ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পারতারিজে

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ১৮ আগস্ট ২০১৮

পারতারিজে

নাসরীন মুস্তাফা ॥ এক ॥ অদ্ভুত ঘরটার ঠিক মাঝখানে খাটিয়াটা রাখা। তার উপরে বসে আছেন তিনি। মাদার তেরেসার দেশের মানুষ তিনি, আলবেনিয়ান। মুখের হাসিটায় কেবল মিল আছে মাদার তেরেসার সাথে। সাদা ধবধবে চুলগুলো এলোমেলো ছড়ানো। নরম সুতির ঢিলেঢালা ম্যাক্সি টাইপের পোষাক পরা। মুখের চামড়ায় অনেক অনেক ভাঁজ। কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে আছেন তুলি, তাতে রং মাখানো। খাটিয়ার সামনে রাখা ইজেলে আটকানো বিশাল এক ক্যানভাস। এখনো কোন দাগ নেই, একটাও না। এনকেলিদা হোক্জাহ্। আলবেনিয়ান কায়দায় মাথা ঝাঁকালেন। এর মানে হচ্ছে, হ্যাঁ। তিনিই এনকেলিদা হোক্জাহ্। ছবি আঁকেন। তবে বিচিত্র সে ছবি। পুনর্জন্মে কে কি রকম জীবন পাবে, সেই ছবি আঁকেন তিনি। হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা ডেসমন্ড ওজাও নাকি দেখতে চেয়েছিলেন পরের জন্মে তিনি কেমন হবেন। ক্যানভাসে ফুটে উঠেছিল খুব রাগি এক দাঁড়কাকের ছবি। ডেসমন্ড ওজাও মামলা করেছিলেন খুব রেগে। নিজেকে দাঁড়কাক রূপে দেখতে কারো কী ভালো লাগে? অনেক দেশেই পুনর্জন্মের বিশ্বাস এখনো অটুট। কাউকে যদি বলা হয়, মৃত্যুর পর সে আবার নতুন একটা জীবন পাবে, পাবেই পাবে, তবে সে তো খুব কৌতুহলী হয়ে উঠবে। জানতে চাইবে, পরের জীবনটা কেমন হবে। এই জীবনে যা পেলাম না, তা যেন পরের জন্মে হাতছাড়া না হয়ে যায়। সবার কপাল তো আর ডেসমন্ড ওজাও-এর মতো হয় না যে দাঁড়কাক দেখতে হয়। নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট পরজন্মে প্রিন্ম হ্যারির মতো চেহারা পেয়েছেন দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। এনকেলিদা হোক্জাহ্-কে আস্ত একটা বোয়িং বিমান উপহার দিয়েছিলেন সেই খুশিতে। নিজের ছবিটা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে নিয়ে গেছেন নিজের দেশে। একবার এক ট্যাক্সি ড্রাইভার দেখেছিলেন, তিনি হয়ে গেছেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। খুশির চোটে এই জন্মেই যখন তখন ‘হালুম’ ডাকা তার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এনকেলিদা হোক্জাহ্ ফি নেন চড়া, ট্যাক্সি ড্রাইভার তার চেয়েও বেশি দিয়েছিলেন একদম না ভেবে। পুনর্জন্মের ছবি আঁকার আগে এনকেলিদা হোক্জাহ্ এক ফোঁটা পানিও খান না। চুল আঁচড়ান না। কারর সঙ্গে কথা বলেন না। যে ঘরটায় ছবি আঁকা হয়, তার কোন জানালা নেই। ছাদের কাছে চার দিকে চারটা ঘুলঘুলি, তা দিয়ে চাঁদের আলো আসে কেবল। ঐটুকুন আলোতেই তিনি আঁকতে শুরু করেন। ঝড়ের মতো তুলি চলে আর শব্দ হয় নানা রকমের। এনকেলিদা জোরে জোরে শ্বাস নেন, বিড়বিড় করে কেবলি বলেন ‘পারতারিজে’ শব্দটা। আর এসবের সঙ্গে তুলির আওয়াজও যেন তাল দিতে থাকে। নাকি তার হাতে ধরা তুলিটাও কথা বলতে শুরু করে! সে কথার অর্থ আর কেউ না বুঝলেও এনকেলিদা ঠিকই বোঝেন। কেননা ছবি আঁকা শেষ হলে তিনি তুলিতে চুমু খান। তারপর লুটিয়ে পড়েন খাটিয়ার উপর। সবশেষ ‘পারতারিজে’ শব্দটা বলতে গিয়ে গোঙানির মতো শব্দ বের হয় তার বুকের ভেতর থেকে। এরপর কেবলি লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়ার শব্দ। সুনামির সময় সাগরে যেমন শব্দরা ছুটে বেড়ায় পাগলের মতো, সেসব যেন সেরকমই। ॥ দুই ॥ এনকেলিদা হোক্জাহ্-এর বাড়িটার আশপাশের জায়গার নামই হয়ে গেছে পারতারিজে এভেন্যু। ট্যাক্সিওয়ালাকে কেবল পারতারিজে বললেই এখানে এনে ফেলে। পারতারিজে আলবেনিয়ান শব্দ। এর অর্থ কি হতে পারে, আগেই আন্দাজ করেছিল ইউসুফ। পুনর্জন্ম কী? ঠিক তাই। এনকেলিদা হোক্জাহ্-এর সহকারী বা ম্যানেজার টাইপের লোকটা রসকষহীন ভাব নিয়ে বলেছিল অর্থটা। মনে হয়, এখানে যারা আসে, সবাই জানতে চায় শব্দটার অর্থ। বলতে বলতে বেচারার বিরক্তি ধরে গেছে। ইউসুফের পালক মা জুলিয়া পারতারিজে বলতে অজ্ঞান। কবে নাকি এক বান্ধবীর সাথে এসেছিলেন। নিজের চোখে দেখেছেন, পুনর্জন্মে তার সেই বান্ধবীটা দক্ষিণ ভারতের এক রাজ্যের রাজকন্যা হবেন। রুপানজেলের মতো চুল থাকবে, সেই রকম। ইউসুফ এসব মোটেও বিশ্বাস করে না। তবে জুলিয়া যখন করুন স্বরে বললেন, বাবা ইউসুফ! এই আমার শেষ আবদার। মানা করিস্ না বাপ। জুলিয়ার শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে ক্যান্সার। এখন বেঁচে থাকার জন্য খুব কম দিন হাতে। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দেওয়ার পর জুলিয়াই বলেছিলেন, এনকেলিদা হোক্জাহ্-এর কাছে গিয়ে নিজের পুনর্জন্মের খবরটা জেনে নিতে চান। কয়েকবার বলেছেনও, পরের জন্মে ইউসুফ যদি তার পেটের সন্তান হয়, তবে বেশ হবে! আসলেই বেশ হবে। জুলিয়ার তো ইউসুফ ছাড়া আর কেউ ছিল না। আর ইউসুফের তো ছিল না আরও অনেক কিছু। না বাড়ি, না ঘর, না কোন দেশ। ফিলিস্তিন নামের একটি দুঃখিনী জনপদে জন্ম হয়েছিল ওর। এগারো বছর বয়সে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ফেলেছিল বোমার আঘাতে। ওদের দেশ দখল করে নেয়া ইজরায়েলিরা প্রতিদিন এভাবেই কমিয়ে দেয় ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা। ইউসুফকে দত্তক নিয়েছিলেন রেডক্রসের এক কর্মী। জুলিয়া নামের এক মায়াবতী নারী ইউসুফকে মায়ের স্নেহে বড় করে তোলেন। সবই ঠিকঠাক চলে, কেবল কোন কোন রাতে ইউসুফের পায়চারি বেড়ে যায়, জুলিয়ার হাত ধরে বলতে থাকে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশ, পতাকা, মানচিত্র, পাসপোর্ট—-এরকম শব্দ কুলকুচির মতো ছুটতে থাকে ইউসুফের মুখ দিয়ে। জুলিয়া ছাড়া আর কেউ ওকে শান্ত করতে পারে না, কেউ না। ॥ তিন ॥ সাদা ক্যানভাসটায় এনকেলিদা হোক্জাহ্ কী আঁকবেন আজ? ইউসুফের হাত ধরে চাঁদের আলোর অন্ধকারে চুপ করে বসে আছেন জুলিয়া। ‘পারতারিজে’ ঝড় উঠেছে এনকেলিদা হোক্জাহ্-এর মুখে, হাতের তুলিতে। জুলিয়া বেশ কয়েকবার হেঁচকির মতো করেছেন। কষ্ট হচ্ছে হয়তো। ইদানীং খুব কষ্ট হতে থাকে শরীরে। সারা রাত কষ্টে ছটফট করেন। ঘুম আনার আর ব্যথা তাড়ানোর গাদা গাদা ঔষুধ খেয়ে ঘুম আনতে হয়। কতক্ষণ পরে এনকেলিদা হোক্জাহ্ খাটিয়াতে লুটিয়ে পড়লেন, বলতে পারবে না ইউসুফ। এরও অনেকক্ষণ পর এনকেলিদা হোক্জাহ্-এর সহকারী বা ম্যানেজার টাইপের লোকটা সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। সেই আলো জ্বলে উঠলো ক্যানভাসের ঠিক উপরে। তখন জুলিয়া ছুটে গেল সামনে। ক্যানভাসের ছবিটা দেখতেই হবে যে! ॥ চার ॥ লাল রক্তের সাগরে উঠে দাঁড়ানো এক মানুষ। তার চোখে পুরু কাল চশমা। ডান হাতের তর্জনী উদ্ধত। আকাশ ছুঁয়ে দেয়া উচ্চতায় তাঁর কাঁধ, সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর বসছে, উড়ছে, উড়ে আসছে বসবে বলে। জুলিয়া খুব ভালো করে চেনেন এই উচ্চতাকে। ১৯৭৫ সালে, তিনি যখন ফিলিস্তিনি ইউসুফকে বুকে টেনে নেন, তখনকার কথা। ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ সংগ্রাম করছে। তারা সবাই জানতো, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নামের একটি দেশের জন্ম হয়েছে কয়েক বছর আগে। শুরু থেকেই দেশটির জনক বলে দিয়েছেন, ফিলিস্তিনীরা আমাদের বন্ধু। আসলে বিশ্বের সব অত্যাচারিত মানুষই আমাদের আপনজন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল এই মানুষটির জন্য। ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’-এই কথাটি বলে সেই মানুষ তার দেশের মানুষকে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস দিতে পেরেছিলেন। আগস্ট মাসের ১৫ তারিখে ছিল, মনে আছে। আকাশ সমান মানুষটাকে রাতের অন্ধকারে চিরতরে নিভিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুরা। এর পর সেই দেশটা উঠে দাঁড়ানোর কত রকম যুদ্ধই না করছে। জুলিয়া অনেক বার ইউসুফকে বলেছেন সেই মানুষটার কথা। তাঁর দেশের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে ডাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে। জুলিয়ার উচ্চারণে পুরো নামটা ঠিক মতো আসে না বলে নিজের মতো করে বলেন, মাই ফ্রেন্ড, আওয়ার ফ্রেন্ড, ফ্রেন্ড অব হিউম্যানিটি। ক্যানভাসে উঠে আসা সেই তর্জনী উড়িয়ে দেয় জুলিয়ার সব ভয়। পরের জন্মে জুলিয়া কি ওরকম তর্জনী উঠিয়ে হাঁক দিতে পারবেন, ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’! তখন সত্যিই কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না, কাউকে না। এমনকি ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের যেখানে যত মার খাওয়া মানুষ আছে, তারা তখন দিব্যি আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস পেয়ে যাবে। ॥ পাঁচ ॥ কয়েক মাস পর জুলিয়ার মৃত্যু হলে ইউসুফ ঠিক করে, বেরুতে হবে। কোথায় যে দেখা মিলবে সেই তর্জনীর, তা তো আর এনকেলিদা হোক্জাহ্-এর ছবিতে বোঝা যায়নি। তবে দেখা নিশ্চয়ই মিলবে। পারতারিজে মিথ্যে হতে পারে না, জুলিয়া মৃত্যুর আগে গভীর বিশ্বাসে বলে গেছেন ইউসুফকে। এনকেলিদা হোক্জাহ্-ও বলেছিলেন, পারতারিজে সত্য। পারতারিজে যেন সত্যিই সত্যি হয়।
×