ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রক্তাক্ত ২১ আগস্ট

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ২১ আগস্ট ২০১৮

রক্তাক্ত ২১ আগস্ট

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্র এবং বাস্তবায়নের পেছনে ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিক, দেশের একাধিক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা, কয়েক শীর্ষ জঙ্গী আর পাকিস্তান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মতোই ২১ আগস্টের হামলার নীলনক্সা তৈরি করা হয়েছিল। ওই সময়ের (২০০৪ সালের) কিছু সামরিক কর্মকর্তা আর জঙ্গী নেতাদের নিয়ে হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের উপস্থিতিতে সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়। হামলায় অংশ নেয়া ব্যক্তিদের পাকিস্তানে ট্রেনিং দেয়া হয়। ট্রেনিংয়ের পর তাদের আর্জেস গ্রেনেডও সরবরাহ করে পাকিস্তান। হামলা শেষে পাকিস্তান ঘাতকদের আশ্রয়ও দেয়। মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।’ ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট ভয়াল ও বীভৎস গ্রেনেড হামলা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, আদালতে একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্য এবং আসামিদের জবানবন্দীতে এসব কথা উঠে আসে। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, গুরুত্বপূর্ণ নথি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং আসামিদের জবানবন্দী বিশ্লেষণ করেও দেখা গেছে, দেশের একাধিক রাজনৈতিক দল, জঙ্গী সংগঠন ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার মদদে ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এই হামলা চালানো হয়েছিল। আগামী মাসে এই ভয়াল গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক রায় ঘোষণা করা হবে। আদালতের রায়েই দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে, কীভাবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াত জোট আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে বীভৎস ও নারকীয় হামলার ছক এঁকে হামলা চালিয়েছিল। আজ সেই রক্তস্নাত, ভয়াল-বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট। বারুদ আর রক্তমাখা বীভৎস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের দিন। মৃত্যু-ধ্বংস-রক্তস্রোতের নারকীয় গ্রেনেড হামলার চৌদ্দতম বার্ষিকী। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে সভ্যজগতের অকল্পনীয় এক নারকীয় হত্যাকান্ড চালানো হয় ২০০৪ সালের এই দিনে। গ্রেনেডের হিংস্র দানবীয় সন্ত্রাস আক্রান্ত করে মানবতাকে। রক্ত-ঝড়ের প্রচন্ডতায় মলিন হয়ে গিয়েছিল বাংলা ও বাঙালীর মুখ। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ এদিন মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। সেদিন যদি ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকে বিস্ফোরিত হতো তবে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কোন সিনিয়র নেতাই প্রাণে রক্ষা পেতেন না। আর এটাই ছিল ঘাতকচক্রের মূল নীলনক্সা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সেদিনটি ছিল শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। হাজার হাজার মানুষের স্রোত সমাবেশে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সমাগমে রীতিমতো মহাসমাবেশে রূপ নেয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের চতুর্দিক। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসীবিরোধী মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে যাওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জে চেপে বিকেলে পাঁচটার একটু আগে সমাবেশস্থলে পৌঁছান বিরোধী দলের নেতা। সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সময় তখন বিকেল পাঁচটা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোতে থাকলেন। হঠাৎ ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে মুহূর্তেই শুরু হলো নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগল একের পর এক গ্রেনেড। আর জীবন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে খই ফোটার মতো একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় ঘাতকরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বারো/তেরোটি গ্রেনেড হামলার বীভৎস মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। রক্তগঙ্গা বয়ে যায় এলাকাজুড়ে। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনা। পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে ট্রাকে অবস্থানরত প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, বর্তমান ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রমসহ অন্যান্য নেতা ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মানবঢাল রচনা করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে। নেতা ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগ ও পরম করুণাময়ের অশেষ রহমতে মৃত্যুজাল ছিন্ন করে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরেকটি রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট ঘটাতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে উপর্যুপরি ১৩ গ্রেনেড মেরেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা; গ্রেনেডের আঘাতে পরাস্ত করতে না পেরে সেদিন শেখ হাসিনার গাড়িতে ঘাতকরা ছুড়েছিল বৃষ্টির মতো গুলি। একেবারে পরিকল্পিত ও টার্গেট করা ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গুলি ভেদ করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাঁচ। শেখ হাসিনাকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ। পরিকল্পিত হামলায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে শেখ হাসিনা ফিরে এলেও ওইদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় পুরো এলাকা। এই ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার পর সেদিন স্পিøন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শত শত মানুষ। আকস্মিক মৃত্যু আর রক্তস্রোতে ল-ভ- শান্তিপ্রিয় অসংখ্য মানুষের হাত-পাসহ মানবদেহের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। কারও হাত নেই, কারও পা উড়ে গেছে। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো পথ। অস্থায়ী সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে রক্তের অনাহূত আল্পনা, শত শত মানুষের আর্তচিৎকার। বেঁচে থাকার জন্য, প্রাণ বাঁচানোর জন্য মুমূর্ষুদের আকুতি, কাতর আর্তনাদসহ অবর্ণনীয় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। নারকীয় হামলা প্রতিহতে সেই সময়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোটের পুলিশ বাহিনী। শত শত রক্তাক্ত-ছিন্নভিন্ন মানুষকে উদ্ধারের পরিবর্তে পরিকল্পিতভাবে চতুর্দিক থেকে টিয়ারগ্যাস ছুড়ে নির্বিঘ্নে ঘাতকদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। এমনকি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড উদ্ধার করা হলেও আলামত নষ্ট করতে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। হামলাস্থলে থাকা সকল আলামত একে একে ধ্বংস করা হয়। এমনকি শত শত আহত ব্যক্তি যেন চিকিৎসা না পায় সেজন্যও উপরের নির্দেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, তৎকালীন পিজি হাসপাতালসহ সরকারী হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকদের অলিখিত নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়েছিল। হামলার পর অগণিত আহতকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে নেয়া হলেও মূল প্রবেশদ্বার বন্ধ করে রাখা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সমর্থক ড্যাব নেতারাও চিকিৎসা দিতে গড়িমসি করে। ফলে আহত বেশিরভাগ নেতাকর্মীই সরকারী হাসপাতালের পরিবর্তে শিকদার মেডিক্যাল, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ নানা ক্লিনিকে ভর্তি হয়। এমনকি নিহতদের ময়নাতদন্ত নিয়েও নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ঘটেছে ওই ভয়াল সময়েও। ২১ আগস্টের সেই রক্তাক্ত ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬। নারীনেত্রী আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৪ আগস্ট মারা যান। আহত হওয়ার পর প্রায় দেড় বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ও প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। রক্তাক্ত-বীভৎস ওই ভয়াল গ্রেনেড হামলায় নিহত অন্যরা হলেন: শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, মোশতাক আহমেদ সেন্টু, হাসিনা মমতাজ রিনা, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (সবার প্রিয় আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসির উদ্দিন সরদার, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। আহত হয়েছিলেন: প্রয়াত রাষ্ট্রপতি (তৎকালীন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য) জিল্লুর রহমান, প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাক, ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এস এম কামাল হোসেন, পংকজ দেবনাথ, সাঈদ খোকন, নজরুল ইসলাম বাবু, নাসিমা ফেরদৌসী, শাহিদা তারেক দিপ্তী, উম্মে রাজিয়া কাজল, আসমা জেরিন ঝুমু, রাশেদা আক্তার রুমা, আবুল হোসেন মোল্লা, মামুন মল্লিক, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, হামিদা খানম মনিসহ পাঁচ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঊনত্রিশ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে আবারও ঘাতকদের দল এই আগস্টেই জোট বেঁধেছিল। শোকাবহ-রক্তাক্ত আগস্ট মাসেই আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর টার্গেট থেকে ঘাতক হায়েনার দল গ্রেনেড দিয়ে রক্তস্রোতের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সমাবেশস্থলে। টার্গেট ছিল এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বশূন্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতেই ঘাতকরা চালায় এই দানবীয় হত্যাযজ্ঞ। আহত পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর অনেকেই ঘাতক গ্রেনেডের স্পিøন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়েই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। হাত-পা-চোখসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে অসংখ্য নেতাকর্মী পঙ্গুত্ববরণ করে জীবনধারণ করছে। সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা স্পিøন্টারের জীবনযন্ত্রণা ভোগ করেই মারা গেছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবদুর রাজ্জাক, ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ হানিফসহ অনেকেই। স্বাধীন বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগস্ট যেন বাঙালী জাতির জীবনে বিয়োগান্তক মাস। হত্যা, অপমৃত্যু, স্বজন হারানোর মাস। জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার অপচেষ্টার মাস। একাত্তরের পরাজিত শত্রু ও তাদের দোসররা বারবার বেছে নিয়েছে অভিশপ্ত আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতক চক্র স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্ট যুদ্ধের মারণাস্ত্র ভয়াল গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল জাতির জনকের কন্যাসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতে সেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল ঘাতকচক্র। ঘাতকের গ্রেনেড হামলায় রীতিমতো রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের প্রাঙ্গণ। সন্ত্রাসবিরোধী আওয়ামী লীগের জনসভা ঘিরে কোলাহলপূর্ণ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল বীভৎস মৃত্যুপুরীতে। সুপরিকল্পিত ও ঘৃণ্য এই গ্রেনেড হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত ও শোকাবহ আগস্টে আরেকটি ১৫ আগস্ট সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছিল পরাজিত ঘাতকচক্র। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে হায়েনাদের হামলার ধরনও ছিল রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের মতোই। পার্থের পরে জজ মিয়া উপাখ্যান ॥ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় শুরু থেকেই হোতাদের আড়াল করতে তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তদন্তের নামে বিভিন্ন সময় নানা ‘আষাঢ়ে গল্প’ হাজির করে প্রথম থেকে বিষয়টিকে বিতর্কিত করার কাজ শুরু হয় সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ তৎকালীন জোট সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে হামলার শিকার আওয়ামী লীগের দিকেই আঙ্গুল তুলে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হেন চেষ্টা নেই যা করা হয়নি। প্রথমে এক ই-মেলকে কেন্দ্র করে শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক যুবককে ধরে এনে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ভারতে পড়াশোনার কারণে পার্থকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চর বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশবাসীকে এটা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিল যে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছে। আর এ কাজে ভারতে পলাতক শীর্ষস্থানীয় ১৪ সন্ত্রাসী অংশ নেয়। এ বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ে পার্থ’র ওপর ব্যাপক শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন চালানো হয়। এরপর ঢাকার মগবাজার থেকে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর রহমানকে গ্রেফতার করে শুরু হয় আরেক নাটক। পার্থ ও মোখলেছুর রহমানকে ধরেও হামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর দৃশ্যপটে হাজির করা হয় জজ মিয়া উপাখ্যান। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে সিআইডি আটক করে। ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়ার কাছ থেকে সিআইডি সাজানো জবানবন্দী আদায় করে। একইভাবে ওই বছরের নবেম্বরে আবুল হাসেম রানা ও শফিক নামে আরও দুই যুবকের কাছ থেকে প্রায় একই রকম সাজানো জবানবন্দী আদায় করা হয়। তৎকালীন সরকার সমর্থক পত্রিকা ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা ওই সাজানো জবানবন্দী ফলাও করে প্রচার করে হামলার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রাণপণ চেষ্টাও করে। বিভাগীয় তদন্তের নামে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের প্রতিবেদনেও ওই একই কথা বলা হয়। পরে প্রকাশ পায় জজ মিয়ার পরিবারকে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন প্রতিমাসে মাসোহারা দেয়ার শর্তে এই সাজানো জবানবন্দী আদায় করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে ॥ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্ত শুরু করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। গ্রেনেড হামলার নেপথ্যের অনেক তথ্যই দেশবাসীর সামনে বেরিয়ে আসে। দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়ে অবহিত ছিল এবং অনেকেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িতও ছিলেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে বিএনপির উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসভবনে বৈঠক করেই এ হামলার পরিকল্পনা করা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করার। এরপর আবদুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই তাইজউদ্দিন মাওলানা তাহের হামলার জন্য ১৫টি গ্রেনেড ঘাতকদের হাতে হস্তান্তর করে। শীর্ষ জঙ্গী মুফতি হান্নানের জবানবন্দীতেও হামলার ঘটনা অনেক আগে থেকে তারেক জিয়া জানতেন এবং হামলার ব্যাপারে তার সমর্থন ছিল- এটিও প্রকাশ পেয়ে যায়। আসামিদের জবানবন্দীতেই হামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের ওই সময়ের পরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার ও এনএসআই মহাপরিচালক আবদুর রহিম, জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ, জঙ্গীনেতা তাজউদ্দিন, মাওলানা ফরিদ, মুফতি আবদুল হান্নান, হুজির সাবেক আমির মাওলানা আবদুল সালাম এবং কাশ্মীরী জঙ্গী আবদুল মাজেদ বাটের নাম উঠে আসে। ১৪ বছর বিলম্ব হলেও একুশ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার প্রক্রিয়া এখন শেষ পর্যায়ে। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছেন, আগামী মাসেই আদালত এই মামলার রায় ঘোসণা করবে। মামলায় এ পর্যন্ত ৪৪ আসামির পক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ শেষ হয়েছে। তাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক রায় সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেয়া সম্ভব হবে। রায়টি হলে দেশ আরও একটি দায় থেকে মুক্তি পাবে। এ প্রসঙ্গে গ্রেনেড হামলা মামলার চীফ প্রসিকিউটর প্রবীণ আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারের নিষ্পত্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। আমাদের প্রত্যাশিত অচিরেই মামলার রায় ও আদেশের তারিখ ধার্য করতে আমরা সক্ষম হব। দিনের কর্মসূচী ॥ ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলা উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দিবসটি শোকাবহ পরিবেশে পালনে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী। হামলাস্থল আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বসানো হয়েছে সকল শহীদের প্রতিকৃতি দিয়ে তৈরি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ। সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বড় বড় আলোকচিত্র লাগানো হয়েছে পুরো এলাকায়। বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশের এলাকায় নেয়া হয়েছে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সকাল দশটায় হামলাস্থলে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, নীরবতা পালন, অনুষ্ঠানস্থলে নিহতদের পরিবার ও আহতদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছাড়াও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনও দিবসটি পালনে গ্রহণ করেছে বিস্তারিত কর্মসূচী।
×