ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ঢাকার দিনরাত

রাজধানীর সড়ক পরিস্থিতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন না এলেও সাধারণভাবে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফুটওভার ব্রিজে আগের তুলনায় বেশি লোক উঠছেন, এমনকি লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে হলেও। অপরদিকে স্কাউটদের তৎপরতার জন্য যাত্রী ওঠানো-নামানোয় গণপরিবহনের চালক ও তার সহকারী কিছুটা তাড়াহুড়ো করছে। তাই কোনো কোনো ব্যস্ত সড়কের মোড়ে বিসদৃশ জটলা আর তীব্র আকার ধারণ করছে না। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। উল্টোপথে গাড়ি চালানো এবং হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহার ও ফিটনেসে ঘাটতি রাখার জন্য প্রতিদিনই শত শত চালককে জরিমানা করা হচ্ছে। ঢাকাবাসীর শরত উপভোগ আশ্বিন এসে গেল। ভাদ্র-আশ্বিন এই দুই মাস মিলে শরতকাল। তার মানে শরতের একটি মাস ইতোমধ্যে চলে গেছে! এখনও তো যাওয়া হলো না প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে শরত উপভোগের জন্যে? প্রকৃতিপ্রেমিকদের কাছে এ ঋতুর বিশেষ কদর রয়েছে। ভ্যাপসা গরমকে হাওয়ার ঝাপটায় আলতো সরিয়ে শরৎ এনে দেয় একরাশ স্বস্তি। আকাশে ভাসে মেঘের ভেলা। ভোরে ঘাসের ডগায় শিশিরের চুম্বন রোমান্টিক মনকে যুগপৎ প্রাণবন্ত ও উদাসীন করে। সৈয়দ মুজতবা আলীর নায়ক কান্দাহারে গিয়ে কাবুলদুহিতা শবনমের প্রেমে পড়ে শরতের স্মৃতি তুলে এনেছিল। শবনম মানে শিশিরবিন্দু, হিমকণা। পরিচয়ের শুরুতেই নায়ক মজনুন শবনমকে শিশিরের সঙ্গে শিউলির সম্পর্ক তুলে ধরে কবিতা আউড়েছিল। সেই কবিতা মন হরণ করে শবনমের, সে নিজের নাম ‘শিউলি শবনম’ হলে কেমন হয় জানতে চেয়েছিল প্রেমাষ্পদের কাছে। একটিমাত্র রজনীই তো শিউলি ফুলের নিয়তি। পরদিন ভোরবেলা গাছকে বিচ্ছেদ বেদনা দিয়ে শিউলির ঝরে পড়া। শবনম-মজনুনের বাসর রাতের পরদিনই শুরু হয় তাদের চির বিচ্ছেদকাল। সাহিত্যরসসিক্ত দারুণ এক আখ্যান। যাহোক, মহানগরী ঢাকায় গ্রামীণ শরতের আমেজ ও আবেশ চান? যেতে পারেন উত্তরার দিয়াবাড়ি। বুঝেছি শহরের খুব গভীরে থাকে পল্লী, যেখানে শরতের চুম্বন অনুভব করা যায় পুরোদমে। কাশবনে ছুটন্ত ট্রেনের ছবি আমাদের চোখে লেগে আছে সত্যজিৎ রায়ের কল্যাণে; সেখানে অপু দুর্গার যুগল বিস্ময় আমাদের হৃদয়ে চির জাগরুক। কাশবন কন্যাদের ফটোসেশন আমরা দেখতে পাচ্ছি অধুনা ফেসবুকের সৌজন্যে। রাজধানীর ট্রেডমার্ক কাশবন হলো দুটি: দিয়াবাড়ি ও বসুন্ধরার ৩০০ ফুট রাস্তার পাশের প্রান্তর। বসুন্ধরার ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে দলেবলে ঢাকাবাসী চলেছেন শারদীয় মাধুর্য উপভোগে। এসব দৃশ্যের কথা আমি শুনেছি। শুধু নারীরাই ছিলেন একটি ভ্রমণে। এদের সবারই কৈশোরে যে কাশফুল স্বপ্ন জাগিয়েছে, এমন নয়। তবে কাশফুলের এই অবারিত নন্দিত তাদের আকর্ষণ করেছে। আহ্বান জানিয়েছে নির্মল আনন্দ অবগাহনে। আমাদের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়, বহমান যে আনন্দধারার মধ্যে আমরা প্রশ্বাস গ্রহণ করি তার ঐশ্বর্য ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি না। যখন তার প্রভাব ঘটে তখনই কেবল হাঁসফাঁস করে উঠি। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে এই যে আমরা ছয়-ছটি ঋতুর পৃথক সৌন্দর্য আস্বাদন এবং তার মহিমা উপভোগের সৌভাগ্য দৈশিক সূত্রে পেয়ে গেছি- তার মূল্য কি যথাযথভাবে অনুভব করে থাকি? শারদসন্ধ্যায় দিয়াবাড়ির কাশবনে হারিয়ে গিয়ে হঠাৎ যান্ত্রিক শব্দে চমকে ওঠে মানুষ; আকাশ বন পেরিয়ে উড়ে আসছে বিমান। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে অবতরণ করবে রাজধানীর মাটিতে। দিয়াবাড়ির অবারিত অঙ্গনের সৌন্দর্যে নিমজ্জিত হয়ে ভেসে চলুন মেঘে আর আকাশের ওপারে আকাশ থেকে মেঘের পরে মেঘ পেরিয়ে দেশের মানুষকে তার দেশের মাটিতে নিয়ে আসার আগমনী আওয়াজে আরেকবার নেমে আসুন কাশফুলের ঠিক পাশটিতে। সত্যি বলছি, এই শরতে একবার দিয়াবাড়ি বেড়িয়ে আসুন- আমার মতোই দিয়াবাড়ির নাম বদলে রাখবেন- ‘শরত-বসত’। এই ক্ষুদ্র জীবনে একবারই কেবল একটি শরতে আমি দেশ থেকে দূরে ছিলাম। শীতার্ত সেই দূরদেশে একেবারে প্রথমবারের বিরহীর মতো মর্মে অনুভব করি বাংলার শরতকে, আশ্বিনে আসীন নিঃশব্দ ও সশব্দ রাজ্যপাটকে। মানে তার অভাববোধকে। রীতিমতো হাহাকার করেছে মন শরতের সঙ্গে প্রেম করতে না পেরে। শরতের রথে ভাবনাগুচ্ছকে চড়িয়ে শুভ্রবসনা রজনীগন্ধার মতো একরাশ তন্বী মেঘের সঙ্গী হওয়ার সামান্যতম সুযোগও মেলেনি সেই শীতজর্জর বিলেতে। ওখানকার আনপ্রেডিক্টেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা হু হু করে উঠত। কোথায় রোদে ধোয়া নীলাভ নীলিমা! কোথায় মৃদুমন্দ ঠা-া ঠা-া বাতাসের মৃদু ছোঁয়া। শরত নিয়ে আপনার পাশের জনকেই কিছু বলতে বলুন। অবধারিতভাবে তিনি বলবেন, কাশবন আর শেফালির কথা, পরিষ্কার আকাশে ছোট ছোট ভেলার মতো শাদা মেঘেদের ভেসে বেড়ানোর কথা, আর শিশির-দূর্বার কথা। হাঁসফাঁস গরম থেকে বাঁচার কথাটিও উচ্চারণ করতে ভুলবেন না। এসবই সত্য, শরতের ট্রেডমার্ক। কিন্তু একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন, আপনার জীবনে, আরও স্পষ্ট করে বলি, আপনার মন ও মননে শরৎ কোন্ আশ্চর্য জানালা খুলে দেয়! সেই জানালা দিয়ে মনের চোখে তাকালে আপনি হয়ত পেয়ে যান এক নতুন ভুবনডাঙাকে, নতুন বীজধানের মতো নতুন দিনের স্বপ্নকে। ভেবে দেখুন তো আমি অসত্য বলেছি কিনা? হ্যাঁ, এখানেই শরতের স্বাতন্ত্র্য। আত্মঘাতী বৃক্ষবিনাশ গাছ বাঁচানোর খবর পেয়ে ভাল লাগল। বাস্তুহারা লাখ লাখ বাংলাদেশী শরণার্থী যশোর রোড ধরে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, তাই যশোর রোডের দুপাশের শতবর্ষী গাছগুলো ইতিহাসের সাক্ষী। সেই গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্তে ঢাকায় প্রতিবাদ হয়েছিল। এলাকাবাসী, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীদের দাবির প্রতি একাত্ম হয়ে গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে এসেছে। গাছগুলো না কেটেই সড়ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু হচ্ছে। সব ঠিক থাকলে আগামী অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু হবে। শেষ হবে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ইতিহাস বলছে, প্রায় ২০০ বছর আগে যশোর অঞ্চলে কালী প্রসন্ন রায় নামে এক জমিদার ছিলেন। ১৮৪০ সালে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি। তাঁর ব্যবস্থাপনায় হাজার হাজার শ্রমিক দিন-রাত কাজ করে ১৮৪২ সালে সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ করেন। সেই পথেই পরবর্তী সময়ে এসব গাছ লাগানো হয়। সওজ ও জেলা পরিষদের হিসাব বলছে, যশোর রোড হিসেবে পরিচিত যশোর- বেনাপোল মহাসড়কটির উভয় পাশে রেইনট্রি, মেহগনি, বাবলা, খয়ের, কড়ই, আকাশমণি, বট, শিশু, ঝাউ, আম, কাঁঠাল, সেগুন, শিমুল ও দেবদার মিলিয়ে মোট গাছ রয়েছে ২ হাজার ৩১২টি। এর মধ্যে ১০০ বছরের বেশি পুরনো রেইনট্রি রয়েছে ৭৪৫টি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাঝেমধ্যে গাছ কেটে ফেলা হয়। কেন গাছ কাটার কথা মনে এলো সেটিই বলছি। উত্তরা থেকে নিউ ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবনে আসার পথে ডানদিকে জসীমউদদীন রোড থেকে বিমানবন্দর বাসস্টপেজ পর্যন্ত শত শত দীর্ঘদেহী গাছ দেখতাম। গত এক সপ্তাহে তার বেশির ভাগই কেটে ফেলা হয়েছে। বিআরটি বা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের কাজের জন্য একসঙ্গে তিন-চারশ’ গাছ কুঠারের আঘাতে অনুপস্থিত হয়ে গেছে। মানুষের প্রয়োজন এভাবেই কালে কালে প্রকৃতিকে আঘাত করেছে। তবে অপ্রয়োজনে মানবসখা অক্সিজেনদায়ী বৃক্ষ বিনাশ হলে মানুষের নিষ্ঠুরতা ও অর্থলোভের দিকটিই বড় হয়ে দেখা দেয়। পয়ঃনিষ্কাশন লাইন বসানোই শুধু নয়, আজগুবি সব দোহাই দিয়ে গাছ কাটা চলতে দেখেছি আমরা। এমনিতেই ঢাকায় গত দুই দশকে গাছের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। তার ওপর এভাবে নির্বিচারে গাছ কাটা চললে শহর তার সবুজাভা হারাবে। বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সঙ্কটের কথা না হয় থাক, কিন্তু শান্তিময় ছায়া আর তাপহরাবান্ধব যে কমে যাবে, সে কথা আর বলে কী হবে! বৃক্ষহন্তারকদের আমরা থামাব কিভাবে? আমরা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ভেতরের শত গাছ কাটার অজুহাত শুনে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। গাছের জন্য হাসপাতালের দেয়াল দেখা যায় না, তাই হঠাও গাছ। কেউ শুনেছে কোথাও এমন আজগুবি কথা! রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান প্রসঙ্গে আসা যাক। পশ্চিমা দেশের ‘এ্যাডাপ্ট আ রোড’-এর ধরনে গুলশানের ১৪৮টি সড়ক দত্তক নিলেন ১৪৮ জন গুলশানবাসী। প্রতিটি সড়কেই পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেয়া হলো যার বেতন মেটান সংশ্লিষ্ট সড়ক ‘দত্তক’ নেয়া এলাকাবাসী। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তরের মেয়র অনেক অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন এলাকাবাসী ফেসবুকে জানালেন, মেয়র গুলশানে গাছ কাটার কথা স্বীকার করে নাকি বলেছেন, অনেক গাছ তাকে কাটতে/নষ্ট করতে হয়েছে প্রয়োজনে। বললেন গাছ কাটায় রাস্তা নাকি এখন অনেক বড় দেখায়! ১৯৯৯ সালের কথা বলছি। বিষয়টি আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। ঢাকার জিরো পয়েন্টের খুব কাছে অবস্থিত ওসমানী উদ্যানের গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হলো। নাগরিক সমাজের পক্ষে পরিবেশসচেতন ব্যক্তিরা এর প্রতিবাদ করলেন। গাছ কাটার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা যৌক্তিক মনে হয়েছিল। এতে সরকারের বিব্রত হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু বিরোধী দল এটাকেই ইস্যু করেছিল সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্টের। গাছগুলো প্রাণে বেঁচে যাওয়ায় স্বস্তি পেয়েছিলাম। গাছ বাঁচানোর জন্য মানববন্ধন হয়েছিল। এখন সেই ওসমানী উদ্যানের কী হাল হয়েছে তার খবর কি সেই গাছ রক্ষার আন্দোলনকারীরা রাখেন? জানি না, রাখেন কিনা। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের একটি প্রতিবেদনে ওসমানী উদ্যানের করুণ দশা সম্পর্কে জেনে কষ্ট পেয়েছিলাম। উদ্যানে কেউ করছেন হাঁস-মুরগির ব্যবসা, আবার কেউ করছেন ছাগলের ব্যবসা। নির্মল বায়ু নেয়ার বদলে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে উদ্যানটি। তরুণ সাংবাদিক কাজী রফিকুল ইসলামের একটি প্রতিবেদনে রাজধানীতে গাছ কাটার একটি আংশিক চিত্র পেলাম। তিনি লিখেছেন, রাজধানীতে ১০ কিলোমিটারে উধাও পাঁচ হাজার গাছ। রাজধানীর গাবতলী থেকে লালবাগ কেল্লা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তায় সরকারী গাছের সংখ্যা থাকার কথা ১০ হাজার। কিন্তু সেখানে গাছ গুণে পাওয়া গেছে ৫৩৫৬টি। ২০১২ গাবতলী বেড়িবাঁধ থেকে লালবাগ পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে রোপণ করা হয়েছিল গাছগুলো। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন দিন কমেছে গাছের সংখ্যা। শঙ্কা আছে বর্তমানে টিকে থাকা গাছের ভবিষ্যত নিয়েও। গাবতলী গরুর হাট থেকে শুরু করে সুনিবিড় হাউজিং (স্লুইসগেট) পর্যন্ত এলাকায় উধাও হয়েছে সবচেয়ে বেশি গাছ। সেখানে গাছ কেটে বসানো হয়েছে বালুর গদি। তৈরি করা হয়েছে দোকানপাট। গরুর হাট থেকে দ্বীপ নগর এলাকা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশেই রাখা হয় ট্রাক। আর ট্রাক রাখতে ও বের করতে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে গাছ। ট্রাক রাখার প্রয়োজনে খেয়াল খুশি মতো ট্রাকের ধাক্কায় ভেঙে ফেলা হয়েছে গাছগুলো। আছে রাতে গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার মতো অভিযোগও আছে। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ [email protected]
×