ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণী আক্তার সান

কুকের ইতিহাসগড়া অবসর

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কুকের ইতিহাসগড়া অবসর

অবসরটা স্মরণীয় করে রাখলেন এ্যালিস্টার কুক। ইতিহাসের মাত্র পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি দিয়ে রাঙিয়েছেন আধুনিক ইংল্যান্ডের সফলতম এ ব্যাটসম্যান। প্রথম ইনিংসে ’৭১Ñএরপর দ্বিতীয় ইনিংসে উপহার দেন ১৪৭ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংস। অথচ ক্রমাগত ব্যর্থতায় মানসিক চাপের কথা স্বীকার করে ক’দিন আগেই বলেছিলেন, সমর্থকদের সঙ্গে আর প্রতারণা করতে চান না। বিদায় বেলায় সেই কুক প্রমাণ করলেন ‘ফর্ম ইজ টেম্পারারি বাট ট্যালেন্ট ইজ পার্মানেন্ট’। বিদায় বেলায় ভক্তদের আফসোস বাড়িয়ে নিজেও হলেন মোহাচ্ছন্ন। ওভাল টেস্টের চতুর্থ দিনে শেষ ইনিংসে আউট হওয়ার পর ৩৩ বছর বয়সী সুপার স্টার জানালেন, এটা ছিল তার জীবনের সেরা ‘পরাবাস্তব’ চার দিন। বিদায় বেলায় অসাধারণ সব কীর্তি গড়া কুক বলেন, ‘এটা সত্যিই আমার জীবনের সবচেয়ে পরাবাস্তব চার দিন। ওভাল টেস্টের শুরু থেকেই অবিশ্বাস্য সংবর্ধনা পেয়েছি। বিশেষ করে শেষ কয়েক ওভারে সমস্ত দর্শক যখন বর্মি আর্মির মতো গান গাইছিল, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। এ স্মৃতি আমি কখনও ভুলব না।’ তার আগে নিজের অবসর সম্পর্কে কুক বলেন, ‘গত কয়েক মাসে অনেক চিন্তা ও মতবিনিমময়ের পর, আমি ভারতের বিরুদ্ধে এই টেস্ট সিরিজ শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদিও আজ বিষাদের দিন তবুও আমি মুখে বড় হাসি নিয়ে ভাবতে পারছি, আমি আমার সর্বোচ্চটুকু উজার করে দিয়েছি। আর কিছু দেয়ার নেই।’ আর কুককে নিয়ে বর্তমান অধিনায়ক জো রুট বলেন, ‘কুকের মতো কাউকে ইংল্যান্ড ক্রিকেট আর দেখবে না। তার শূন্যস্থান পূরণ অনেক কঠিন হবে। ১২ বছর টপ অর্ডারে খেলে যাওয়া সামান্য কথা নয়। একজন ক্রিকেটার হিসেবে তার যোগ্যতার কাছাকাছি আমি কাউকে ভাবতে পারি না। তিনি তার ব্যাটিং দিয়ে একটি জগত, একটি মোহ তৈরি করেছেন। যা থেকে আমাদের বের হতে লম্বা সময় লাগবে। পেশার জন্য তিনি অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন যা উদাহরণ দেয়ার মতো।’ লন্ডনের কেনিংটন ওভালে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে বেশ কিছু কীর্তি গড়েন ইংল্যান্ড টেস্ট ইতিহাসের রেকর্ড সর্বাধিক রান ও সেঞ্চুরির মালিক। সংক্ষেপে সেগুলো দেখে নেয়া যাকÑটেস্ট ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক ও শেষ টেস্টের দুই ইনিংসেই ফিফটি-প্লাস রান করলেন কুক। এতদিন এই কীর্তি ছিল শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রুস মিচেলের। ২০০৬ সালে কুকের অভিষেকও হয়েছিল ভারতের বিপক্ষে, অভিষেকেও প্রথম ইনিংসে ফিফটির (৬০) পর দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন অপরাজিত সেঞ্চুরি (১০৪*)। এছাড়া ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি করা মাত্র পঞ্চম ক্রিকেটার কুক। এর আগে এই কীর্তি ছিল রেজি ডাফ, বিল পন্সফোর্ড, গ্রেগ চ্যাপেল ও মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের। এখানেই শেষ নয়, কুকের ১৪৭ রান ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ স্কোর। সাবেক ইংলিশ ব্যাটসম্যান রমন সুব্বা রাওয়ের ১৩৭ রান ছিল আগের সর্বোচ্চ। ১৯৬১ সালের আগস্টে এ্যাশেজে রাওয়ের ইনিংসটাও ছিল এই ওভালে। সেখানেই তার ৫৭ বছরের রেকর্ডটা ভেঙে দিয়েছেন কুক। কুকের ক্যারিয়ারের ৩৩ সেঞ্চুরির ১৫টিই দ্বিতীয় ইনিংসে। দলের দ্বিতীয় ইনিংসে যা কোন ব্যাটসম্যানের রেকর্ড সর্বোচ্চ। কুক ছাড়িয়ে গেছেন দ্বিতীয় ইনিংসে কুমার সাঙ্গাকারার ১৪ সেঞ্চুরিকে। টেস্টের তৃতীয় ইনিংসে কুকের সেঞ্চুরি ১৩টি, এটাও একটা বিশ্ব রেকর্ড। বিদায়ী টেস্টে সেঞ্চুরির পথে সাঙ্গাকারাকে ছাড়িয়ে টেস্টের পঞ্চম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে গেছেন কুক (১৬১ টেস্টে ১২,৪৭২)। আর সাকে লঙ্গান এই গ্রেটকে ছাড়িয়ে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান হিসেবেও গড়েছেন সর্বোচ্চ রানের নতুন বিশ্বরেকর্ড। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে শেষবারের মতো উঁচিয়ে ধরলেন ব্যাট, গ্রহণ করলেন ওভালের পরিপূর্ণ গ্যালারির দাঁড়িয়ে জানানো সম্মান। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট ও শেষ টেস্টটি মিলে গেল একই বিন্দুতে। ২০০৬ সালে নাগপুরে এই ভারতের বিকপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ফিফটির (৬০) পর, দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন অপরাজিত সেঞ্চুরি (১০৪*)। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১২ বছর কাটানোর পর বিদায় বেলায় ওভাল টেস্টেও করলেন নাগপুরের পুনরাবৃত্তি। এবার প্রথম ইনিংসে ৭১, দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যারাথন সেঞ্চুরি। অমর হয়ে গেলেন কুক। ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে কুক ঢুকে গেছেন ক্রিকেট ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত তালিকায়। যেখানে তার আগে নাম লেখাতে পেরেছেন মাত্র চার জন। অভিষেক ও বিদায়ী টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকানো আগের চার ব্যাটসম্যান অস্ট্রেলিার রেগি ডাফ (১৯০২-১৯০৫), বিল পন্সফোর্ড (১৯২৪-১৯৩৪), গ্রেগ চ্যাপেল (১৯৭০-১৯৮৪) ও ভারতের মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন (১৯৮৪-২০০০)। এছাড়া টেস্ট ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারাকে পেছনে ফেলে পাঁচ নম্বরে উঠে এসেছেন কুক। নামের পাশে ১২৪০০ রান নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন সাঙ্গাকারা। এদিনর মধ্যাহ্ন বিরতি পর্যন্ত কুকের রান ১২৪২৮*। এ তালিকার প্রথম চারজন হলে শচীন টেন্ডুলকার (১৫৯২১), রিকি পন্টিং (১৩৩৭৮), জ্যাক ক্যালিস (১৩২৮৯) ও রাহুল দ্রাবিড় (১৩২৮৮)। ৩৩ বছর বয়সী কুক মোট ১৬১ টেস্ট খেলে ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন। ইংলিশ ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডটি তার। সবমিলে সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ডে কুকের অবস্থান সপ্তম। কিছুদিন আগেই ইতিহাসে টানা ১৫৪ টেস্ট খেলার বিরল কীর্তিও গড়েন তিনি। বিদায়ী টেস্টের সেঞ্চুরিতে ইংলিশদের হয়ে ভারতের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির রেকর্ডটিও নিয়েছেন নিজের দখলে। দুর্দান্ত ক্যারিয়ারের জন্য অনেকেই তাকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন। এই তালিকায় আছেন কুককে যিনি আবিষ্কার করেছিলেন সেই সাবেক গুরু গ্রাহাম গুচ, সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভনসহ অনেকেই। কুকের বিদায় ঘোষণার পর পুরো ক্রিকেট বিশ্ব তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার নিয়ে তাকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন। ভন বলছেন, ‘ইংল্যান্ডকে কুকের চেয়ে বেশি দিতে পারেননি কেউ।’ আরেক সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসেনর মতে, ‘ও ইংল্যান্ডের গ্রেটেস্ট ব্যাটসম্যান হয়ে থাকবে। আমর দেখা মানসিকভাবে সবচেয়ে কঠিন ক্রিকেটার সে। সত্যিকারের স্মরণীয় ক্রিকেটার কুক।
×