ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসির সিয়াম

সেঁজুতি ও টিংকু

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সেঁজুতি ও টিংকু

বাসার সামনের রাস্তায় কয়েকদিন যাবত সদ্য জন্মানো একটা কুকুর ছানা এসে জুটেছে। কুকুর ছানাটা সবসময় একাই থাকে। মা কুকুরটাকে দিনে রাতে কখনই দেখা যায় না তার পাশে। এত ছোট বাচ্চাকে রেখে মা কুকুরটার সবসময়ই অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর কথা নয়। নিশ্চয় কোন কারণে ছানাটা তার মাকে হারিয়ে ফেলেছে। আর মাকে হারিয়ে সবসময় একা ভয়ে ভয়ে রাস্তার এক পাশে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে। কেবল যখন ক্ষুধা পায়, তখন আশপাশের ময়লা আবর্জনা থেকে মানুষের ফেলে রাখা খাবারের অংশ টুকেটুকে খায়। নিশ্চয় ছানাটার খুব কষ্ট হয়! বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে মাত্র দশ বছর বয়সী সেঁজুতি ঠিক এসব কথাই ভাবছে। পরদিন আম্মুর সঙ্গে স্কুল থেকে ফিরে বাসার মেইন গেটের সামনে দাঁড়াতেই সেঁজুতির চোখ পড়ল একজন অর্ধ বয়স্ক লোকের দিকে। লোকটা রাস্তার একপাশ থেকে হাতে একটা ইটের টুকরো নিয়ে ওই কুকুর ছানাটার দিকে তাক করে হাত উঁচুতে উঠিয়ে রেখেছে। আর বার বার ঢিল ছোড়ার ভয় দেখাচ্ছে। ছানাটা একটু পরপর লোকটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে খেয়াল করছে আসলেই ইটের টুকরোটা তার দিকে ছুড়েছে কিনা। আর ভয়ে জড়োসড় হয়ে যতটা পারা যায় নিজেকে গুটিয়ে রাখছে। নিজের জায়গা থেকে উঠে দৌড়ে পালানোরও সাহস নেই তার। হয়ত এলোমেলোভাবে দৌড়ে পালাতে গিয়ে গাড়ির নিচে চাপা পড়ার ভয় আছে মনে! লোকটা কুকুর ছানাটার ভয় পাওয়া দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। সেঁজুতি তার আম্মুকে কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে না পারায় বাসার ভেতরে চলে গেল। কুকুর ছানাটার জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে সেঁজুতির। স্কুল থেকে ফিরে তাই ঠিকমতো খেতেও পারল না সে। এমন একটা ছোট্ট অসহায় প্রাণীর সঙ্গে কেউ এমন নির্দয় আচরণ করতে পারে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে নিচে রাস্তায় কুকুর ছানাটার দিকে তাকিয়ে এমনটাই ভাবছে সেঁজুতি। এমন সময় তার চোখে পড়ল আরও একটি ঘটনা। তারই বয়সী একদল ছেলে ক্রিকেট খেলার জন্য ব্যাট বল হাতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। এরমধ্যে একজনের চোখে পড়ে রাস্তার কোণায় শুয়ে থাকা ছানাটার ওপর। সবাইকে থামিয়ে নিজেরা নিজেরা কি যেন বলাবলি করল তারা। এরপর সেই ছেলেটা হাতে থাকা ব্যাট দিয়ে ছানাটার গায়ে খোঁচা দিতে শুরু করল। কুকুর ছানাটা বোধয় একটু ব্যথা পেয়েছিল। তাই ওখান থেকে উঠে একটু সরে গিয়ে বসল। কিন্তু সেখানে গিয়েও ছেলেগুলো বার বার একই কাজ করতে লাগল। সেঁজুতির মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। সে আর বেলকুনিতে না দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে চলে আসল। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে যতই ওসব দেখবে, মন ততই খারাপ হবে তার। পরদিন স্কুল থেকে একইভাবে আম্মুর সঙ্গে ফেরার পর গেটে দাঁড়িয়ে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে কুকুর ছানাটার খোঁজ করল সেঁজুতি। কিন্তু আশপাশে কোথাও আছে বলে চোখে পড়ল না। সেঁজুতি ভাবল, হয়ত একটু এদিক সেদিক খাবার খুঁজতে গেছে। অথবা কুকুর ছানাটাও তো বড় হতে শুরু করেছে, তাই আর সবসময় এক জায়গায় বসে থাকারও কথা নয়। তাই বাসার ভেতর চলে আসলো সে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নিজের মতো করেই সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটলো সেঁজুতির। সন্ধ্যার পর বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আবারও কুকুর ছানাটাকে মনেমনে খুঁজলো সে। কিন্তু এবারও দেখা মিলল না। এতদিন যাবত ছানাটা একটা জায়গায় থাকছে, এতক্ষণ সেখানে একবারের জন্যও না ফেরার তো কথা নয়। তাছাড়া একেবারে অন্য জায়গায় চলে যাবে অতটা বড়ও তো হয়নি ছানাটা। তাহলে কি হয়েছে ওর! কুকুর ছানাটার জন্য বার বার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে সেঁজুতির। এই বিষয়টা আম্মুও খুব ভালভাবেই খেয়াল করেছেন। সেঁজুতি বেশ শান্ত স্বভাবের মেয়ে। কখনও কোন কিছু নিয়ে আব্বু-আম্মুর কাছে অযথা বায়না বা মুখ ফুটে আবদার করে না। তাই আম্মু সবসময়ই শান্ত মেয়ের ভেতরে লুকিয়ে রাখা কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করেন। মেয়ে যেন কিছুতেই কষ্ট না পায়। সেঁজুতির কাছে এসে দাঁড়ালেন আম্মু। জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে মা? কুকুর ছানাটাকে না দেখতে পেয়ে চিন্তা হচ্ছে? আম্মুর কথায় মোটেও অবাক হলো না সেঁজুতি। সে খুব ভাল করেই জানে কিছু না বললেও তার ভেতরের কথাগুলো আম্মু ঠিকই বুঝে ফেলেন। আম্মুর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল সেঁজুতি, আসলে আম্মু স্কুল থেকে ফেরার সময় ওকে দেখতে পাইনি। এখনও নেই। এতটা ছোট ছানা তো একেবারে অন্য কোথাও চলে যাওয়ারও কথা নয়। আর তুমিও তো নিশ্চয় খেয়াল করেছ, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন অযথাই কুকুর ছানাটার ওপর নানাভাবে অত্যাচার করে। তাই একটু চিন্তা হচ্ছে আমার। মেয়েকে খুশি করতে বাইরে নিয়ে গেলেন সেঁজুতির আম্মু। বাসার দাড়োয়ানকে দিয়ে ছানাটার খোঁজ নিতে পাঠালেন। কিছুক্ষণ পর দাড়োয়ান এসে জানালো, দুপুরবেলা নাকি একটা ছেলে কুকুর ছানাটার সঙ্গে খাবারের লোভ দেখিয়ে খেলছিল। খাবারের অংশ এদিক সেদিক বারবার রাস্তায় ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছিল আর ছানাটা ছুটে ছুটে খাবার খেতে যাচ্ছিল। এমন সময় ছানাটা রাস্তার পাশের ড্রেনে পড়ে গেছে। ময়লা ড্রেন থেকে কেউ আর তুলে নিয়ে আসেনি ছানাটাকে। এ কথা শুনে আম্মুকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি ড্রেনের পাশে গিয়ে উঁকি দিল সেঁজুতি। আম্মুকে দেখিয়ে বললো, আম্মু ওতো এখনও বেঁচে আছে। ঐতো ডাকছে শোন, আর ড্রেন থেকে উঠে আসার জন্য কেমন লাফালাফি করছে। আম্মুও ঘটনাটা দেখে মন খারাপ করে ফেললেন। বললেন, আহারে, সেই দুপুরবেলা থেকেই নিশ্চয় ছোট্ট ছানাটা এভাবে লাফালাফি করছে বাঁচার জন্য। দাড়োয়ানকে ডেকে আম্মু কুকুর ছানাটাকে ড্রেন থেকে উঠানোর ব্যবস্থা করতে বললেন। এরপর তাকে ভালভাবে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে বাসার ভেতরে গাড়ির গ্যারাজে নিয়ে রাখতে বললেন। সেঁজুতি জিজ্ঞেস করল, এখন থেকে কি ছানাটা আমাদের সঙ্গেই থাকবে আম্মু? -হ্যাঁ। যেন আর কেউ অসহায় কুকুর ছানাটাকে এভাবে কষ্ট দিতে না পারে। হয়েছে তো তোমার ইচ্ছে পূরণ? এখন থেকে অবসরে তুমি ছানাটাকে নিয়ে খেলতেও পারবে। -থ্যাংক ইউ আম্মু। এখন থেকে তাহলে আমি রোজ টিংকু ছানার সঙ্গে খেলব। মেয়ের কথা শুনে আম্মু এবারে একটু মুচকি হাসলেন। এরই মধ্যে তার মেয়ে যে ছানাটার একটা নামও ঠিক করে ফেলেছে। অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×