ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিষাক্ত সোডিয়াম সালফেট খাবার লবণ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে ॥ জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিষাক্ত সোডিয়াম সালফেট খাবার লবণ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে ॥ জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে

এম শাহজাহান ॥ মানবদেহের জন্য বিষাক্ত সোডিয়াম সালফেট দিয়ে তৈরি হচ্ছে খাবার লবণ। শিল্পকারখানায় ব্যবহার হয় বলে সোডিয়াম সালফেট সহজে আমদানি করা যায়। আমদানিতে শুল্কহারও কম। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে লবণের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে সোডিয়াম সালফেট দিয়ে। আইনের বাধ্যবাধকতা না থাকায় দেশে অবাধে আনা হচ্ছে সোডিয়াম সালফেট। অন্যদিকে, সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাবার লবণ আমদানি নিষিদ্ধ। তবে উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিলে ওই লবণ বিদেশ থেকে আমদানির সুযোগ দেয়া হয়। কাঁচামাল সঙ্কটে দেশের ২ শতাধিক লবণ মিল এখন বন্ধ। খাবার লবণ হিসেবে দেশে বাজারজাতকরণ হচ্ছে সোডিয়াম সালফেট। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, চাহিদা বাড়লেও উৎপাদনের জমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় প্রতিবছর দেশে লবণ উৎপাদনের পরিমাণ কমছে। অন্যদিকে শিল্পকারখানায় লবণের চাহিদা বাড়ছে। বছরে ২০ লাখ টনের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় সাড়ে ১৪ লাখ টন। ফলে সাড়ে ৫ লাখ টন ঘাটতির বিষয়টি মাথায় রেখে প্রতিবছর কোরবানির আগে লবণ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে। ঘাটতি থাকলেও এ বছর লবণ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়নি। বর্তমান প্রতিকেজি লবণ মানভেদে ২৫-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। সোডিয়াম সালফেট দিয়ে তৈরি এসব লবণ বাজারজাতকরণ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আমদানি নীতি ২০১৫-১৭ অনুযায়ী সোডিয়াম ক্লোরাইড (খাবার লবণ) আমদানি নিষিদ্ধ। আবার সোডিয়াম ক্লোরাইডের তুলনায় সোডিয়াম সালফেট আমদানিতে ডিউটি কম। তাই এক শ্রেণীর অসৎ আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী এই সুযোগটি নিচ্ছেন। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তারা সোডিয়াম সালফেট আমদানির ঘোষণা দিয়ে সোডিয়াম ক্লোরাইডের সঙ্গে সোডিয়াম সালফেট মিশ্রিত করে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন খাবার লবণ হিসেবে। ইতোপূর্বে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় থাকা ২ হাজার টন বিষাক্ত লবণ আটক করা হয়। পরে তা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে। পরীক্ষার পর তাদের দেয়া প্রতিবেদনে দেখা যায়, জব্দকৃত লবণে সোডিয়াম ক্লোরাইডের পরিমাণ ৯১ দশমিক ৫ শতাংশ, সোডিয়াম সালফেট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং আর্দ্রতার পরিমাণ ১ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোঃ নুরুল আমিন বলেন, সোডিয়াম ক্লোরাইডের (খাবার লবণ) সঙ্গে সোডিয়াম সালফেট মিশ্রিত হলে তা খাওয়া যাবে না। এই মিশ্রণটি মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তিনি বলেন, সোডিয়াম সালফেট সাধারণত পেপার মিল, টেক্সটাইল মিল, ডিটারজেন্ট তৈরিতে, ড্রাইং এজেন্ট (কাপড় পরিষ্কার) হিসেবে এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিসহ বিভিন্ন কলকারখানায় ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি মানবদেহের কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়াও নারী ও শিশুদের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জানা গেছে, ঘাটতি পূরণে লবণ আমদানির অনুমতি প্রদানের জন্য সম্প্রতি বিসিক থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সম্প্রতি চলতি বছরের লবণ উৎপাদনের হিসেব নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, ট্যারিফ কমিশনও লবণের মজুদ, বাজার পরিস্থিতি, উৎপাদন, চাহিদা ও আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমদানির পাশাপাশি দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর ৪-৫ লাখ টন লবণ অবৈধভাবে আনা হয়ে থাকে। লবণ শিল্পের মিল মালিকরা বলছেন, উৎপাদনের জমি প্রতিবছর ব্যাপকহারে হ্রাস পাচ্ছে। লবণ উৎপাদর এলাকা মহেশখালী-মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র এলএনজি টার্মিনাল এবং অন্যান্য শিল্প গড়ে উঠার কারণে লবণ উৎপাদনের জমি সংকোচিত হয়ে আসছে। তাদের মতে, দেশে বর্তমান ৫০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে। যদিও বিসিকের তথ্যমতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে ৬০ হাজার একর জমি ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ লবণ মিল সমিতির তথ্যমতে, দেশে লবণের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান শিল্প উন্নয়ন বিশেষ করে চামড়া শিল্প, ডিটারজেন্ট শিল্প, ডাইং প্রিন্টিং, হোটেল শিল্প, ওষুধ শিল্প বেভারেজ শিল্প আচার, মুড়ি, চানাচুর, বেকারি ও পাওয়ার প্লান্ট প্রভৃতিখাতে লবণের প্রয়োজন প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন। প্রাণিসম্পদ ও হরটিকালচার খাতে ৩ লাখ মেট্রিক টন, মৎস্য ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ৫০ হাজার মেট্রিক টন, ভোজ্যলবণ ৯ লাখ মেট্রিকটন এবং বরফ, পোল্ট্রি ফিড ও অন্যান্য খাতে ৫০ হাজার মেট্রিকটন লবণের চাহিদা রয়েছে। এ হিসেবে বছরে লবণের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ মেট্রিকটন। এদিকে বিসিকের তথ্যমতে দেশে লবণের চাহিদা ১৪ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে শিল্পখাতে পৌনে চার লাখ এবং ৮ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন ভোজ্য লবণের চাহিদা দেশে রয়েছে। তাদের এই তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতি ও ট্যারিফ কমিশন। ফলে দেশে লবণের চাহিদা ও ঘাটতির তথ্য নিয়েও এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। বাংলাদেশ লবণ মিল সমিতির সভাপতি নুরুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, সাধারণত সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাবার লবণ আমদানি নিষিদ্ধ। খাবার লবণ সাধারণত দেশেই উৎপাদিত হয়। তবে কখনো দেশে লবণের উৎপাদন কম হলে ঘাটতি লবণ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। অন্যদিকে যে কেউ ইচ্ছে করলেই সোডিয়াম সালফেট আমদানি করতে পারেন। অনেক অসৎ আমদানিকারক প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে বাকিটা খাবার লবণ বলে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। অথচ কাঁচামাল সঙ্কটে এ খাতের ২ শতাধিক মিল বন্ধ থাকলে সরকার ঘাটতি লবণ আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না। এতে করে সোডিয়াম সালফেট খাবার লবণ হিসেবে বাজারকরণ করা হচ্ছে। তিনি সোডিয়াম সালফেট আমদানি নীতিমালা তৈরির পাশাপাশি এর ব্যবহারের ওপরও নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিসিক চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান সম্প্রতি শিল্পমন্ত্রণালয়ে লবণ সংক্রান্ত এক বৈঠকে বলেন, লবণের হালনাগাদ চাহিদা ও মজুদ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে লবণ আমদানি বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হবে। তিনি বলেন, লবণের বাজার মূল্য বিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ করা হচ্ছে। এ অভ্যাস থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসার মনোভাব তৈরি করতে হবে। অবৈধভাবে সোডিয়াম সালফেট আমদানি রোধে বিসিক এবং জাতীয় রাজম্ব বোর্ড একত্রে কাজ করতে পারে। তিনি বলেন, এ খাতকে সহযোগিতা করা।
×