ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এম নজরুল ইসলাম

ইতিহাসের কালো অধ্যায় ॥ ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার চতুর্দশ বর্ষ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২১ আগস্ট ২০১৮

 ইতিহাসের কালো অধ্যায় ॥ ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার চতুর্দশ বর্ষ

যে শরতে বাংলার আকাশের রং বদলে যায়, নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা, সেই শরতেই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা হয়েছে অনেক বেদনার ইতিহাস। আমরা জানি, শরত মানেই তো শুভ্র প্রকৃতি, নদীতীরে কাশ আর ঘরের উঠোনে জাফরানি বোঁটার শিউলি। বাংলার ফুলের বৈচিত্র্য যেমন এই শরত থেকেই দেখা দিতে শুরু করে, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতি কলুষিতও হয়েছে এই শরতে। বাংলাদেশে আগস্ট মাসটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শরতের শুরু মানেই তো আগস্টের মধ্যভাগ। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে, বিগত জোট সরকারের আমলে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গীরা তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছিল একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়ে। জানিয়ে দিয়েছিল, বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠলেও জঙ্গী আদর্শের মৌলবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে বিএনপিকেও ছাড় দেবে না তারা। আর এর ঠিক এক বছর আগে, বিগত জোট সরকারের আমলে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে শেখ হাসিনা আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। গুরুতর আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ সেদিন রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। হতাহত নেতাকর্মীদের আর্তনাদ ও আকুতিতে সৃষ্টি হয়েছিল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। আজ সেই ২১ আগস্ট, ভয়াল দুঃস্বপ্নের দিন। ২১ আগস্ট মানেই গা শিউরে ওঠা, থমকে যাওয়া একটি দিন। যে দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে রচিত হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়। সেদিন দলীয় সভানেত্রীকে বাঁচানোর জন্য ট্রাকের ওপর মানববর্ম রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সেদিনের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান ২৪ আগস্ট। আর, ঐদিন নিহত হন মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, ল্যান্স কর্পোরাল (অব) মাহবুবুর রশীদ, রফিকুল ইসলাম আদা চাচা, সুফিয়া বেগম, হাসিনা মমতাজ রীনা, লিটন মুন্সী ওরফে লিটু, রতন সিকদার, মোঃ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মামুন মৃধা, বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আতিক সরকার, নাসির উদ্দিন সর্দার, রেজিয়া বেগম, আবুল কাসেম, জাহেদ আলী, মমিন আলী, শামসুদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ, ইছহাক মিয়া এবং অজ্ঞাত পরিচয় আরও দু’জন। হামলায় আহতের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, ওবায়দুল কাদের, ড. হাছান মাহমুদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আবদুর রহমান, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, এ্যাডভোকেট রহমত আলীসহ পাঁচ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে অনেকে কিছুটা সুস্থ হলেও পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে অনেক নেতাকর্মীকে। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। কী ঘটেছিল সেদিন? মিছিল উপলক্ষে বিকেল ৪টা থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষে ভরে ওঠে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ। ৫টার দিকে বুলেট প্রুফ গাড়িতে করে সমাবেশস্থলে পৌঁছান শেখ হাসিনা। বক্তৃতায় তিনি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা এবং দেশব্যাপী বোমা হামলা বন্ধে সরকারকে হুঁশিয়ার করেন। প্রায় ২০ মিনিট বক্তৃতা শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল শুরুর ঘোষণা দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে শুরু হয় গ্রেনেড হামলা। একে একে ছোড়া হয় ১৩টি আর্জেস গ্রেনেড। পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এরপর শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডগুলোর মধ্যে তিনটি অবিস্ফোরিত থেকে যায়। শত শত মানুষের আর্তচিৎকার, ছড়িয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত আর পোড়া গন্ধ, সব মিলিয়ে বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয় পুরো এলাকায়। আহতদের সাহায্য করার বদলে বিক্ষুব্ধ এবং আহত মানুষের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে তৎকালীন সরকারের পুলিশ। মুহূর্তের মধ্যে দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে সবাই। মূলত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যেই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। অথচ বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংঘটিত এ হত্যাকা- নিয়ে সেদিন সংসদে কোন শোক প্রস্তাবও তুলতে পারেনি আওয়ামী লীগ। শোক প্রস্তাব তুলতেই দেয়া হয়নি। জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় যে চারদলীয় জোটের ইন্ধন ছিল তা আজ অনেকটাই প্রমাণিত সত্য। আর, সে কারণেই সেদিন জোট সরকার গ্রেনেড হামলার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। সিআইডিকে দিয়ে সাজানো হয়েছিল জজ মিয়া প্রহসন। বর্বর এ হত্যাকান্ডে ঘটনা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে। কোন গণতান্ত্রিক, স্বাধীন ও সভ্য দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে প্রকাশ্য দিবালোকে জনসভায় এমন বর্বরোচিত ঘটনা ঘটতে পারে, তা ভাবনারও অতীত। গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর এলাকায় নিয়োজিত পুলিশ হামলাকারীদের আটক করার ব্যাপারে কোন চেষ্টা কি করেছিল? এ প্রশ্নের মীমাংসা আজও হয়নি। বরং গ্রেনেড হামলার পর দ্রুত ঘটনার আলামত নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। এত বড় একটি হত্যাকান্ডে চারদলীয় জোটের অনেক নেতা শোক প্রকাশের বদলে হামলার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করে। বিরোধীদলীয় নেতার জনসভায় এ রকম পৈশাচিক হামলার পরও দুঃখ প্রকাশ কিংবা লজ্জিত হওয়া তো দূরে থাক, আমাদের নষ্ট রাজনীতির নির্লজ্জ ঐতিহ্য ধরে তৎকালীন সরকারী দলীয় প্রধান হামলার জন্য উল্টো আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করে। মামলার তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার নানা চেষ্টা করা হয়। বিগত জোট সরকারের সময় তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এ দেশে জঙ্গিবাদ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল, এ সত্য আজ আর অস্বীকার করা যাবে না। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার এক জনাকীর্ণ স্থানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভায় যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটানো হয়েছিল, সেটি যে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এক ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নীলনকশা ছিল, তাও এখন সবার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে অপশক্তি যে উল্টো পথে দেশ-জাতিকে ঠেলে দিয়েছিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনা এরই ধারাবাহিক অপক্রিয়া। অবশ্য এর আগেও এমন প্রচেষ্টা ওরা চালিয়েছিল কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে রেখে। আমরা বলে থাকি, আগস্ট আমাদের শোকের মাস। শোকের শুধু নয়, আগস্ট আমাদের শক্তি সঞ্চয়ের মাসও। এই মাসেই আমরা জাতির জনককে হারিয়েছি। আবার শোককে শক্তিতে পরিণত করে সামনের দিকে পথ চলার দৃপ্ত শপথ নিয়েছি। এবারের আগস্টেও আমাদের নতুন এক শপথ নিতে হবে। বিশেষ করে আজকের এই দিনে। কারণ, আরেকটি সাধারণ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। এই সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের শপথ নিতে হবে। জঙ্গীবাদের দোসরদের আগামীতে নির্বাচিত করা যাবে না, এই শপথ নিতে হবে আমাদের। হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের আস্থায় আনা যাবে না। মনে রাখতে হবে, জঙ্গীবাদের মদদদাতারা কোনদিন চরিত্র বদল করতে পারে না। পিশাচের আসল চেহারা একসময় ঠিকই বাইরে বেরিয়ে আসে। আজ ২১ আগস্টের দিনে তাই জাতিকে পাঠ করতে হবে নতুন শপথ। দীক্ষা নিতে হবে নতুন মন্ত্রে। ইতিহাসের এই কালো দিনটিকে স্মরণ করে আলোর ইতিহাস গড়তে হবে আগামী নির্বাচনে। সেই ইতিহাস গড়ার কৌশলটি নিশ্চয় কাউকে খোলসা করে বলতে হবে না। আলোময় দিনে যে কালো ইতিহাস রচিত হয়েছিল, ইতিহাসের সেই কলঙ্ক মুছে ফেলতে চাইলে জাতিকে একজোট হয়ে দাঁড়াতে হবে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×