ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ

মোটা তাজা কোরবানির পশু ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৮ আগস্ট ২০১৮

মোটা তাজা কোরবানির  পশু ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি

ঈদ-উল-আজহা সমাগত। মুসলমানদের পবিত্র কোরবানির ঈদ। সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রিয় ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো সর্বশক্তিমান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় বিভিন্ন ধরনের গবাদিপশু কোরবানি করা। কোরবানির পশুর গোস্ত প্রোটিন ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে অনস্বীকার্য ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে কিছুদিনের জন্য হলেও দরিদ্র ও সহায়সম্বলহীনদের জন্য। হাদিস শরিফে মোটা তাজা, সুস্থ, সুন্দর পশু কোরবানি করতে বলা হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এতে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মোটা তাজা গরু কোরবানি করতে উৎসাহিত হবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ঈদের আগে অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অনৈতিক পন্থায় গরু মোটা তাজা করা হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে বা ট্যাবলেট খাইয়ে পশু মোটা তাজাকরণ অত্যন্ত গর্হিত কাজ, যা আদৌ শরিয়তসম্মত নয়। কৃত্রিমভাবে মোটা তাজাকৃত গরুর মাংস অবশ্যই দূষিত বা বিষাক্ত, যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে হালাল নয়। এর মাধ্যমে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণাই করা হয়। কারণ, কোরবানির অন্যতম শর্ত সুস্থ ও সবল গরু। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। প্রতারণা করা ও ধোঁকা দেয়ার কারণে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫৬৭, মুসলিম হা/১০২, ছহীহাহ হা/১০৫৮)। অনৈতিক পন্থায় না গিয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক উপায়ে গরুর স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করা যায়। সাধারণত পশুকে প্রাকৃতিক উপায়ে মোটা তাজা ও সুস্থ রাখতে খড়, তাজা ঘাস, খৈল ও ভুসিসহ পুষ্টিকর খাবার দেয়া হয়। এ নিয়ম বিজ্ঞানসম্মত। যুগযুগ ধরে তাই অনুসৃত হয়ে আসছে। এ নিয়মে পশু মোটা তাজা করা হলে ক্রেতা একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, একইসঙ্গে এ ধরনের পশুর মাংস খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকিও থাকে না। মাংস ব্যবসায়ীদের মতে, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রতি বছরই কৃত্রিমভাবে গরু মোটা তাজাকরণের ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে ওঠে এক শ্রেণীর খামারি। ঈদের কিছুদিন আগে রোগাক্রান্ত ও শীর্ণকায় গরু অল্প টাকায় কিনে অধিক হারে মুনাফা লাভের আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী স্টেরয়েড বড়ি, ইউরিয়া ও নিষিদ্ধ পাম বড়িসহ বিভিন্ন ওষুধ খাওয়ানোর এবং স্টেরয়েড ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে গরু মোটা তাজা করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। উদ্দেশ্য একটাই, গরুকে দ্রুত মোটা তাজা করান। মোটা মানেই বেশি গোস্ত, বেশি লাভ। এসবের ব্যবহারে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গরুর ওজন বেড়ে যায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গরুর শরীরে কোন মাংস বৃদ্ধি হয় না। অথচ স্টেরয়েড ওষুধ ব্যবহারের অনেকগুলো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মানুষের বেলায় যেমন দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদী পারিপার্শ্বিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তেমনি পশুর ক্ষেত্রেও একই সম্ভাবনা থেকে যায়। গরু মোটা তাজাকরণের জন্য অনেক উচ্চ মাত্রায় স্টেরয়েড খাওয়ানো হয়ে থাকে। এতে প্রাণীটির স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, ভাষাহীন, প্রতিবাদহীন অবুঝ পশুগুলো এভাবে বিবেকহীন মানুষের কাছে হয়ে পড়ে অসহায়। আর এ ধরনের পশুর মাংস খাওয়াও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর। স্টেরয়েড ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে গরুর দেহ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। তার দেহের চর্বি কোষগুলো বাড়ে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশুর হৃৎপি-, কিডনি ও যকৃৎ, কমে যায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। অনেক সময় এসব ওষুধ সেবনে পশু হার্ট এ্যাটাক হয়ে মারাও যেতে পারে। এই জাতীয় গরুর গোস্তে অধিক পরিমাণ চর্বি বা কোলেস্টেরল থাকে, যা নিয়মিত গ্রহণ করলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। যেমন উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধমনী চিকন হয়ে হৃদরোগ এমনকি ব্রেন স্ট্রোকও হতে পারে। শরীরের ওজন বাড়ে, ফলে এ ধরনের জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। কৃত্রিমভাবে মোটা তাজা করা এ ধরনের পশুর মাংস খেলে মানবদেহে অবশ্যই তার প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীরা গর্ভাবস্থায় দীর্ঘদিন এ গোস্ত খেলে বাচ্চার ওপরও এর প্রভাব পড়ে। স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা পশুর গোস্ত হয়ত দু-এক দিন খেলে কিছু হবে না। কিন্তু নিয়মিত খেলে, কিংবা অভ্যাসে পরিণত হলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মানুষের ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি থাকে। এমনকি দীর্ঘক্ষণ উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করলেও এর ক্ষতিকর মাত্রা কমে না। অনেকে আবার এই গোস্ত ফ্রিজে রেখে দেন, মাসের পর মাস খাবেন বলে। এতে ঝুঁকি আরও বাড়ে। কোরবানির সময় মানুষ বেশি বেশি গোসত খায়। অনেকেই মনে করেন কোরবানির পশুর গোসত খেলে কোন ক্ষতি হয় না, যা একেবারেই ভুল ধারণা। কোরবানির সময় আমরা প্রচুর রোগী পেয়ে থাকি, বিভিন্ন হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যা বাড়ে। বেশি গোস্ত খেয়ে পেটের পীড়া, হৃদরোগ এমনকি স্ট্রোক হয়ে প্রচুর রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। আজকাল নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যে প্রচুর ভেজাল দেয়া হচ্ছে, যা খেয়ে মানুষের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সারসহ অনেক রোগ বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন ভেজাল, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগকৃত গরুর গোস্ত। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতারও অভাব রয়েছে। সুস্থ থাকার জন্য রেড মিট বা লাল মাংস ত্যাগ করতে হবে অথবা কম খেতে হবে। নিয়মিত প্রচুর গোস্ত খাওয়া অনুচিত। কেবল গরুই নয়, মহিষ, খাসির গোস্তের মধ্যেও প্রচুর ক্ষতিকর চর্বি যেমন ট্রাইগি সারাইড, এলডিএল, ভিএলডিএল ইত্যাদি থাকে। সেগুলোও ত্যাগ করতে হবে। চর্বি জাতীয় খাদ্য যত পরিত্যাগ করা যাবে, ততই শরীর সুস্থ ও সবল থাকবে। আসুন জেনে নিই ক্ষতিকারক ওষুধ খাওয়ানো মোটা তাজা গরু চেনার উপায়। অতিরিক্ত স্টেরয়েড ট্যাবলেট খাওয়ানো বা ইনজেকশন দেয়া গরুর পুরো শরীরে পানি জমে মোটা, নাদুসনুদুস দেখাবে। পেট বেশি বড় মনে হবে, পেট বুক থেকে নিচের দিকে নেমে থাকবে, বেলুনের মতো মনে হবে। এসব গরুর পেছনের দিকে উরুর পেশীবহুল জায়গায় আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে তা দেবে গর্তের মতো হবে এবং আঙ্গুল সরিয়ে নেয়ার পরও কিছুক্ষণ তা বিদ্যমান থাকবে। বাইরে থেকে মাংস মনে হলেও এখানে মাংসের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে পানি থাকে। পশুর উরু অনেক মাংসল মনে হবে। পাগুলো মনে হবে অনেক পাতলা বা শুকনো। স্টেরয়েড খাওয়ানোর ফলে গরু অস্বাভাবিক মোটা হয়। কিন্তু দুর্বল ও অসুস্থতার কারণে সবসময় নীরব ও নির্জীব থাকে, নড়াচড়া কম করে, অলস প্রকৃতির হয়, কম আওয়াজ করে, ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না, কম শক্তিশালী হয়। এমনকি খাবারও খেতে চায় না, তাকে আঘাত করলেও নড়াচড়া করতে চায় না। অন্যদিকে প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মোটা তাজাকৃত গরুর স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। মাথা উঁচু, কান খাড়া, শরীর টানটান, তীক্ষ্ম থাকবে। গরুগুলোর প্রাণোচ্ছল ও প্রাণচাঞ্চল্যপূর্ণ চটপটে ভাব থাকবে, দ্রুত হাঁটাচলা ও স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করবে। ভারি আওয়াজে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকবে, তেজি ও গোঁয়ার প্রকৃতির হবে, এমনকি গুঁতো দিতেও উদ্যত হবে। কোরবানি দেয়ার বেলায় অনেক উচ্চাভিলাষী মানুষের মাঝে একটা প্রতিযোগিতার ভাব থাকে যে, কে কত বড়, কত দামী গরু কোরবানি দিতে পারেন। অনেকেই আবার বড় আকৃতির মোটা তাজা গরু কিনে কোরবানিকে ভোগের উৎসব এবং প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় পরিণত করেছেন। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তা সম্পূর্ণ অনুচিত। কারণ কোরবানির অর্থই হলো, আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ স্বীকার করা। অহঙ্কার, অনাচার ও আত্মম্ভরিতা বর্জনই স্রষ্টার নির্দেশিত কোরবানির শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, শুধু মোটা তাজা, বড়, হৃষ্টপুষ্ট গরু, মহিষ কোরবানিতে যেমন স্বার্থকতা নেই, তেমনি অসদুপায়ে অর্জিত টাকায় কোরবানি করলে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনেরও কোন সম্ভাবনা নাই। তাই কোরবানির পশু নির্বাচনের সময় মোটা তাজা গরু কেনার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী, কম মোটা, সুন্দর শারীরিক গঠন ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর পশুই কেনা উচিত। বেশি দামী, অস্বাভাবিক, বিষাক্ত গরু না কিনে কয়েকটা সুস্থ গরু কোরবানি দেয়াও ভাল। প্রশাসনের উচিত পশুর হাটগুলোতে তদারকি করে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগে মোটা করা পশু চিহ্নিত করা। চিকিৎসকেরা যেমন দীর্ঘমেয়াদী স্টেরয়েড গ্রহণকারী রোগী দেখেই চিনতে পারেন, ঠিক তেমনি অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকেরাও এ ধরনের স্টেরয়েড খাওয়ানো পশু দেখেই শনাক্ত করতে পারবেন। অনৈতিকভাবে স্টেরয়েড বা হরমোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া উচিত, এমনকি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। মৎস্য ও পশুসম্পদ আইনে (২০১০) স্পষ্ট উল্লেখ আছে, পশুকে এ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন বা ক্ষতিকর স্টেরয়েড খাওয়ানো যাবে না। তবে সুস্থ-সবল গরু নিশ্চিত করা যেমন প্রশাসনের দায়িত্ব, তেমনি জনগণেরও মনে রাখা উচিত, খুব সুন্দর মোটা তাজা গরুর প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে সুস্থ স্বাভাবিক এমনকি কম মোটা বা ছোট, শুকনা গরু কোরবানি করা ও তার গোস্ত খাওয়া অনেক নিরাপদ। লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×