ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ত্রাণ চাই না, পুনর্বাসন চাই

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ত্রাণ চাই না, পুনর্বাসন চাই

আবুল বাশার, নড়িয়া থেকে ফিরে ॥ শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙ্গনের তীব্রতা কিছুটা কমে এসেছে। পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ৪ দিন ধরে ভাঙ্গন পরিস্থিতি প্রায় স্থিতিশীল রয়েছে। স্রোতের তীব্রতা কমানো ও গতিপথ পরিবর্তনের জন্য মঙ্গলবার থেকে নদীতে ২টি ড্রেজিং মেশিন কাজ শুরু করছে বলে নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ত্বরিতগতিতে নদীতে এই ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করা হয়েছে বলে তিনি জানান। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পদ্মার ডান তীর ঘেঁষে চলা প্রচণ্ড স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন করে মাঝ নদীতে নিয়ে যাওয়া হবে এবং এর ফলে সাময়িকভাবে ভাঙ্গন প্রতিরোধ হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে পদ্মায় ভাঙ্গনকবলিতরাসহ শরীয়তপুরের মানুষ। মঙ্গলবার নড়িয়াতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম, এমপি উপস্থিত থেকে ভাঙ্গনকবলিত ৫ হাজার ৮১ পরিবারের মধ্যে ৩০ কেজি করে চাল, ডাল, লবণ, তেলসহ শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন। নড়িয়া উপজেলা সদরে শহীদ মিনার চত্বরে ত্রাণ বিতরণের আগে এক সমাবেশে মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ ভা-ারে খাদ্যের কোন অভাব নেই। অপনাদের যা প্রয়োজন তাই দেয়া হবে। তবে যেন স্বজন প্রীতি না হয়। মন্ত্রী নদী ভাঙ্গনকবলিতদের জন্য আরও ৫ হাজার বান্ডিল ঢেউটিন, ২ কোটি টাকা ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহেরের সভাপতিত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী, শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামূল হক শামীম, সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট নাভানা আক্তার প্রমুখ। এদিকে মঙ্গলবার ভাঙ্গনকবলিত নড়িয়ার বাঁশতলা, মূলফৎগঞ্জ ও সাধুর বাজার এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নদী ভাঙ্গনে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে শত শত মানুষ। সারা জীবনের কষ্টার্জিত টাকায় গড়া সাজানো গোছানো সংসার পদ্মার কড়াল গ্রাসে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কারো থাকার ঘর নেই, কারো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। ভাঙ্গনকবলিত এলাকায় নেই বিদ্যুত সংযোগ, নেই যোগযোগ ব্যবস্থা, নেই রাস্তা-ঘাট। সবই নদীতে গিলেছে। ভেঙ্গে পড়েছে শিক্ষা আর চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, মানুষের স্বাভাবিক মৌলিক অধিকারগুলো না থাকায় থমকে গেছে জীবনযাত্রা। কেউ কেউ তাদের ঘরদরজা ভেঙ্গে রাস্তার পাশে, কেউ অন্যের বাড়িতে ফেলে রেখেছে। কয়েকদিন আগেও যারা ছিল এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি, বাস করত সুরম্য চাকচিক্য ৩তলা, ৪তলা ভবনে, তারা আজ রাস্তায় ভাসমান অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন দেওয়ান জানান, তার বাড়িতে দ্বিতল ভবন, মূলফৎগঞ্জ বাজারে ৩তলা ভবনে ক্লিনিক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন তিনি ভূমিহীনদের কাতারে এসে গেছেন। নড়িয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র মরহুম হায়দার আলীর বাড়ির বাগানে আশ্রয় নিয়েছে পূর্ব নড়িয়া এলাকার ভাঙ্গনকবলিত ২০টি পরিবার, উত্তর কেদারপুর ভুঁইয়া বাড়ির পাশে ১০টি পরিবার, একই এলাকার সুমন শরীফের মাঠে ১০টি পরিবার, কেদারপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ২০টি পরিবার ও কলুকাঠি গ্রামে ২০টি পরিবারসহ বিভিন্ন স্থানে শত শত পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদের অনেকেই অর্থের অভাবে ঘর তুলতে পারেনি। নদী ভাঙ্গা ঘর দরজা নিয়ে তারা অন্যের বাড়ির বাগানে, কেউ বা রাস্তার পাশে টিনের ছাবড়া করে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা অনাহারে-অর্ধহারে দিন কাটাচ্ছে। তাদের কাজ-কর্ম নেই, নেই রোজগারের কোন উপায়। তাই তারা অন্যের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তারা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছে, নদী ভাঙ্গা শুরু থেকে দুবার সরকারী ২৫ কেজি করে চাল ও কেউ কেউ শুকনো খাবার পেয়েছে। যা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তারা অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। আশ্রয়হীন রাজিয়া বেগম বলেন, সর্বনাশা পদ্মা নদী আমার ১২ শতাংশ বাড়ি গ্রাস করে নিয়েছে। আমরা এখন হায়দার চৌকিদারের বাগানে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমাদের দেখার কেউ নেই। এদিকে সর্বশেষ সরকারী হিসাবানুযায়ী গত ২ মাসে প্রমত্তা পদ্মা নদীর অব্যাহত তীব্র ভাঙ্গনে এ পর্যন্ত গৃহহীন হয়েছে ৫ হাজার ৮১টি পরিবার। তবে বেসরকারী হিসাবে এ পরিসংখ্যান আরও কিছুটা বেশি হবে বলে ভাঙ্গনকবলিতরা জানিয়েছেন। পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়ন, কেদারপুর ইউনিয়ন, ঘড়িসার ইউনিয়ন, চর আত্রা ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভার ২নং ও ৪নং ওয়ার্ডে ক্ষতিসাধন হয়েছে। পদ্মার ভাঙ্গনে কয়েকটি গ্রাম, ১টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাঁশতলা বাজার, সাধুর বাজার, ওয়াপদা লঞ্চঘাট, সাধুর বাজার লঞ্চঘাট, মূলফৎগঞ্জ বাজারের একাংশ, নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবন, ২টি বেসরকারী ক্লিনিক, গাজী কালু দরবার শরীফের পাঁচতলা বিশিষ্ট মেহমানখানা ভবন, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা নুসা বিশেষায়িত প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, কয়েকটি মসজিদ, মন্দিরসহ কয়েকশ’ কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, কয়েকটি ব্রিজ-কালভার্টসহ ৫ কিলোমিটর পাকা সড়ক নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ বছর জুলাই মাসের শেষের দিকে নড়িয়া সদর থেকে সুরেশ^র পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন শুরু হয়। নড়িয়ার বাঁশতলা এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে। ভাঙনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে মূলফৎগঞ্জ ও সাধুর বাজার এলাকায়। ভাঙনের তীব্রতায় আতঙ্কিত হয়ে নিজেদের সাজানো-গোছানো ঘরবাড়ি নিজেরাই ভেঙ্গে অন্যত্র নিরাপদে সরাতে থাকে পদ্মা পাড়ের মানুষ। কিন্তু অনেকেরই শেষ রক্ষা হয়নি। টাকার অভাবে অনেকেই ঘরবাড়ি ভেঙ্গে সরাতে পারেনি। অনেকেই দেড়/২ লাখ টাকার ঘরবাড়ি মাত্র ১০/১২ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে। ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২ কিলোমিটার প্রস্থ এলাকা জুড়ে সর্বকালের ভয়াবহ এ ভাঙ্গনে দিনের পর দিন নদীতে হারিয়ে যায় ৩শ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মূলফৎগঞ্জ বাজারসহ বহু সুরম্য প্রাসাদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, ব্রিজ-কালভার্ট, গাছপালা, ফসলি জমি, বসতবাড়ি সব কিছু। ভেঙ্গে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। সর্বস্ব হারিয়ে আহাজারি ও কান্নায় মানুষ যেন পাথর হয়ে গেছে। গৃহহীন এসব পরিবার নড়িয়া উপজেলাধীন হায়দার চেয়ারম্যানের বাগানবাড়ি, বাড়ৈ পাড়া, স্বপন মাঝির বাগানবাড়ি, ভূঁইয়া বাড়ির মাঠ ও দাসপাড়া নামক এলাকায় ছোট ছোট ঘর তুলে বা মাঁচান দিয়ে ঘর তুলে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকেই জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকেই তাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে রাস্তার পাশে বা অন্যের ভূমিতে রেখে দিয়েছে। এদিকে ভাঙ্গনকবলিতরা জানিয়েছেন, তারা সরকারের কাছে কোন ত্রাণ চায় না, তারা চায় পুনর্বাসন।
×