ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রক্ত পরীক্ষা করেই শনাক্ত করা যাবে ক্যান্সার ॥ বাংলাদেশের যুগান্তকারী আবিষ্কার

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 রক্ত পরীক্ষা করেই শনাক্ত করা যাবে ক্যান্সার ॥ বাংলাদেশের যুগান্তকারী আবিষ্কার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কম খরচে ক্যান্সার শনাক্তকরণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ। যে প্রযুক্তির মাধ্যমে একজন রোগীর দেহে কোন ধরনের যন্ত্রপাতির প্রবেশ ছাড়াই ক্যান্সার আছে কি-না সেটি শনাক্ত করা সম্ভব হবে। অল্প সময়ের মধ্যেই এই প্রযুক্তি বলে দেবে কোন ব্যক্তির শরীরে ক্যান্সার আছে কি নেই। এতে খরচ পড়বে ৫০০ টাকারও কম। এর ফলে প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে এখন থেকে রক্ত পরীক্ষা করেই সম্ভাব্য ক্যান্সার শনাক্ত করা যাবে। বুধবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অডিটোরিয়ামে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহান্সমেন্ট প্রজেক্টের (হেকেপ) আওতায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকের নেতৃত্বে একদল গবেষক নন-লিনিয়ার অপটিক্স গবেষণায় ক্যান্সার শনাক্তকরণের সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। গবেষক দলের অন্য সদস্যরা হলেন- প্রফেসর ড. শরীফ মোঃ শরাফ উদ্দিন, মনজ কান্তি বিশ্বাস ও এনামুল হক। সাধারণত বেশিরভাগ সময় ক্যান্সার রোগ শনাক্ত হয় রোগের শেষ পর্যায়ে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ডাক্তারদের খুব একটা কিছু করার থাকে না। বিশ্বে এখন পর্যন্ত এমন কোন পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি, যার মাধ্যমে আগে থেকেই ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। তবে শাবির গবেষক দলের কারণে শুরুতেই ক্যান্সার দ্রুত শনাক্তের সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন হলো। উদ্ভাবিত ক্যান্সার শনাক্ত করার প্রযুক্তি সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কার। এটি শিক্ষা গবেষণায় বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। এই সাফল্য আমাদের জন্য ‘ল্যান্ডমার্ক’ হয়ে থাকবে এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এই গবেষণা থেকে অনুপ্রাণিত হবে। সব মানুষের কল্যাণে এ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে। আগামী এক বছরের মধ্যে মানুষ এই প্রযুক্তির সুফল পাবে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। ক্যান্সার শনাক্ত করার প্রযুক্তি সম্পর্কে মন্ত্রী আরও বলেন, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ‘নন-লিনিয়ার অপটিক্স ব্যবহার করে বায়োমার্কার নির্ণয়’ শীর্ষক প্রকল্পটি হেকেপের আওতায় গৃহীত হয়। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে নন-লিনিয়ার বায়োঅপটিক্স রিসার্চ ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা হয়। এই ল্যাবরেটরিতে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের রক্তের সিরামে শক্তিশালী লেজার রশ্মি পাঠিয়ে নন-লিনিয়ার সূচক পরিমাপ করার কাজ শুরু হয়েছে। বায়ো-কেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় যে বাড়তি রিএজেন্ট ব্যবহার করতে হয় উদ্ভাবিত নতুন পদ্ধতিতে তা প্রয়োজন হয় না। এই পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে নতুন একটি পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষা করে সম্ভাব্য ক্যন্সারের ভবিষ্যতবাণী করার একটি সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। এটি অল্প খরচে এবং কম সময়ে করা সম্ভব হবে। এই উদ্ভাবনী প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে শুধু ক্যান্সার রোগাক্রান্ত রোগীদের রক্ত নয়, অন্য যেকোন স্যাম্পলের নন-লিনিয়ার ধর্ম খুবই সহজে সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হবে। এই নতুন পদ্ধতিটি আগে কখনোই কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। কাজেই আশা করা যায়, ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ের সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতি হিসেবে এটি সম্ভাবনার নতুন একটি দ্বার উন্মোচন করেছে বলেন শিক্ষামন্ত্রী। বিভিন্ন গবেষণার বিষয়ে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে গবেষণায় ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকতর গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বাংলাদেশ সক্ষমতা অর্জন করছে। শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) আওতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ২ হাজার ৫৪ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে টিচিং-লার্নিং ও গবেষণার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। হেকেপের ৫টি কম্পোনেন্টের মধ্যে একাডেমিক ইনোভেশন প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করা হয়েছে। এর আওতায় ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে (২৮টি সরকারী ও ১০টি বেসরকারী) মোট ৪৪২টি সাব-প্রজেক্টে ৮০২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উদ্ভাবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন গবেষক দলের প্রধান ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. ইয়াসমিন হক। তিনি বলেন, এই গবেষণা মূলত ক্যান্সার নির্ণয়ের সহজ একটা পদ্ধতি। আমরা হেকেপের সহায়তায় এই ভিন্নধর্মী গবেষণা করেছি। তবে এ বিষয়ে আরও উচ্চতর গবেষণা প্রয়োজন। ড. ইয়াসমিন হক বলেন, প্রচলিত প্রযুক্তিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় এবং ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে ক্যান্সার শনাক্ত করতে। কিন্তু উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে মাত্র ৫০০ টাকায় অল্প সময়েই ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব। কারণ, বায়োকেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় বাড়তি রিএজেন্ট ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু নতুন প্রযুক্তিতে তার কিছুর প্রয়োজন হয় না। নন-লিনিয়ার অপটিক্যাল ধর্ম ব্যবহার করে ক্যান্সার রোগীর শরীরের তরল পদার্থ ব্যবহার করে ক্যান্সার নির্ণয় সম্ভব। অনুষ্ঠানে এ গবেষণা কর্মের ওপর একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্ট করেন তিনি। জানা গেছে, এরই মধ্যে এ গবেষণার ফলের পেটেন্টের জন্য একযোগে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে আবেদন করা হয়েছে। ক্যান্সার একটি ঘাতক রোগ। প্রতিবছর বিশ্বে বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। ক্যান্সারের চিকিৎসা এতই ব্যয়বহুল যে এর চিকিৎসায় অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় ঘাতক এ রোগের বিষয়টি ধরা পড়লে সিংহভাগ ক্ষেত্রে জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়। চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস পায়। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিটি চূড়ান্ত মূল্যায়নে গ্রহণযোগ্য হলে তা চিকিৎসাবিজ্ঞান তথা মানবকল্যাণে একটি বড় অবদান বলে বিবেচিত হবে। সংবাদ সম্মেলনে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদ, বিশ্ব ব্যাংকের চীফ অপরেশনস অফিসার ড. মোখলেছুর রহমান এবং প্রকল্প পরিচালক ড. গৌরাঙ্গ চন্দ্র মোহান্ত। এ সময় সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের দিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) এই নন-লিনিয়ার অপটিক্স রিসার্চ গ্রুপটি গবেষণার ব্যবহারিক দিক নিয়ে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রুপটি হেকেপের উইন্ডো ফোরের আওতায় ইউনিভার্সিটি-ইন্ডাস্ট্রি সমন্বিত গবেষণার জন্য একটি উদ্ভাবনীমূলক পরিকল্পনা জমা দেয়। পরিকল্পনাটি ছিল ক্যান্সার রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের নন-লিনিয়ার ধর্ম পরিমাপ করে ক্যান্সারের সম্ভাব্য উপস্থিতি ও অবস্থা চিহ্নিত করার একটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন।
×