সুবল বিশ্বাস ও জাফরুল হাসান ॥ আমার প্রথম জন্মদিন ছিল ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। মায়ের মুখে শুনেছি বাবা ঢাকা থেকে নতুন জামা নিয়ে আসবে। নতুন পোশাক পরে ধুমধাম করে আমার প্রথম জন্মদিন পালন করা হবে। কিন্তু বাবা আর ফিরে আসেননি। ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আমার বাবা মারা যায়। তখন হয় তো কিছুই বুঝিনি। আস্তে আস্তে বড় হওয়ার পর সব বুঝতে পেরেছি। এ বছর ১ সেপ্টেম্বর আমার ১৫ বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু এত বছর পার হলেও বাবাসহ হতাহাতদের অকাল মৃত্যুর কোন বিচার হয়নি। আজও অপরাধীরা নির্ভয়ে এ দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের সঠিক বিচার যেন নিশ্চিত করেন। তাহলে এই ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের আত্মা শান্তি পাবে। এভাবে কথাগুলো বললেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগ নেতা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত লিটন মুন্সির মেয়ে নুসরাত জাহান মিথিলা।
শুধু মিথিলার পরিবার নয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় মাদারীপুরের নিহত ৪ পরিবারসহ আহত ৩ পরিবারের সদস্যরা ভাল নেই। ১৫ বছরেও এসব পরিবারে শোক ও আতঙ্কের ছায়া কাটেনি। একই ঘটনায় আহতরা পঙ্গুত্ব নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগ নেতা নিহত লিটন মুন্সির মা আছিয়া বেগম ও বাবা আইয়ুব আলী মুন্সির একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজও তারা কষ্টে দিন কাটায়। লিটন মুন্সির বাড়ি ফিরে মায়ের অপারেশন করানো কথা ছিল। তাও সম্ভব হয়নি। সেই কষ্টে মা আজও চোখের জল ফেলেন। নিহত লিটন মুন্সির বাবা আইয়ুব আলী মুন্সী ও মা আছিয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে একেবারে শেষ হয়ে গেছি। এখন আমাদের চোখের জল ছাড়া আর কিছুই নেই। সরকারের কাছে আমাদের ছেলে হত্যার বিচার চাই।’ নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মিথিলা প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছে। এছাড়াও ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট বাসা ও রোজার সময় ৫ লাখ টাকা সরকারী ভাবে পেয়েছে।
তাই সরকারের কাছে তারা কৃজ্ঞতা প্রকাশ করে দ্রুত বিচারের দাবি করেছেন। শুধু লিটন মুন্সিই নয় ওইদিন মাদারীপুরের আরও তিন জন নিহত হন। এরা হলেন- শ্রমিক লীগ নেতা নাসির উদ্দিন। তার বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামারপোল গ্রামে। নাছিরউদ্দিন থাকতেন ঢাকার হাজারীবাগে। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এক সময়ে হাজারীবাগের শ্রমিক লীগের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। নাসির ছিল আওয়ামী লীগের অন্ধভক্ত। তাই আওয়ামী লীগের মিছিল, মিটিং, কিংবা সমাবেশ হলে তাকে কেউ বেঁধে রাখতে পারত না। মিটিং, মিছিলের আগে থাকতেন, স্লোগান দিতেন। গ্রেনেড হামলায় নিহত অপর যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। তার বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর গ্রামে। গ্রেনেড হামলায় অন্যদের মধ্যে নিহত সুফিয়া বেগমের বাড়ি রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামে। ওইদিন মহিলা নেত্রীদের সঙ্গে প্রথম সারিতেই ছিলেন সুফিয়া বেগম। নিহত এই সুফিয়া সপরিবারে ঢাকায় থাকতেন। অপরদিকে কালকিনি পৌরসভার বিভাগদী গ্রামের মোহাম্মাদ আলী হাওলাদারের ছেলে হালান হাওলাদারের একটি পা গ্রেনেড হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হালান হাওলাদার বলেন, ‘২১ আগস্ট অনেক শখ করে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনতে যাই। হাজারও মানুষ ঠেলে ঠেলে মঞ্চের খুব কাছাকাছি আসতেই বোমার বিকট শব্দ হয়। তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে দেখি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এখনও দুই হাত পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক স্পিন্টার নিয়ে যন্ত্রণায় বেঁচে আছি। কালকিনির ঝাউতলা গ্রামের ওয়াহেদ সরদারের ছেলে সাইদুল হক সরদার শরীরে স্পিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাকর জীবন-যাপন করছেন। বর্তমানে চোখে ঝাপসা দেখছেন। বাঁচার তাগিদে বিভিন্ন কাজ কর্ম করেও ভাল কিছু করতে না পারায় মালেশিয়ায় যান। শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে বিদেশ গেলেও শরীরে স্পিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে সেখানেও কিছু করতে পারেননি। ফিরে আসতে হয়েছে দেশে। সাইদুল হক সরদার বলেন, ‘মহাসমাবেশ শুরু হয়। আমি ছিলাম অনেক পেছনে। শেখ হাসিনাকে দেখার জন্য আস্তে আস্তে মঞ্চের ১০ থেকে ১২ হাত দূরত্বে চলে আসি। দাঁড়িয়ে মন দিয়ে নেত্রীর বক্তব্য শুনতে থাকি। বক্তব্য প্রায় শেষ। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শেষ করতে পারেননি তার মধ্যে বোমা ফাটানোর শব্দ। পরপর দুটি বোমা বিস্ফোরণে শব্দ পেলাম। চারদিকে কালো ধোঁয়া। মানুষজনের আর্তনাদ। চিৎকার আর চিৎকার। ছোটাছুটি। আমিও কোন কিছু না বুঝে দৌড় দিতে যাব।