ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিপাকে মৌসুমি ও খুদে ব্যবসায়ীরা

সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনছেন না ট্যানারি মালিকরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৫ আগস্ট ২০১৮

  সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনছেন না ট্যানারি মালিকরা

এম শাহজাহান ॥ সরকার নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কিনছেন না আড়ত-ট্যানারি মালিকরা। গত কয়েক দশকের মধ্যে দেশে এ বছর সবচেয়ে কম দামে কোরবানির চামড়া কেনাবেচা হয়েছে। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ট্যানারি ও আড়ত মালিকরা পানির দরে চামড়া কিনছেন। গত বছরের অর্ধেক দামও পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি বড় আকারের গরুর চামড়া এবার মাঠ পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে ৩০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত। ঢাকায় সবচেয়ে বড় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৮শ’ টাকা। আর ছাগল ও ভেড়ার চামড়া নামমাত্র মূল্যে সংগ্রহ করেছেন ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এদিকে, চামড়ার দাম এত পড়ে গেছে যে, ভবিষ্যতে মানসম্মত চামড়া পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এই চামড়া ভালমতো গরু থেকে ছাড়িয়ে নিতে কোরবানি দাতাকে মোটা অঙ্কের মজুরি গুনতে হয়েছে। ভাল দাম না পেয়ে অনেকে ক্ষোভে দুঃখে এবার চামড়া নষ্ট করে ড্রেন ও ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছেন। এতিমখানা, মাদ্রাসা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকেও চামড়া সংগ্রহে এবার অনীহা ছিল। ফলে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলেও অনেক বাসাবাড়িতে চামড়ার স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এ অবস্থায় সময়মতো সংগ্রহ না করায়ও অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। অবশ্য ঢাকায় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম কর্তৃপক্ষ সকাল থেকে মাইকিং করে চামড়া সংগ্রহ করেছে। কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কম হওয়ায় দেশগ্রামের অনেকে বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে রেখেছেন। আর এতিম ছাত্রদের মধ্যে যারা চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন তারাও পড়েছেন চরম বিড়ম্বনায়। কম দামে চামড়া বিক্রি করেও নগদ অর্থ পাননি অনেকে। চামড়ার দাম নিয়ে সারাদেশে এবার এক ধরনের বিশৃঙ্খলা ছিল। বিশেষ করে ঢাকায় নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি না হওয়ায় বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। এক লাখ ৫ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনে কোরবানি দিয়েছেন উত্তর বাড্ডার কামরুল হাসান। চামড়ার দাম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এত দামী গরু, মাংসও ভাল হয়েছে। কিন্তু চামড়া বিক্রি করেছি ৪০০ টাকা মাত্র। অথচ গত বছর ৭৫ হাজার টাকার গরুর চামড়া ১২০০ টাকা বিক্রি করে সেই টাকা তিন মাদ্রাসায় দান করা হয়েছিল। তিনি দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে দাম কমিয়ে হয়তো তারা সাময়িক লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে! ভালমতো একটি চামড়া ছাড়াতে বেশ টাকা মজুরি দিতে হয়। দাম কমে যাওয়ায় এবার যেনতেনভাবে অনেকে চামড়া ছাড়ানোর কাজটি করেছে। এতে করে অনেক চামড়া কেটে ও নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ দাম ভাল হলে সবাই যতেœর সঙ্গে চামড়া সংগ্রহ করতেন। ট্যানারি মালিকরা এতিম গরিবের হক মেরে টাকা কামানোর ধান্ধা করলে এর মাশুল তাদের গুনতে হবে। তিনি বলেন, বাড্ডা এলাকার অনেকে ভাল দাম না পেয়ে চামড়া ফেলে দিয়েছেন। ঢাকার অনেক জায়গায়ই এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি। জানা গেছে, এ বছর কোরবানিতে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা আছে ৪৫-৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকা। প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৮-২০ টাকা, বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকা। বড় সাইজের একটি গরুর প্রতিটি চামড়ায় কমপক্ষে ২০-২৫ বর্গফুটের মতো হয়। সেই হিসেবে সর্বনিম্ন ৯০০-১২৫০ টাকা পর্যন্ত একটি গরুর চামড়া বিক্রি হওয়ার কথা। অথচ দেশের কোথাও এই দামে চামড়া বিক্রি হয়নি। বুধবার ওয়ারী এলাকা থেকে ১৫ চামড়া নিয়ে রায়সাহেব বাজারের পাইকারদের কাছে যাচ্ছিলেন আসলাম আলী। তিনি বলেন, অন্য বছরের চেয়ে এবার চামড়ার বাজার মন্দা। ওয়ারী এলাকায় ঘুরে ৬০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় তিনি একেকটি গরুর চামড়া কিনেছেন। কিন্তু পাইকাররা এখন সেই চামড়া ৮০০ টাকার বেশি দাম বলছে না। জানা গেছে, সিন্ডিকেটের কারসাজি ও ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্যে এবার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম মূল্যে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। এতে করে কোরবানির পশুর চামড়ার প্রকৃত হকদার এতিম, মিসকিন ও গরিবদের ঠকিয়ে মুনাফা নিচ্ছে ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা। তবে আড়তদাররা খেয়াল-খুশিমতো চামড়া কিনে এখন সরকার নির্ধারিত দামের বাস্তবায়ন চায়। তাদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দাম দিলেই পুঁজি উঠবে। আড়তদারদের হিসাব অনুযায়ী, সবচেয়ে ছোট চামড়াটির সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন মূল্য আসে ৯০০ টাকা। অথচ সে চামড়া ৪০০ টাকার মধ্যেই কিনতে পেরেছেন আড়তদাররা। অবশ্য তাদের দাবি, প্রতি পিস চামড়া প্রসেস করতে প্রায় ২৫০ টাকা খরচ হচ্ছে। তাতেও প্রতি পিস ছোট চামড়া থেকে ২৫০ টাকা লাভ। যদিও এর চেয়ে অনেক বেশি দামেই বিক্রি হবে। এ প্রসঙ্গে পোস্তার আড়তদার সালাম জনকণ্ঠকে বলেন, অবশ্যই এবার ভাল লাভ হবে। আমরা তো আর লোকসান দেয়ার জন্য কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করি নাই। সাভার হেমায়েতপুরের ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা চামড়া কেনার আগে ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতি ফুট চামড়া ৪০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে নেই। সেই অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া ক্রয় করে তা বিক্রির জন্য সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন ট্যানারি মালিকদের কথা উল্টে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া বিক্রি হচ্ছে না জানিয়ে তারা আগের নির্ধারিত মূল্য দিয়ে কোনো চামড়া ক্রয় করবে না বলে পরিষ্কার বলে দিচ্ছে। এ ঘটনায় নিরুপায় হয়ে আমরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে চামড়ার দাম কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। চামড়া মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকার নির্ধারিত দামের অর্ধেক মূল্যে চামড়া কেনা হচ্ছে। তিনি বলেন, এটা অব্যাহত থাকলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পথে বসবেন। তারা ধারদেনা করে চামড়া কিনেছেন দুটো পয়সার জন্য। কিন্তু সেই চামড়ার দাম দেয়া হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে ফেলেছে। সে কারণে মৌসুমি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ট্রাক ভাড়া করে চামড়া নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। এখন তারা চামড়া ফেরতও নিয়ে যেতে পারছে না আবার কম দামে বিক্রিও করতে চাইছে না। ফলে এসব ব্যবসায়ীদের চামড়া নিয়ে বিভিন্ন ট্যানারি মালিকদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা যে দামে চামড়া কিনতে চাইছেন তা দিয়ে গাড়ি ভাড়াও উঠবে না অনেক ব্যবসায়ীর। এরইমধ্যে অনেক ব্যবসায়ী লবণ না দেয়ায় পচতে শুরু করেছে তাদের সংগ্রহ করা চামড়া। দুই পয়সা লাভের আসায় চামড়া কিনে যে বিনিয়োগ করেছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখন সেই চামড়াই তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়ে অনেককে আবার ছোট ছোট ট্যানারিতে জায়গা ভাড়া নিয়ে চামড়ায় লবণ লাগিয়ে রাখতে দেখা গেছে। ঢাকার চামড়া ট্যানারিতে ॥ ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর বেশিরভাগ চামড়া সাভারের ট্যানারি ও পোস্তার আড়তে এসে গেছে। তবে সারাদেশ থেকে চামড়া আসতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। কোরবানির পশুর লবণযুক্ত চামড়া সারাদেশ থেকে আগামী ১ থেকে সাভারে আসা শুরু হবে। সরকার নির্ধারিত দামে আড়তদার ও ডিলারদের কাছ থেকে এ বছর এক কোটির ওপরে গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষের চামড়া সংগ্রহ করা হবে। এ কার্যক্রম চলবে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সাধারণত কোরবানির সময় সারাদেশে ফড়িয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে। পরে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করেন আড়তদার ও ডিলাররা। এরপর লবণযুক্ত চামড়া কিনে নেন ট্যানারি মালিকেরা। তাদের মতে, এবার নির্বাচনী বছরের কারণে গতবারের তুলনায় ২০-৩০ লাখ পশু বেশি কোরবানি হয়েছে। তবে বিভিন্ন কারণে গত কয়েক দশকের তুলনায় এবার কাঁচা চামড়ার দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। এ প্রসঙ্গে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, আগামী সপ্তাহ অর্থাৎ ১ সেপ্টেম্বর থেকে ট্যানারির মালিকেরা লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহ শুরু করবেন। ওই সময় সরকার নির্ধারিত দামেই আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লবণযুক্ত চামড়া কেনা হবে। চামড়ার মান অনুযায়ী দাম দেয়া হবে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় কাঁচা চামড়ার আড়ত পোস্তাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এ চামড়া সংগ্রহ করা হবে। বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচ-এসএমএ) সভাপতি হাজী মোঃ টিপু সুলতান বলেন, সারাদেশের ফড়িয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে লবণ দিয়ে তা সংরক্ষণ করেছি। বিশ্ববাজারে মূল্য কম ও অর্থসংকটের কারণে এবার চামড়ার দাম পড়ে গেছে। ট্যানারি মালিকেরা যদি সময়মতো টাকা দিত, তাহলে এ সঙ্কট হতো না। আগামী সপ্তাহ থেকে ট্যানারিগুলো চামড়া কিনবে। আশা করছি, তখন সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি করা যাবে। এদিকে, কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের অন্যতম উপাদান লবণের বাড়তি দাম নিয়ে প্রতিবছরই উদ্বিগ্ন হতে হয় ব্যবসায়ীদের। তবে দেশে লবণের কোন ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছে সরকার। লবণের মজুদ নিয়ে বিসিক জানিয়েছে, দেশে পর্যাপ্ত লবণ রয়েছে। লবণের কোন সঙ্কট নেই। চামড়া ব্যবসায়ী বলছেন, গত মে মাসে উৎপাদনের মৌসুম শেষে আয়োডিন ছাড়া প্রতিবস্তা (৭৫) লবণ ৭০০-৭০৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু গত এক সপ্তাহে লবণের দাম বস্তায় ২০০ টাকা বেড়ে গেছে। দাম না কমলে চামড়া সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত লবণ ব্যবহার করা সম্ভব হবে না বলছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে গেলবারের মতো এবারও চামড়া নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন তারা। চামড়া ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে প্রায় দুই লাখ টন লবণের প্রয়োজন হতে পারে।
×