায় তরুণ শাহজাদা মোহাম্মদ নীরবে নিঃশব্দে অথচ নির্মমভাবে ক্ষমতা সুসংহত করতে থাকেন এমনভাবে যে তার কাছে ম্যাকিয়াভেলিও ম্লান হয়ে যান। বাদশাহ সালমানের সিংহাসন আরোহণের সময় তার এই পুত্রটি বহির্বিশ্বের কাছে অপরিচিত ছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৯ বছর। তা সত্ত্বেও নতুন বাদশাহ সবকিছুর ব্যাপারে তার ওপর নির্ভর করছিলেন। তিনি শাহজাদা মোহাম্মদকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। তখন প্রতিরক্ষা বাজেটের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর সৌদি আরবের অবস্থান ছিল তৃতীয় বৃহত্তম। প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পাওয়ার পর পরই শাহজাদা মোহাম্মদ ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েন। মোহাম্মদকে বিশাল রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোর প্রধান, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান এবং উপ-যুবরাজ করা হয়। উপ-যুবরাজ হওয়ার ফলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার পথে তার বাধা থাকে মাত্র একজন। তিনি তার চাচাত ভাই ৫৫ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু মোহাম্মদের উচ্চাভিলাষের কাছে নায়েফ মোটেই পাত্তা পাওয়ার মতো ছিলেন না। মোহাম্মদের এই শেষ বাধাটিও দূর হয়ে যায় যখন ২০১৭ সালের জুন মাসে বাদশাহ সালমান নায়েফকে যুবরাজের পদ থেকে সরিয়ে পুত্র মোহাম্মদকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। এর পাঁচ মাস পর নতুন যুবরাজ মোহাম্মদ পুরনো ধারায় এক প্রাসাদ অভ্যুত্থান বা রক্তপাতহীন কুদ্যেতা ঘটান। শাহজাদা, রাজ কর্মচারী ও ব্যবসায়ীসহ কয়েক ডজন ব্যক্তিকে রিয়াদের রিজ কার্লটন হোটেলে আটক রাখেন। তাদের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয় যদিও এতে কোন আনুষ্ঠানিক আইনগত প্রক্রিয়া ছিল না। কোন স্বচ্ছলতাও ছিল না। অন্তত একজন রাজ কর্মচারী পুলিশের হেফাজতে মারা যায়। তার শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন ছিল। দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই সৌদি আরবে একটা রাজনৈতিক মুগুর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ২০০১ সালে প্রিন্স বন্দর আল-সুলতান প্রকাশ্যে হিসাব দিয়েছিলেন যে সৌদি আরব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে রাজ পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত একাউন্টে ৫ হাজার কোটি ডলার স্থানান্তর করা হয়েছে। মোহাম্মদ বিন সালমানের সরকার দাবি করেছেন যে বন্দীদের কাছ থেকে এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ আদায় করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ অবশ্য মোহাম্মদের বিরুদ্ধেও উঠতে পারে। কারণ প্রায় ৫০ কোটি ডলার দিয়ে তিনি একটি প্রমোদতরী এবং ভাসাইয়ের কাছে ৩০ কোটি ডলার দিয়ে তিনি একটি অট্টালিকা কিনেছিলেন। এত টাকা তিন পেলেন কোথায়? অবলীলাক্রমে জবাব দেন মোহাম্মদ এ টাকা তার নিজের উপার্জন করা। যাই হোক, প্রাসাদ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যুবরাজ মোহাম্মদ তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করেছেন। আগের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় সকল ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বন্টিত ছিল এবং তাতে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের একটা ব্যবস্থা ছিল। এখন সেটা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এতে যুবরাজের সৌদি অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা মার খেতে পারে। কারণ, এতে সৌদি সমাজে সম্ভাব্য অস্থিরতার কথা ভেবে বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যেতে পারে। অথচ বিন সালমান এর ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। ইতোমধ্যে তিনি ২ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি সভরিন ওয়েলস্ ফান্ড প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ। এই তহবিলের অর্ধেক সৌদি আরবের ভেতরে এবং বাকি অর্ধেক বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হবে। যুবরাজ সৌরবিদ্যুতে সৌদি আরবকে বিশ্বের এক নম্বর স্থানে নিতে চান। কার্বন ফাইবারের ব্যাপারেও তার সমান উৎসাহ। তিনি সৌদি আরামকোর একাংশ ব্যক্তি মালিকানায় দিতে চান। উদ্দেশ্য সেই বিশেষ তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরের পেছনেও তার একই উদ্দেশ্য কাজ করেছে। স্বদেশে তিনি কিছু কিছু সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন এনেছেন। যেমন জুন মাস থেকে মেয়েরা স্বাধীনভাবে গাড়ি চালাতে পারছে। সঙ্গীত উৎসব ও মুভি থিয়েটার চালু হয়েছে। ধর্মীয় পুলিশের রাশ টেনে ধরা হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো তরুণ সমাজের মধ্যে উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে। ট্যুরিস্টদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের জন্য ভিসা শিথিল করা হবে। যুবরাজ দাবি করেন যে, গত ত্রিশ বছরে যা করা হয়েছিল তিন বছরে তার চেয়েও বেশি কিছু করা হয়েছে। তবে নিজের স্বৈরাচারী শাসন আঁকড়ে ধরেছে। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান মিডিয়ার ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছেন। খামখেয়ালিভাবে ৬০ জন মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও ধর্মীয় নেতাকে সেপ্টেম্বর থেকে জেলে পুরেছেন। সৌদি রাজতন্ত্র নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রই রয়ে গেছে। যুবরাজ আগামী ৫০ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারেন এবং এই সময় সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা শিথিল করার কোন পরিকল্পনা তার নেই। সূত্র : টাইম
×