ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে শিশুরা, নেই নিরাপত্তা সরঞ্জাম

দশ বছরের দিপুর সকাল-সন্ধ্যা কাটে ডকইয়ার্ডে

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ১৮ আগস্ট ২০১৮

  দশ বছরের দিপুর সকাল-সন্ধ্যা কাটে ডকইয়ার্ডে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ দশ বছরের দিপুর সকাল-সন্ধ্যা কাটে কেরানীগঞ্জের একটি ডকইয়ার্ডে। যেখানে জাহাজ ও লঞ্চ নির্মাণসহ পুরানগুলোকে নতুন রূপ দেয়া হয়। আর সেখানেই দিপু লেবারদের হেল্পার হিসেবে কাজ করে। স্টিলসহ লোহার পাত টানা, লোহার যন্ত্রাংশ এমনকি পানি ও খাবার এনে দেয়ার কাজও করতে হয় তাকে। সারা দিন এত পরিশ্রম করলেও তার মজুরি নাম মাত্র! ২০০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। বাড়ি বলতে পাশের বস্তির একটি খুপড়ি ঘর। মা ও ছোট বোনকে নিয়েই তার বাস। তার মা স্থানীয় একটি প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করে। তার ৫ বছরের বোনটি সেখানেই মায়ের পাশে থাকে। মা-ছেলের কষ্টার্জিত অর্থে সংসার চলে তাদের। যে বয়সে স্কুলে পড়ার কথা ছিল সে বয়সে লোহার পাত টানতে হচ্ছে দিপুর। ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছে সে। তবে সারাদিন পরিশ্রম করার হেতু এখন আর স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠে না। এজন্যই হয়ত ‘গরিবের আবার লেহাপড়া’ কথাটি ছোট মুখ থেকে সহজেই বেরিয়ে এল। বাবার আদর থেকে বঞ্চিত এই শিশুটি তাদের সংসারের দৈনতা টের পেয়ে মায়ের কষ্ট ভাগ করতে ডকইয়ার্ডে কাজ নিয়েছে। শুধু কি দিপুই এসব ডকইয়ার্ডে কাজ করে? না, তার মতো আরও অনেক শিশু দু’বেলা অন্ন জোগাড়ের আশায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। তাদের একজন আশিক। তার বয়স বারোর কোঠায়। দুই বছর আগে বাবার সঙ্গে ভোলা থেকে এসেছিল কাজের আশায়। কাজ ঠিকই পেয়েছে তারা। আশিকের বাবা পাশের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে আর সে ডকইয়ার্ডে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজ করে থাকে। কখনও প্রপেলার তৈরির কাজ করে আবার কখনও রং করার কাজ। আবার কখনও ভারি লোহার যন্ত্রাংশ টানার কাজও করতে হয় তাকে। নামমাত্র পারিশ্রমিকে এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে কখনও কেটেছে তার হাত কখনও বা পা। তাদের নেই কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অনেক সময় ১০-১৫ ফুট উপরের ঝুলন্ত কাঠের তক্তায় তাদেরকে উঠিয়ে দেয়া হয়। অনেক পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিরও এমন ঝুলন্ত তক্তা থেকে পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙ্গেছে। শিশু হোক বা বয়স্ক এসব ডকইয়ার্ডে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েই গেছে। বুড়িগঙ্গার পাশে গড়ে ওঠা এমন অনেক ডকইয়ার্ডে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য নেই কোন নিরাপত্তা সরঞ্জাম। এমনকি শ্রমিকরা জানেনও না এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কিছু নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরিধান করার বিধানের কথা। মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনায়ও পড়েন অনেকে। এক শ্রমিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে জানান, ‘আমাদের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে মালিক পক্ষের কোন দৃষ্টি নেই। তারা শুধু চায় কাজ আর কাজ। যতই অসুস্থ থাকি না কেন, কাজ না করলে টাকা নেই। অথচ মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়েই কিন্তু আমরা দুর্ঘটনার শিকার হই।’ বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেইফটি, হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন (ওশি)র তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন শিপইয়ার্ড কিংবা ডকইয়ার্ডে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ২০১৭ সালে ১৫ শ্রমিক নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ২২ জনেরও বেশি শ্রমিক। ওশি ফাউন্ডেশন প্রকাশিত বার্ষিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। দুর্ঘটনার কারণ জাহাজ থেকে পড়ে যাওয়া, লোহার পাতের ধাক্কা বা নিচে চাপা পড়া, অগ্নিকা-, এক্সক্যাভাটরের আঘাত এবং বিষাক্ত গ্যাসে আটকা পড়া। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় ৯৫ শতাংশ ইয়ার্ডের মালিক তাদের শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ- হেলমেট, সেফটি জ্যাকেট, বুট ইত্যাদি সরবরাহ করেন না। অন্যদিকে যেসব ইয়ার্ডে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা হয় সেখানকার শ্রমিকরাও এসব ব্যবহারে উদাসীন থাকেন। দেখা গেছে, যেসব শ্রমিক পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং নিরাপত্তা নির্দেশিকা মেনে চলছেন তারা দুর্ঘটনা থেকে মুক্ত। ওশির প্রতিবেদনে বিভিন্ন ইয়ার্ডে শ্রমিকদের হতাহতের পেছনে রাতের বেলায় কাজ করা, সেফটি প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রমিক নিযুক্ত করা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ প্রদানে মালিকপক্ষের অনীহা, শ্রম আইন ও বিধিমালার অপর্যাপ্ত প্রয়োগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অপর্যাপ্ত পরিদর্শন ব্যবস্থা এবং ইয়ার্ড ব্যবস্থাপনার অভাবকে দায়ী করা হয়। জাহাজভাঙ্গা শিল্প এলাকায় কর্মপরিবেশ এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নে ওশির পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়- শ্রম বিধি ২০১৫ অনুযায়ী প্রতিটি ইয়ার্ডে সেফটি কমিটি গঠন ও তা কার্যকর করার ওপর জোর দিয়েছে ওশি ফাউন্ডেশন। সরেজমিনে বুড়িগঙ্গার পাড়ে গড়ে ওঠা এসব ডকইয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, বড়দের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি জাহাজভাঙ্গা কারখানায় শিশুরাও কাজ করছে। তবে প্রথমে এদেরকে শ্রমিকদের জোগালে হিসেবে নেয়া হলেও পরবর্তীতে তাদেরকে কাজ শেখানোর মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে লাগানো হয়। এমনই এক শিশু মহব্বত। মাত্র ৩ মাস হয় তার চাকরির বয়স। আট বছরের মহব্বত তার চাকরির জন্য কোন পারিশ্রমিক না পেলেও দু’বেলা অর্থাৎ দুপুরে ও রাতে অন্তত পেটপুরে খেতে পারে। আপাতত খাবার-পানি টানাসহ ছোট ছোট লোহার যন্ত্রাংশ টানতে হচ্ছে তাকে। তার রাতও কাটে এখানেই। কারণ হিসেবে মহব্বত জনকণ্ঠকে জানায়, ‘কাম মেখা লাগতেছে। তাই রাইতেও এহানেই থাহি। আর বাড়ি যাইয়াও তো কোন কাম নাই। মা কইছে এহানেই থাকবার।’ মহব্বত এখন শিক্ষানবিশ! তাইতো সারাদিন এমনকি রাতেও কাজ নিয়ে ব্যস্ততা তার।
×