ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তাহিরা খাতুন সান্ত¡না

ক্রিকেট ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত তামিমের

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ক্রিকেট ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত তামিমের

ক্রিকেট খেলাটা চমকে ভরা। আর প্রতিপক্ষকে চমকে দিতে পারলে সাফল্য অনিবার্য। তাই এই খেলাটিকে বলা হয়ে থাকে ব্যাট-বলের লড়াইয়ের চেয়েও মনস্তাত্ত্বিক! পদে পদে এখানে মানসিক লড়াই চলে দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে। সেই লড়াইয়ে যে ক্রিকেটার বিস্ময়কর কিছু করেন, সেটি ব্যাট-বল হাতেই হোক কিংবা মানসিক লড়াইয়েই হোক- তিনি হয়ে যান মহানায়ক! বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অনেক আগে থেকেই অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে গেছেন তামিম ইকবাল। বাঁহাতি এ ওপেনার এবার এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যা করেছেন, সেটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। মাত্র ৪ বলে ২ রান করেও বীর হওয়া যায় সেটারই এক বিরল নজির স্থাপন করেছেন তিনি। ব্যাটিংয়ের সময় বাঁ হাতে আঘাত পেয়ে মাঠ ছেড়ে হাসপাতালে গেছেন এবং ব্যান্ডেজ বেঁধেই নবম উইকেট পতনের পর উইকেটে নেমে এক হাতে ব্যাটিং করেছেন। দেশপ্রেমের দারুণ এ উৎসর্গ করে তিনি বাকি ক্রিকেটারদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে গেছেন। দেশের ক্রিকেটে যখন একের পর এক তারকার কলঙ্কজনক আচরণ কলুষিত করছিল, তখনই ক্যারিয়ারের চিন্তা না করে নিজেকে নিবেদন করেছেন দলের সুবিধার জন্য। আর এটি দলকে যেমন উজ্জীবিত করেছে, তেমনি দেশকেও করেছে গর্বিত। অপরিহার্য এ ব্যাটসম্যানের বিকল্প শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেই নয়, ক্রিকেটীয় মানসিকতায়ও বিকল্প নেই তা প্রমাণ হয়ে গেছে। প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিতে চাইলে তাদের সঙ্গে ব্যাট-বল ছাড়াও খেলতে হয় মানসিক খেলা। সেটি তামিম খেলেছেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। আর তাতেই বিমূঢ় হয়ে গেছে লঙ্কানরা। দলের বিধ্বস্ত চেহারার মধ্যে ১৫০ বলে ১৪৪ রানের একটি অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে জয়ের নায়ক ছিলেন মুশফিকুর রহীম। তবে আশ্চর্য বীরত্ব দেখিয়েছেন এক আহত সেনানী। সেই অভূতপূর্ব বীর তামিম ইকবাল খান। যে কোন লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এগিয়ে যেতে অভাবনীয় কোন চমক দেখাতে হয়, সেটি করেছেন তামিম। বাংলাদেশ ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই হাতের কব্জিতে আঘাত পাওয়ার পর সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে ব্যান্ডেজ করে এসেছিলেন। আবারও উইকেটে নামা দূরের কথা, প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছিল অন্তত ৬ সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকতে হবে তাকে। কিন্তু নবম উইকেট পতনের পর আবারও মাঠে নেমে এক হাতে ব্যাটিং করে প্রতিপক্ষকে বিমূঢ় করে দেন তিনি। দলকে ভাল অবস্থানে নিয়ে যেতে, নিখাঁদ দেশপ্রেমের অনন্য নজির স্থাপন করে এখন দেশবিদেশে আলোচিত তিনি। কারণ, কোনভাবে আরেকটি আঘাত পেলেই ক্যারিয়ার পুরোপুরি শেষ হয়ে যেত। ৪ বলে ২ রান হয়তো পরবর্তীতে স্কোরকার্ড দেখলে তার এই উৎসর্গ উপলব্ধি করা যাবে না। মারাত্মক ইনজুরি নিয়েও এমন ঘটনার জন্ম দেয়া ক্রিকেট ইতিহাসে আরও ছিল। কিন্তু এক হাতেই ব্যাটিং করার এমন নজির আর নেই। এটিই এখন এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের জন্য বড় অনুপ্রেরণা। ক্রিকেট ইতিহাসে এমন ঘটনা আগেও দেখা গেছে। ১৯৮৪ সালে লিডসে ম্যালকম মার্শাল এক হাতে আঘাত পেয়ে অন্যহাতে ব্যাটিং করেন। তারও আগে এডি পেইন্টার টনসিল নিয়ে ব্রিসবেনের হাসপাতাল থেকে গ্যাবায় গিয়ে ৮৩ রানের ইনিংস খেলে দলকে লিড এনে দেন। এরপর আবার হাসপাতালে ভর্তি হন। ফিরে এসে আবার জয়সূচক রান করেছেন তিনি। অসি ব্যাটসম্যান রিক ম্যাককাস্কার বব উইলিসের বলে চোয়াল ভেঙ্গে রক্তাক্ত হয়েছিলেন, ঘাড়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে তিনিই পরে ১০ নম্বরে ব্যাট হাতে নেমেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মারভিন ডিলনের বাউন্সারে ভারতের অনিল কুম্বলের চোয়াল ভেঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু মাথা থেকে ঘাড় বিস্তৃত ব্যান্ডেজ নিয়েই বোলিং করে ব্রায়ান লারার উইকেট নেন। ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ ইনজুরি আক্রান্ত হন অসি পেসার মিচেল জনসনের বলে। সিডনিতে এরপরও তিনি ব্যাটিংয়ে নেমে যান। ১৯৮৬ সালে ওয়ামিস আকরাম যেন অর্ধশতক করতে পারেন সেজন্য ডানহাতি সেলিম মালিক ইনজুরির কারণে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যাটিং করেন। তামিম তাদের চেয়েও ভিন্ন কীর্তি গড়েছেন শুধু এক হাতে ব্যাট ধরে। সম্প্রতি সাব্বির রহমান, নাসির হোসেন, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের ব্যক্তিগত অন্ধকার চারিত্রিক আচরণগুলো বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সমালোচনার মুখে ঠেলে দিয়েছিল। দেশের প্রতি টান থাকলে কেউ তারকা খ্যাতি নিয়ে এমন অপরাধকর্ম করতে পারে? অন্য ক্রিকেটারদের দিকেও সন্দেহের তীর ছুটে যেতে শুরু করেছিল। কিন্তু ক্রিকেটাররা তো দেশের জন্যই খেলেন। সেটার প্রমাণ দিয়েছেন তামিম। সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে এবং বর্তমান বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েও উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। স্কানে তামিমের তর্জনির আশপাশে বেশ কয়েকটি চিড় ধরা পড়ে এবং একটি হাড়ও সামান্য স্থানচ্যুত হয়েছে। ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত স্লিংয়ে ঝুলিয়ে মুশফিকের একক সংগ্রাম দর্শক হয়ে দেখছিলেন তামিম। তবে অধিনায়ক মাশরাফি জানিয়েছিলেন, যদি মুশফিক স্ট্রাইকে থাকেন সেক্ষেত্রে নন-স্ট্রাইকিংয়ে নামানো হবে তাকে শুধু সঙ্গ দেয়ার জন্য। কিন্তু ৪৭তম ওভারের পঞ্চম বলে মুস্তাফিজুর রহমান নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়ে যাওয়ার পর এক হাতেই ব্যাটিং করতে নেমে যান তামিম, মোকাবেলা করেন সেই লাকমালের ওভারের শেষ বলটি। তার মোকাবেলা করা একটি বলের কারণে আরও ৩২ রান যোগ হয়েছে বাংলাদেশের। হতবিহ্বল শ্রীলঙ্কার পরিকল্পনা ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে মুশফিক ব্যাট হাতে ঝলসে ওঠেন, ১৫ বলে তুলে নেন ওই ৩২ রান। তামিম নিজ সিদ্ধান্তেই নেমেছিলেন। ৪ বলে ২ রান করেছেন, কিন্তু সেটিই অনেক বড় অনুপ্রেরণা হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। ১৫০ বলে ১৪৪ রানের অতিমানবীয় ইনিংস খেলা মুশফিকও এ বিষয়ে পরে বলেন, ‘তামিমকে দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছি এবং আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি। তখনই উপলব্ধি করি তার জন্য এবং দেশের জন্য আমার কিছু করতে হবে।’ অধিনায়ক মাশরাফিও বলেন, ‘সবাই এজন্য তামিমকে আজীবন মনে রাখবে। তাকে টুপি খোলা স্যালুট।’ ২০০৭ সালে ওয়ানডে অভিষেক হওয়ার পর থেকেই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে নিয়মিত তামিম। ১৮৩ ওয়ানডের ১৮১ ইনিংস ব্যাট করেছেন এবং সবগুলো ম্যাচেই ওপেনার ছিলেন। ইনজুরি ব্যতীত কখনও পারফর্মেন্সের কারণে বাদ পড়তে হয়নি তামিমকে। এর মধ্যে ইনিংসের প্রথম বল মোকাবেলা করেছেন ১৭৪ ইনিংসে, বাকি মাত্র ৭ ইনিংসে তিনি নন-স্ট্রাইকিংয়ে ওপেনার হিসেবে নেমেছেন। তবে মাঝে মাঝেই ইনজুরির কারণে তার বিকল্প হিসেবে ভিন্ন দুই ওপেনার নামাতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে তিনি ক্যারিয়ার শুরুর পর বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে ইমরুল কায়েস-এনামুল হক বিজয়, এনামুল-শামসুর রহমান, ইমরুল-সৌম্য ও ইমরুল-লিটনকে দেখা গেছে। তামিম না থাকলেই ওপেনিং নিয়ে সমস্যায় পড়ে বাংলাদেশ দল। ২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপে ইনজুরির কারণে তামিম একটি ম্যাচ খেলতে পারেননি, তখনও কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হয়েছিল বাংলাদেশ দলকে। এবারও সেই পরীক্ষা। তামিম থাকলে ওপেনিং নিয়ে কোন চিন্তাই থাকে না দলের। দেশের পক্ষে তিন ফরমেটেই সর্বাধিক সেঞ্চুরিসহ সর্বাধিক রানের মালিক অবশ্য ওপেনিং সঙ্গী হিসেবে বারবারই ভিন্ন ক্রিকেটার পেয়েছেন। সব মিলিয়ে তামিমের ওপেনিং সঙ্গী হয়েছেন এখন পর্যন্ত ১৪ জন। সেই তালিকায় এমনকি মুশফিকও আছেন! ২০০৯ সালের ১৮ আগস্ট বুলাওয়েতে তামিমের সঙ্গে ওপেনিং করে মুশফিক জুটিতে তুলেছিলেন ৪৩ রান। তামিম মাত্র ৪ রানে বিদায় নিলেও মুশফিক সেদিন ৯৮ রান করেছিলেন। এছাড়া জাভেদ ওমর (৬ বার), মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন (৯), শাহরিয়ার নাফিস (২৪), মোহাম্মদ আশরাফুল (৩), মেহরাব জুনিয়র (৪), শামসুর রহমান (১), নাঈম ইসলাম (২), মিঠুন (১), লিটন (২), জুনায়েদ সিদ্দিকী (২৫), এনামুল (২৬), সৌম্য (২৩) ও ইমরুল (৫৪) ছিলেন তামিমের ওপেনিং সঙ্গী। এর মধ্যে সর্বাধিক ৩১.৮১ গড়ে, ২ সেঞ্চুরি ও ৯ হাফসেঞ্চুরিসহ ১৭১৮ রান ইমরুলের সঙ্গেই করেছেন তামিম। কিন্তু ব্যাটিং গড়ে (অন্তত ৫ ম্যাচ) সৌম্যর সঙ্গেই এগিয়ে ছিলেন তিনি। সৌম্যর সঙ্গে দ্বিতীয় সর্বাধিক ৯০৩ রান করেছেন তিনি ৩টি শতক ও ৩টি অর্ধশতকসহ ৩৯.২৬ গড়ে।
×