ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মীম নোশিন নাওয়াল খান

উৎসবে আনন্দ -ঈদের গল্প

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ১৮ আগস্ট ২০১৮

 উৎসবে আনন্দ  -ঈদের গল্প

নিতাই কাকা খুব যত্ন করে গরুটাকে গোসল করাচ্ছিল। পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছিল তার আট বছরের মেয়ে মালতী। কাল সকালেই গরুটাকে কোরবানি দেয়া হবে। সামির একটা আপেল খেতে খেতে সেখানে এসে দাঁড়াল। নিতাই কাকাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকা, এই গরুটাকে তো কোরবানিই দিয়ে দেবে। এটাকে এত সুন্দর করে গোসল করাচ্ছেন কেন? নিতাই কাকা হেসে উঠল। গরুর গা ঘষতে ঘষতে বলল, কোরবানি দিয়ে দেব বইলা কি তার যত্ন করা লাগব না? বরং বেশি কইরা যত্ন করা লাগব। তাইলে সে শান্তিতে যাইতে পারব। সামির মাথা দুলিয়ে বলল, ও, আচ্ছা। ভেতর থেকে আম্মুর ডাক শোনা গেল। আম্মু সামিরকে ডাকতে ডাকতে বাইরে এসে বলল, তুমি এখানে? কতক্ষণ ধরে খুঁজছি! চলো চলো, দুপুরের খাবার খেয়ে নেবে। সামির নাক-মুখ কুঁচকে বলল, এই বেলায়ও কি মাছ রান্না হয়েছে আম্মু? আম্মু বলল, হ্যাঁ। সামির নাক-মুখ আরও কুঁচকে ফেলে বলল, আমি কতবার বলি, আমি মাছ খাব না। তোমরা শুধু মাছই রান্না কর! আম্মু বলল, কাল থেকে তো শুধু মাংসই খাবে। এখন এত মাংস খেলে তখন আর মাংসের রুচি হবে না। এক মাস তো মাছই খাওয়া হবে না। এখন মাছ খাবে। ব্যস! আম্মুর কথার পর মালতী তার বাবার শার্ট টেনে ধরে বলল, বাপজান, ঈদের দিন থেইকা ক’দিন অনেক মাংস খামু? সত্য সত্যই? নিতাই কাকা মেয়েকে ধমকে উঠে বলল, চুপ থাক তো। তুই এইখানে দাঁড়ায় আছস ক্যান? যা, বাড়ি যা! মালতী মাথা নিচু করে ফেলল। সামিরের আম্মু বলল, আহা! মেয়েকে বকছ কেন নিতাইদা? কী-ই বা এমন বলেছে? নিতাই কাকা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। গরুটাকে গোসল করানোয় মনোযোগ দিল। কয়েক সেকেন্ড পর মালতী আবার বলল, বাপজান, মিনা, সীমা, রতন- ওরা সবাই কইতাছে, কোরবানির দিন কত্ত মাংস দিব। পরের কয়টাদিন অনেক মাংস খাইব। আমরা খামু না বাপজান? মিনা, সীমা, রতন- এরা সবাই মালতীরই সমবয়সী। তারা একসঙ্গেই থাকে, একসঙ্গেই খেলাধুলা করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা মাংস খাওয়ার কথা বললে মালতীর মনেও সেই আশা উঁকি দেয়। নিতাই কাকা এবার অবশ্য বকল না। মালতীর চুলে হাত বুলিয়ে বলল, আমাগো গরুর মাংস খাইতে নাই, মা। মালতী বাবার মুখের দিকে তাকাল। কিছু বলল না। এক ছুটে বাড়ির দিকে চলে গেল। সামির, তার আম্মু আর নিতাই কাকা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ঈদের দিন সকাল থেকেই শুরু হলো কোরবানির প্রস্তুতি। সেই লম্বা-চওড়া লাল গরুটা কোরবানি দেয়া হলো। মাংস কাটাকাটি শুরু হলো। মিনা, সীমা, রতন, মালতী, সামির- সবাই দাঁড়িয়ে মাংস কাটা দেখতে লাগল ভীষণ আগ্রহ নিয়ে। তবে মালতীর মুখের মলিনভাব কাররই চোখ এড়াল না। মাংস কাটাকাটি চলার সময়ে হঠাৎ সামিরের আম্মু বাড়ির কয়েক বছরের পোষা ছাগলটাকে নিয়ে এসে দাঁড়াল। সামিরের আব্বুকে বলল, এটাও কোরবানি দিতে হবে। আব্বু অবাক হয়ে বলল, এটাকে তো কোরবানি দেয়ার কথা না! এটা তো বাড়ির ছাগল! সামির এসে চিৎকার করে উঠল। আর্তনাদ করে বলল, এটাকে কেন কোরবানি দেবে আম্মু? আমি এই ছাগলটাকে প্রতিদিন পাতা খাওয়াই। এটাকে আমরা কত্তদিন ধরে পুষছি! এটাকে কেন কোরবানি দেবে আম্মু? আম্মু উত্তর দিল না। আব্বুকে ডেকে নিয়ে কিছু একটা বলল। আব্বু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আচ্ছা। ঠিক আছে। ছাগলটাকে কোরবানি দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। সামির কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, কেন এই ছাগলটাকে কোরবানি দেবে আম্মু? তুমি দরকার হলে আরেকটা ছাগল কিনে আনতে? আম্মু হাঁটু গেড়ে সামিরের সামনে বসলেন। দুহাত দিয়ে তার চোখ মুছে দিলেন। তারপর বললেন, কোরবানি মানে ত্যাগ, সামির। হাট থেকে একটা ছাগল কিনে এনে জবাই করে দেয়ার চেয়ে নিজের পোষা ছাগলটাকে কোরবানি দিতে বেশি কষ্ট হয়। এতে ত্যাগের মানসিকতা তৈরি হয়। দেখ সামির, গরুটাকে কোরবানি দেয়া হয়ছে। তুমি মজা করে গরুর মাংস রান্না খাবে। কিন্তু মালতী তো গরুর মাংস খায় না। ও মাংস খেতে পারবে না। তুমি মজা করে মাংস খাবে আর মালতী মন খারাপ করে বসে থাকবে। সেটা ভাল লাগবে তোমার? সামির মাথা নাড়িয়ে বলল, উঁহু। আম্মু বলল, ঈদের দিন সবাইকে খুশি থাকতে হয়। মালতী যদি মন খারাপ করে থাকে, তাহলে ঈদ হবে? সামির আবার মাথা নেড়ে বলল, উঁহু। আম্মু বলল, তাহলে বলো, মালতীকে খুশি রাখতে, ওকেও মাংস খাওয়াতে যদি এইটুকু ত্যাগ করতে হয়, সেটা কি করা উচিত না? সামির কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হুঁ। আম্মু তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, এই তো আমার সোনা ছেলে। যাও তো, মালতীকে ডেকে আন। সামির ছুটে গিয়ে মালতীকে ডেকে আনল। আম্মু তাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, মালতী, বাড়ির ছাগলটা কোরবানি দিচ্ছি। এই ছাগলের মাংস পুরোটা তোমার। তুমি, তোমার বাবা আর মা মিলে খাবে। আর কেউ না। মালতী চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যই? আম্মু হেসে ফেলে বলল, একদম সত্য! মালতী বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারল না। তবে যখন সে বুঝতে পারল আসলেই ঘটনাটা সত্যি, তখন সে সামিরের আম্মুকে আরেকবার খুশিতে জড়িয়ে ধরল। তারপর লাফিয়ে হাততালি দিতে শুরু করল। এরপর বলল, কাকি, আমি শুধু বাপজান আর মারে নিয়া মাংস খামু না। আমরা সবাই মিলা খামু। সামির দাদা, মিনা, সীমা, রতন- সব্বাই। আম্মু বলল, না মালতী, ওরা তো সবাই গরুর মাংস খাবেই। এটা তুমিই খাও। মালতী বলল, না কাকি। সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করার মধ্যেই তো ঈদের আনন্দ, তাই না কন? আমি একা একা খাইলে কি আমার ঈদ হইব? আম্মু হেসে ফেলল। মালতীও ফিক করে হেসে ফেলল। আম্মু দুই হাত দিয়ে মালতী আর সামিরকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরল বুকে। ভিকারুননিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজ একাদশ শ্রেণী (ইংলিশ ভার্সন)
×