১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কালরাতে ঘাতকের বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হয়েও বেঁচে থাকা বরিশালের ‘ক্রিডেন্স ব্যান্ড’ দলের অন্যতম সদস্য ডাঃ খ.ম জিল্লুর রহমান এখনও সেই লোমহর্ষক দিনের কথা মনে হলে ভয়ে আঁতকে ওঠেন। সেই দিনের বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বারবার প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
সেই রাতের ভয়াল ও লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ঘাতকরা এতই পাষাণ ছিল যে, তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছোট্ট শিশু সন্তান শেখ রাসেল ও আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর শিশুপুত্র সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতকেও সেইদিন বাঁচতে দেয়নি। নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেছে। ১৫ আগস্ট ভোররাতে বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের
বাসায় ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় সেই দিনের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, একজন ঘাতক সৈনিক ড্রয়িং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। একে একে অনেককেই লুটিয়ে পরতে দেখে আমিও বাঁচার জন্য প্রাণপনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকি। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার শরীরের নিচের অংশে অনেকগুলো গুলি লাগে (পরে জানতে পারি আমার শরীরে ১৩টি গুলি লেগেছিল)। এরপর আমি লুটিয়ে পড়ি। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। ওই সৈনিক একাই পরপর তিনটি অস্ত্র দিয়ে রুমের মধ্যে ব্রাশফায়ার করে। সবাই লুটিয়ে পরার পর অন্য একজন সৈনিক একটি রিভালবার নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে অনেকের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। আমার ডান হাতে দুইটি ও বাম হাতে দুইটি গুলি করে। আজ আমি ১৭টি গুলির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। ঘাতক সৈনিকরা রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর কে যেন আমাকে টেনে হিচড়ে ড্রয়িং রুমের সোফার নিচে লুকিয়ে রাখে। যাদের গায়ে গুলি লাগেনি তারা ঘাতকরা চলে যাওয়ার পর পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ আমাদের রুমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। তার স্ত্রীর (শাহানারা বেগম) গায়েও গুলি লেগেছিল। ওই সময় আমি হাসানাত ভাইকে চলে যেতে অনুরোধ করি। তখন তিনি ওই বাড়ি থেকে চলে যান। পরেরদিন সকালে তৎকালীন রমনা থানার ওসি এসে আমাদের সবাইকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
বরিশাল নগরীর বগুরা রোডের বাসিন্দা ডাঃ খ.ম জিল্লুর রহমান বলেন, তৎকালীন মন্ত্রী কামরুজ্জামান বরিশালে আসার পর ‘ক্রিডেন্স ব্যান্ড’ দলের পক্ষ থেকে আমরা তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। মন্ত্রী কামরুজ্জামান আমাদের ব্যান্ড দলের গানে মুগ্ধ হয়ে পুরো দলকে ঢাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান এবং আমাদের (শিল্পীদের) বেতারে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দেন। মন্ত্রীর আশ্বাসে আমরা ক্রিডেন্স ব্যান্ড দলের ১০ সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাসায় উঠেছিলাম। আমাদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন, বরিশাল অপসোনিনের পরিচালক আব্দুর রউফ খান নান্টু। তার নেতৃত্বে আমরা ব্যান্ড দলের সদস্যরা ১৪ আগস্ট বিকেলে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় একটি মিলাদেও অংশগ্রহণ করি। ওইখানে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে মিলাদের তবারক তুলে দিয়েছিলাম। জিল্লুর রহমান আরও বলেন, রাতে মন্ত্রী কামরুজ্জামানের বাসায় একটি শিশুর জন্মদিনে আমরা ব্যান্ড দল অংশগ্রহণ করি। ওই অনুষ্ঠানে আমাদের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তখন পুরস্কৃত করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা ক্রিডেন্স ব্যান্ডদলের সদস্যরা সেখান থেকে চলে এসে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসার নিচতলার ফ্লোরে ঘুমানোর আয়োজন করি। ১৫ আগস্ট ভোরে হঠাৎ গুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিছুক্ষণ পরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠপুত্র আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। তিনি সবাইকে ভেতরের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ থাকতে বলে দোতালায় চলে যান। আমিসহ সকলে তখন ভয়ে কাতর হয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাহিরে বিপথগামী ঘাতক সেনা সদস্যরা অস্ত্র হাতে বাড়ি ঘিরে রেখেছে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই নরপশু ঘাতকরা আমরা যে রুমে প্রথম ঘুমিয়েছিলাম সেই রুমের কাঁচের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে থাকে। কিছু সময় পর একজন সৈনিক ভেতরে প্রবেশ করে। তখন আমাদের সঙ্গে থাকা সৈয়দ গোলাম মাহমুদ ওই সৈনিকের পা জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘স্যার আমরা এই বাসার কেউ নই, আমরা এখানে গান গাইতে এসেছি’। তখন ওই সৈনিক আমাদের সকলকে ‘ফরোয়ার্ড’ বলে সামনের দিকে নিয়ে যায়। এ সময় দেখতে পাই দোতালা থেকে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ঘাতকরা নিচে নিয়ে আসছে।
ওই সময় আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবী সেরনিয়াবাতকে একজন মেজরের সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেছি। বেবীকে বলতে শুনেছি, আপনারা কারা ? কেন আপনারা এ বাসায় এসেছেন। আপনারা জানেন, এ বাসা বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতির বাসা। এরপরও সৈনিকেরা সবাইকে নিচ তলার ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসে। রুমে আমরা ক্রিডেন্স ব্যান্ড দলের ১০ জনসহ মোট ৩০-৩২ জন অবস্থানকালীন বাহিরে প্রচ- গুলির শব্দ শুনতে পাই।
জিল্লুর রহমান বলেন, সেই ভয়াল কাল রাতে পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাড়িতে বরিশালের ছয়জন নারী-পুরুষ নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। তারা হলেন, সাবেক মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত, ক্রিডেন্স শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু। আহত হয়েছিলাম আমিসহ নয়জন। তারা হলেন, বেগম আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, সাহান আরা বেগম, বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠ পুত্র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত, রফিকুল ইসলাম, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ। জিল্লুর রহমান বলেন, সেই ভয়াল রাতের কথা আজও মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। রাতে মাঝেমধ্যে এখনও আঁতকে উঠি।