ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

শ্রদ্ধা ভালবাসায় চিরনিদ্রায় গোলাম সারওয়ার

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১৭ আগস্ট ২০১৮

শ্রদ্ধা ভালবাসায় চিরনিদ্রায় গোলাম সারওয়ার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বরেণ্য সাংবাদিক ও সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে বৃহস্পতিবার বিকেলে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, সমকাল প্রকাশক এ কে আজাদ, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব) এস এম শাহাব উদ্দিন, স্থানীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হক আসলাম, সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, সমকালের নগর সম্পাদক শাহেদ চৌধুরী, প্রধান প্রতিবেদক লোটন একরাম, ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার ইমরান কাদির। গোলাম সারওয়ারের পরিবারের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন তার ভাই গোলাম সালেহ মঞ্জু মোল্লা, জামাতা মিয়া নাইম হাবিব, পুত্র গোলাম শাহরিয়ার রঞ্জন ও গোলাম সাব্বির অঞ্জন। এর আগে দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় সিক্ত হন প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার। দীর্ঘ দিনের কর্মস্থল দৈনিক সমকাল পত্রিকার সহকর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বৃহস্পতিবার সকালে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সমকাল পরিবারের যৌথ আয়োজনে নাগরিক শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে তার মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদসহ সর্বস্তরের মানুষ। শ্রদ্ধা জানাতে এসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আমার বিবেচনায় তিনি ছিলেন বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি যা কিছু বলতেন, বুঝে শুনে বলতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক ছাত্র গোলাম সারওয়ারের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বলেন, শিক্ষকের সামনে ছাত্রের মরদেহ অনেক বেশি বেদনার। গোলাম সারওয়ার আমার সরাসরি ছাত্র ছিলেন। সাংবাদিকতা জগতে তার দীপ্ত পদচারণা আমাকে গর্বিত করে। তিনি নিজ হাতে দুইটি সংবাদপত্র গড়ে তুলেছেন। এটি তার অনেক বড় অবদান। সারওয়ার আজীবন সৎ সাংবাদিকতা করে গেছেন। সাংবাদিকতা জগতে তার নাম স্থায়ী হয়ে থাকবে। ১৪ দলের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। গোলাম সারওয়ারকে নিজের রাজনৈতিক জীবনের ভরসা বর্ণনা করে তিনি বলেন, তিনি যেমন আমাদের প্রশংসা করতেন, তেমনিভাবে অনেক সমালোচনাও করেছেন। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনাকেও ভাল পরামর্শ দিতেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, গোলাম সারওয়ার আমার সমবয়সী ছিলেন। আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। তার চলে যাওয়ায় ব্যক্তি পর্যায়েরও ক্ষতি হলো আমার। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে দলটির সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ ও সেই মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রশ্ন যখনই উঠে আসে-তখন সেই ইস্যুতে এক আপোসহীন কলমযোদ্ধা ছিলেন গোলাম সারওয়ার। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, তিনি সব সময় মানুষের কথা শুনতেন, বলতেন। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কলম ধরেছেন সব সময়। তার মৃত্যুতে সাংবাদিকতা জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তার চিন্তা-চেতনাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলেই তার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানানো হবে। জাসদের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, আজকে আমরা যখন সন্ত্রাস, জঙ্গী ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে চলেছি, তখন তার মতো একজন ব্যক্তির ভূমিকার বড় দরকার ছিল। তিনি শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন গণমাধ্যমের অভিভাবক। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গোলাম সারওয়ারকে কিংবদন্তি হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তিনি শুধু সাংবাদিকই ছিলেন না, সামাজিক ও শিক্ষা খাতেও তিনি যুক্ত ছিলেন। নতুন প্রজন্ম তাকে অনুসরণ করতে পারে। জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরী বলেন, গোলাম সারওয়ার ছিলেন একজন বাতিঘর; যে বাতিঘর কখনও নিভে যাবে না। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার নৈতিকতার বিকাশে তিনি ছিলেন সোচ্চার ও এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সমকালের প্রকাশক ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সংবাদপত্র জগতে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। পরিবারের পক্ষ থেকে বড় ছেলে গোলাম শাহরিয়ার রঞ্জু বলেন, আমার বাবা জীবনের চারটি অধ্যায়; সমকাল, প্রেসক্লাব, পরিবার ও বানারীপাড়া। তিনি এ চারটি অধ্যায়কে সবচোখে দেখতেন। তিনি কখনও কাউকে না করতে পারতেন না। গরিব-দুঃখী মানুষদের পাশে তিনি সব সময় দাঁড়াতেন। তিনি সব সময় একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। সাংবাদিকতাকে এক অনন্য উচ্চতায় দেখতে চাইতেন। আমার বাবা তার কাজকে ধর্মের মতো পালন করতেন। সারা জীবনভর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বাবা বলতেন, আমাদেরও সে বিশ্বাসে বড় করেছেন। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, গোলাম সারওয়ার ছিলেন আমাদের বাতিঘর। তিনি সবসময় পেছন থেকে আলো ছড়িয়েছেন। যে আলো আমাদেরকে শক্তি, সাহস ও উদ্দীপনা জুগিয়েছে। কথাসাহিত্যিক আনোয়ার সৈয়দ হক বলেন, তিনি মানুষকে মূল্যায়ন করতে যথাযথভাবে। যাকে যতটুকু মূল্যায়ন করা উচিত, উনি ততটুকুই দিতেন। তিনি ছিলেন আধুনিক সংবাদপত্রের পথিকৃৎদের একজন। নাট্যজন আতাউর রহমান বলেন, তিনি শুধু বড় সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি একজন বড় সংগঠকও ছিলেন। তিনি পত্রিকার সংগঠক। তিনি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথিকৃৎদের একজন। তার হাত ধরে বহু সাংবাদিক তৈরি হয়েছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, গোলাম সারওয়ার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি সমকালকে একটি পত্রিকা থেকে জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। এ দেশের সংবাদপত্র শিল্পের তিনি চিরঅক্ষয় হয়ে থাকবেন। কবি কামাল চৌধুরী বলেন, তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল মানুষ। তার লেখা, শ্রদ্ধা ও মেধা-মননে মাধ্যমে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন; তা চিরস্মরণীয়। র‌্যাবের পক্ষ থেকে মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, আজকে আমার শ্রদ্ধাভাজন মুরুব্বি চলে গেলেন। দশ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের পরিচয় ছিল। তাকে হারিয়ে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, গণতন্ত্রী পার্টি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামসহ আরও বেশ কিছু সংগঠন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ইটিভির সিইও মনজুরুল আহসান বুলবুল প্রমুখ। জাতীয় প্রেসক্লাবে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা ॥ ৃকেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর গোলাম সারওয়ারের মরদেহ আনা হয় জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়। রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মোঃ সারোয়ার হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, প্রেস সচিব ইহসানুল করীম ও উপ-তথ্যসচিব আশরাফুল আলম খোকন মরহুমের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এ ছাড়া সেখানে প্রবীণ-নবীন সাংবাদিকরা তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, সারওয়ার ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক। অনেক গুণাবলী তাকে শ্রেষ্ঠ মানুষের কাছে নিয়ে গেছে। সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন। দীর্ঘদিন আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। সাংবাদিকদের নানা সমস্যা এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের বিভিন্ন সঙ্কটের সময়ে সমাধানে তার যে উদ্যোগ স্মরণীয়। ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে আমি তার মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করছি। এই সংগঠনের গঠনে তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, ইটিভির সিইও মনজুরুল আহসান বুলবুল, সমকালের প্রকাশক একে আজাদ, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তাফিজ শফি, প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের জ্যেষ্ঠ ছেলে গোলাম শাহরিয়ার রঞ্জন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, সহসভাপতি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমীন, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি মোল্লা জালাল মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এরপর ক্লাব প্রাঙ্গণে নামাজে জানাজা হয়। তৃতীয়বারের মতো জানাজা শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সেখানেই বিকেলে তাকে দাফন করা হয়। গত ২৯ জুলাই অসুস্থ হয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি হন ৭৫ বছর বয়সী সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। অবস্থার অবনতি ঘটলে গত ৩ আগস্ট সিঙ্গাপুর নেয়া হয় তাকে। ১৩ আগস্ট সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ২৫ মিনিটে সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সাংবাদিক।
×