ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ শিক্ষায় প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অভিমত ॥ শিক্ষায় প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ

’বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, যা ঐ বছর ১৭ সেপ্টেম্বর পরিণতি লাভ করে, আজ তা’ ছাপ্পান্ন বছরে পদার্পণ করল। দুঃখ হয় শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অর্জন সত্ত্বেও বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী দিনটি আজও জাতীয় শিক্ষা দিবসের স্বীকৃতি পায়নি। তারপরও শিক্ষা দিবসে শিক্ষা নিয়ে ভাবনা, প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আজকের এ লেখা। কুদরাত-এ-কুদা শিক্ষা কমিশনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকে, বিশেষ করে বিগত অর্ধ দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অর্জন সম্ভব হয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঐ বছরের ও এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি করা হয় এবং এ কমিটি চার মাসের মধ্যে একটি খসড়া শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এদেশে এই প্রথম কোন শিক্ষানীতি ঘোষণার পর তার বিরুদ্ধে কোন মিছিল, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হয়নি। এমনকি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, দু’জন তাত্ত্বিক শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, শিক্ষানুরাগী বিভিন্ন স্তরের মানুষ অনুমোদিত শিক্ষানীতিকে স্বাগত জানান। তাঁরা বলেন, শিক্ষানীতি মোটামুটি যুগোপযোগী ও আধুনিক। তবে এর বাস্তবায়ন কঠিন হবে। আমাদের দেশে এ ধরনের ঐকমত্যের উদাহরণ বিরল। প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি ৯ম জাতীয় সংসদের ৭ম অধিবেশনে আলোচিত হয়ে ০৭ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্জনের মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠপুস্তক বিতরণ, ১৭ বছর পূর্বে প্রণীত কারিকুলাম সংস্কার, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রবর্তন, শিক্ষা বর্ষের প্রথম দিনে ক্লাস শুরু, পরীক্ষার ফল প্রকাশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু, মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন, কারিগরি শিক্ষা সংস্কার, কোচিং বাণিজ্য বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ, অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অনুকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষায় পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ইত্যাদি। ছাত্রী উপবৃত্তির পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে দরিদ্র ছাত্রদের জন্য উপবৃত্তি চালু, যুবশক্তিকে অধিকহারে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কোর্স চালু, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের অনুরূপ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রেও জেন্ডার বৈষম্য হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। তবে সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহার, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে প্রকৃত অগ্রগতি নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শিক্ষা ও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অর্জনের বিভিন্নমুখীনতা মেনে নিয়েও বিরাজিত চ্যালেঞ্জগুলোও বলা চলে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। যেমন: ১. শিক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প বরাদ্দ। ২. শিক্ষকতা পেশার প্রতি মেধাবীদের আকর্ষণহীনতা ৩. মেধার অপচয় ও পাচার। ৪. আশঙ্কাজনকহারে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস। ৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় নানা অসঙ্গতি ও ত্রুটি বিচ্যুতি। ৬. শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ফলপ্রসূ তদারকির অনুপস্থিতি, সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতি। ৭. অনুল্লেখযোগ্য অথবা নাম মাত্র শিক্ষক প্রশিক্ষণ। ৮. পাঠদানে শিক্ষকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের অদক্ষতা। ৯. শিক্ষকদের একাংশের হাতে শিক্ষার্থীর শারীরিক শাস্তি, মানসিক নির্যাতন। ১০. শিক্ষকদের একাংশের নৈতিক অবক্ষয়। ১১. শিক্ষা আইন ২০১০ বাস্তবায়নে ধীর গতি। ১২. শিক্ষাক্রম/পাঠসূচীর সঙ্গে কর্মসংস্থান/শ্রমবাজারের সংশ্রবহীনতা। ১৩. শিক্ষাসংক্রান্ত তথ্য পরিসংখ্যানে অসঙ্গতি। ১৪. শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকও প্রশাসনের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ ও সংযোগহীনতা। ১৫. শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার সর্বত্র স্বজনপ্রীতি ও দলীয়/কোটারী স্বার্থ রক্ষার প্রবণতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে ৪টি মোটাদাগের ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে তা হলো, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের সাধারণ নির্বাচন। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণে দিনটি আমাকে ছাপ্পান্ন বছর আগের ঘটনাবহুল দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন পরাধীন দেশে আমরা একটি গণমুখী শিক্ষানীতির দাবিতে আন্দোলন করেছিলাম। একথা সত্য মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক বাধা পার হয়ে আমরা কাক্সিক্ষত শিক্ষানীতি পেয়েছি। শিক্ষায় আমাদের অর্জনও কম নয়। এমডিজিতে সাফল্য উল্লেখযোগ্য। এসডিজি ৪ অর্জনে কাজ শুরু হলেও শিক্ষক, অভিভাবকের অংশগ্রহণ এখনও সেভাবে উল্লেখ করার মতো নয়। শিক্ষায় অনেক অর্জনের পরও চ্যালেঞ্জের তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। সে জন্য শিক্ষাকে ভিত্তি করে সামনে এগিয়ে চলার অপরিহার্যতায় শিক্ষা দিবসের চেতনা, প্রেরণা ও নির্দেশনা দীর্ঘদিন আমাদের পথ চলায় আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। লেখক : শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য [email protected]
×