ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

আবার ঈদ উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৫ আগস্ট ২০১৮

 আবার ঈদ উৎসব

কান্না-হাসির পরস্পর সহাবস্থানের বাস্তবতা মেনে নিয়ে চলছে ঈদ উৎসবের প্রস্তুতি। কেনাকাটা, সাজসজ্জা, ঘরে ফেরার তাগিদ। রেলওয়ে ও বিআরটিসি বাসের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। তিন-চার দিনের ছুটি কাটাতে গ্রামের দিকে হন্যে হয়ে ছুটছে মানুষ। জনবহুল ঢাকা তখন সুনসান ফাঁকা। ট্রাফিক জ্যাম নেই, হকার রিক্সাওয়ালার হাঁকডাক নেই। এমন ঢাকা চিরস্থায়ী হোক- এ আকাক্সক্ষা দানা বাঁধতে না বাঁধতেই আবার কোলাহল, আবার যানজট, উর্ধশ্বাস ছুটে চলা। এই দৃশ্য আর দৃশ্য বদলে একটা বিষয় পরিষ্কার- ঢাকার মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে আশি ভাগ খেটে খাওয়া মানুষ ঢাকায় বাস করে অনিচ্ছায়। শুধু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। এ প্রয়োজন যদি তারা নিজের গাঁয়ে বা পাশের শহরে মেটাতে পারত তাহলে ঢাকা শহরে পা বাড়ানো না। তাদের মানসিক প্রশান্তির জায়গা নিজ গ্রাম, যেখানে রয়েছে বুড়ো মা-বাবা আর ছোট ভাই-বোনেরা। তাদের সাধ্য নেই এদের ঢাকায় এনে একসঙ্গে বাস করার। মনটা তাই স্বাভাবিকভাবে পড়ে থাকে আপনজনের কাছে। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের বিরক্তি যতই বাড়ুক ঢাকা শহরে এদের উপস্থিতি অস্বীকার করার বাস্তবতা নেই। কারণ শহরটি শুরু থেকেই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। নানা ধরনের কূপম-ূকতা এ শহরকে পরিণত করছে একটি অচলায়তন বদ্ধ শহরে। শহর ছেড়ে ঈদের আগে রাস্তায় পা বাড়ানো ও এক বিড়ম্বনা। ঈদের অন্য আনুষঙ্গিকতার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাস্তা মেরামতের মহাযজ্ঞ। এখন মানুষ মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, ঈদের আগে রাস্তা মেরামতের দক্ষযজ্ঞ চলবে আর যোগাযোগমন্ত্রী প্রতিদিন রাস্তায় নেমে তা তদারক করবেন। এও এখন ঈদ প্যাকেজের অংশ। অর্থনীতিবিদদের অনুমান, এবার ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার হবে পঞ্চান্ন হাজার কোটি টাকার বেশি। তাদের মতে, ষোলো কোটি মানুষের মধ্যে বারো কোটি পঞ্চাশ লাখ মানুষের ঈদ বাজারে ঢোকার সামর্থ্য নেই। ঈদের বাজার থেকে শুরু করে ভ্রমণ ইত্যাদিতে অংশ নেন তিন কোটি পঞ্চাশ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে ধনীর সংখ্যা বেয়াল্লিশ লাখ। ঈদ বাজারের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ লেনদেন হয় এদের কেনাকাটায়। এদের মধ্যে এক লাখের বেশি মানুষ কেনাকাটার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা পছন্দসই অন্য দেশে ছোটেন। এদের গড় খরচ পঞ্চাশ হাজার করে ধরলেও মোট খরচ পঞ্চাশ কোটিতে দাঁড়ায়। দেশের বাজারের এক লাখ টাকা দামের শাড়ি কিংবা দুই লাখ টাকা দামের ল্যাহেঙ্গা কেনার ‘গর্বিত’ রেকর্ড এরাই করতে পারেন। যাদের সে ক্ষমতা নেই তারা ভাঙ্গাচোরা সড়ক পেরিয়েই ছুটে যান আপনজনের কাছে, কাজের শহর এ ঢাকা ছেড়ে। সারা বছরের অন্তহীন পথচলার শ্রান্তি মুছে যায় ক’দিনের আনন্দে প্রিয়জনের দ্বারে পৌঁছে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে। পেছনে পড়ে থাকে দুঃসহ জীবন সংগ্রামের স্মৃতি অন্তত ক’দিনের জন্য হলেও। ॥ দুই ॥ ঢাকার ঈদের চেহারা-চরিত্র এখন অন্যরকম। বারো মাসে তেরো পার্বণের শান্ত গ্রামীণ জীবন পেরিয়ে মধ্যবিত্তের বিচরণ এখন নগর জীবনে। ভিন্ন রূপে ফিরেছে পালাপার্বণ। বারো মাসে তেরো না হলেও সাত-আট তো হবেই। কৃষিনির্ভর সমাজে পার্বণের ছুতোয় দেখা হতো একের সঙ্গে অন্যের। বিনিময় হতো মনের ভাব। এখনও তাই। উৎসবকে কেন্দ্র করে কাছাকাছি হওয়া। তবে তা নাগরিক ফর্মে। মিউজিক থেকে ফ্যাশন ট্রেন্ড, কিচেন থেকে টেলিভিশন সবখানে লেগেছে তার ছোঁয়া। ফেস্টিভ মুড এসেছে নগর জীবনে। যে ঈদ সীমিত ছিল ঈদগাহ্ আর কোলাকুলি, সেমাই-জর্দা আর পোলাও-মাংসের টেবিলে, বড় জোর বৈঠকি আড্ডা পর্যন্ত, তার সঙ্গে এখন জড়িয়েছে অনেক কিছু। মধ্যবিত্ত জীবনের আখ্যান তৈরিতে যা অপরিহার্য। একখানা ঈদ সংখ্যা আর একপ্রস্থ পোশাকের সীমানা ভেঙ্গেছে সেই বহু আগে। সিনেমা, নাটক, সঙ্গীত, ফ্যাশন রূপÑ রেসিপি ইন্টেরিয়র কি নেই সেখানে। দর্শকের এক বড় অংশের ফ্যাশন ট্রেন্ড সেট করছে টেলিভিশন। বিশেষ করে ভারতীয় সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকারা। ব্যবসায়ীরা ক্রেতার মন বোঝে। চটজলদি চালু সিরিয়ালের হিট নায়িকার নামে শাড়ি-গয়নার পসরা সাজিয়ে ফেলে। দারুণ কাটতি দেখা দেয়। দেশী বুটিক শপের কর্ণধাররা মন খারাপ করেন। তাদের ব্যবসা সার খায় বিদেশী পণ্যের দাপটের কাছে। কিন্তু করার থাকে না কিছুই। কারণ মুক্তবাজার। তারা ভরসা করেন রুচিশীল ক্রেতার ওপর। ফ্যাশন ক্যাটালগ দেখে বুটিক শপে ছোটার ক্রেতাও কম নয়। নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্টে বিশ্বাসীরা ওখানেই ভিড় জমান বেশি। আরেক দলের উৎসবে তো থাকেই ব্যান্ডের গান। সঙ্গে নাচ, হিপহপ কিংবা ডিস্কো, পিজ্জা হাট বা কেএফসিতে স্পেশাল ডিনার, লং ড্রাইভ বা বন্ধুর আড্ডায় সফট ককটেল পার্টি। এখন শহর বেড়েছে, মানুষ বেড়েছে, পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছে। উৎসবের ধরনও বদলেছে। সুদূর আমেরিকার ডালাস কিংবা কানাডার টরন্টো থেকে প্রবাসী ছেলেমেয়েরা মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দিন শুরু করে। দিনে আরও কয়েকবার কথা হয় তাদের। শেয়ার হয় ঈদের আনন্দ। শরীরী উপস্থিতি না থাকলেও বিশ্বময় ছড়িয়ে যায় তাদের প্রাণের আনন্দ। দেশের সীমানা ভৌগোলিক। জীবনের আনন্দ-বেদনার অনেকখানিই এখন ওয়েবে। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ সবখানে ছড়িয়ে গেছে তা। হারিয়ে যাওয়া ঈদ নিয়ে হতাশা বা স্মৃতি তর্পণ সেকালের তথ্যই দিতে পারে শুধু, সেখানে ফেরার কোন উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। সত্যি বলতে কি বাস্তব জীবনে অন্য কোন মাত্রা নেই এর। ঈদ বা উৎসবের আনন্দ আগের মতোই আছে। আগের প্রজন্মের কাছে তার পাঠ ছিল এক রকম- এ প্রজন্মে তা বদলে যাবে সেই তো স্বাভাবিক। পরিবর্তনকে ধারণ করে চলাই জীবনের লক্ষণ।
×