ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬১০ খ্রি: ২৭ রমাদান রাতে মক্কার হেরা গুহায় অবস্থানকালে প্রথম অহি লাভ করেন। এর তিন বছর পর বিস্তারিত অহি তাঁর ওপর নাজিল হতে থাকে। আল্লাহর নির্দেশে তিনি মক্কায় তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নিকট ইসলাম প্রচার করতে থাকে। মক্কার গোত্র প্রধানগণ তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তাঁকে এই প্রচার থেকে নিবৃত করতে চেষ্টা করে। তাঁরা নানা ধরনের প্রলোভনের আশ্রয় নেয়। তারা প্রিয়নবী (স:) এর চাচাজান প্রিয় অভিভাবক আবু তালিবের নিকট এসে বলে আপনার ভাতিজা মোহাম্মদ (সা:) যদি আরবের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলাকে বিয়ে করতে চায় আমরা তাই করে দেব, যদি আমাদের নেতা হতে চান তাই বানিয়ে দেব। এমনি ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। আবু তালিব হুজুর (সা:) এর কাছে গিয়ে ওইসব কথা তুলে ধরলেন, তিনি বললেন চাচা ওরা যদি আমার এক হাতে চাঁদ ও অন্যহাতে সূর্যও এনে দেয় তা হলেও আল্লাহ্ আমার কাছে যে দায়িত্ব প্রদান করেছেন তা থেকে আমি বিরত হব না। নিরুপায় হয়ে কাফের মুশরিকরা দলবদ্ধ হয়ে নবী করিম (সা:) এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে বয়কট করেন। তাঁরা আবু তালিব উপত্যকায় আশ্রয় নেন। প্রায় তিন বছর দারুণ কষ্টের মধ্যে তাঁরা সেখানে দিনগুজরান করেন। অতঃপর বয়কট তুলে নেয়া হয়। এর কিছুদিন পর রমাদান মাসে হুজুর প্রিয়নবী (সা:) এর সহধর্মিণী মা খাদিজা (সা:) ইন্তেকাল করেন। এর কয়েকদিন পর সেই রমাদান মাসের ১৮ তারিখে চাচা আবু তালিবও ইন্তেকাল করেন। এই দু’জনই ছিলেন তাঁর বিপদ আপদের বন্ধু এবং সহায়ক। তাঁদের ইন্তেকালে তিনি শোকে মুহ্যমান হয়ে যান। এর কিছুদিন পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে মিরাজ শরীফে নিয়ে যান। পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিধান নিয়ে তিনি প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর ৬২২ খ্রি: ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনায় হিযরত করেন। মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় তিনি কাবা শরীফকে লক্ষ্য করে বলেন, আমাকে ওরা তোমার কাছে থাকতে দিল না। এমন সময় অহি নাজিল হলো হে রসুল আপনি বলুন, হে আমার রব, আমাকে তুমি প্রবেশ করাও সহিসালামতে, আমাকে তুমি বের করে দাও সহি সালামতে এবং আমাকে সাহায্যকারী শক্তি দিয়ে সাহায্য কর। (বনী ইসরাইল আয়াত-৮০)। মদিনায় প্রবেশপথ কুবা নামক স্থানে তিনি হযরত আবু বকর (রা:) সঙ্গে নিয়ে কুবায় উপস্থিত হলে সেখানে মদিনাবাসীগণ তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা জানায়। সেখানে তিনি ১৪ দিন অবস্থান করেন এবং একটি মসজিদ স্থাপন করেন, এটাই তাঁর নির্মিত প্রথম মসজিদ। যা কুবা মসজিদ নামে খ্যাত। এই মসজিদে দুই রাকাআত নফল সালাত আদায় করলে একটি ওমরার সাওয়ার লাভ হয়। মদিনার নাম ছিল ইয়াস্রির উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে যার নামকরণ হয়ে যায় মদিনাতুল নবী বা নবীর শহর। মদিনাতে এসে তাঁর নির্দেশে এবং উদ্যোগে নির্মিত হয় একটি মসজিদ। এই মসজিদকে বলা হয় মসজিদুন নবী। এই মসজিদ কেন্দ্রিক একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের সূচনা হয়। সেই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনি একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন যার শুরুতে বলা হয় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একটি জাতিগোষ্ঠী। এই মদিনা যদি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে এই জাতিগোষ্ঠী সবাই মিলে তা প্রতিহত করবে। যদি কেউ এই শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী কিছু করে তাহলে তাকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হবে। ৪৭ দফা বিশিষ্ট এই শাসনতন্ত্রকে বলা হয় মদিনার সনদ বা চার্টার অব মদিনা যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। দলে দলে লোক এসে ইসলামে দাখিল হতে থাকে। মক্কার কোরায়েশ মুশরিকরা মদিনা রাষ্ট্রকে সহ্য করতে পারল না। তারা একে ধ্বংস করার সর্বাত্মক চেষ্টায় মেতে উঠল। ৬২৪ খ্রি: ১৭ মার্চ মোতাবিক ২য় হিজরির ১৬ রমাদান মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত বদর নামক প্রান্তরে একহাজার কোরায়েশ সৈন্যের সঙ্গে ৩১৩ জন মুজাহিদের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। মুজাহিদ বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন প্রিয় নবী করিম (সা:)। সেদিন ছিল শুক্রবার যুদ্ধে ৭০ জন প্রতিপক্ষের সৈন্য নিহত হয়। এবং ১৪ জন মুজাহিদ শহীদ হন। ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়। এই বিজয় ইসলামের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী বিজয়ের পথ করে দেয়। মক্কার কোরায়েশ মুসরিকরা পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলার জন্য পরের বছর কয়েক হাজার সৈন্য নিয়ে মসজিদুন নবী থেকে ৩ মাইল উত্তরে অহুদ পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হয়। প্রিয়নবী (সা:) কয়েকশ’ মুজাহিদ নিয়ে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য অহুদ প্রান্তরে যান। এই যুগে মুজাহিদ বাহিনীর শিথিলতার কারণে প্রথম পর্যায়ে কিছু বিপর্যয় নেমে আসলেও শেষমেশ মক্কার কোরায়েশরা পিছু হটে পলায়ন করতে বাধ্য হয়। ইসলামের বিজয় সূচিত হয়। এর পরের বছর মক্কার কোরায়েশ মুশরিকরা প্রচুর সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমণ করতে এগিয়ে আসেন। তাদের প্রতিহত করার জন্য মদিনার প্রবেশ পথে দীর্ঘ পরিখা খনন করা হয়। পরিখা অতিক্রম করা মক্কার কোরায়েশ মুসরিকদের সম্ভব হয়নি। প্রায় এক মাস অবস্থান করে প্রচ- ঝড় বৃষ্টির দাপটে তারা চম্পট দিতে বাধ্য হয়। ৬২৮ খ্রি: প্রিয়নবী (সা:) ওমরা করার নিয়তে একটি কাফেলা নিয়ে মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। মক্কার কাছাকাছি প্রবেশকালে ৯ মাইল আগে হুদায়বিয়া নামক স্থানে সফর বিরতি দেন এবং হযরত ওসমান (রা:) কে মক্কায় পাঠান। তাদের মক্কা আসার কারণ কোরায়েশ মুসরিকদের কাছে জানাবার জন্য। শেষমেশ মক্কার কোরায়েশ মুশরিকদের সঙ্গে প্রিয়নবী (সা:) এর একটি দশ শর্তবিশিষ্ট শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু কিছুদিন পর এই শান্তি চুক্তির কয়েকটি শর্ত কোরায়েশরা ভঙ্গ করে। বাধ্য হয়ে ১০ সহস্রাধিক সাহাবা একরামকে নিয়ে প্রিয়নবী (সা:) মক্কায় প্রবেশ করেন। ঘোষিত হয় : সত্য এসেছে, মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা দূর হবার (বনী ইসরাইল আয়াত ৮১)। মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়। ৬৩০ খ্রী: রমাদান মাসে মক্কা বিজয় হয়। বিজয়ের পর প্রিয়নবী (সা:) কয়েকজন মক্কায় অবস্থান করেন এবং রমাদান শেষে ১ সাওয়াল প্রিয়নবী (সা:) ইমামতে মক্কায় প্রথম ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হয়। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×