ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যানজট নিরসনে পরিকল্পনা হলেও বাস্তবায়নে গতি নেই

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

যানজট নিরসনে পরিকল্পনা হলেও বাস্তবায়নে গতি নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরানো গেলেই রাজধানীতে যানজট এমনিতেই কমে আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যাই গ্রহণ করা হোক না কেন, তা বাস্তবায়ন জরুরি বলেও মত দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি শহরের পরিবহনকেন্দ্রিক চিন্তা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংকট সমাধানে মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। পরিকল্পনাও হচ্ছে এখন অ্যাকশন জরুরি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে স্বল্প মেয়াদী কর্ম পরিকল্পনা-প্রেক্ষিত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা’ এবং ‘ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বহুমাধ্যম ভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থার গুরুত্ব’ শীর্ষক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নিয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ, সুশিল সমাজের প্রতিনিধি সহ বিশিষ্টজনা এসব মতামত তুলে ধরেন। হাত দিয়ে রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের দৃশ্য অনেক পুরনো। কোন উন্নত শহরেই এই ব্যবস্থা নেই। অথচ বেশ কয়েকবার স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। কিন্তু সফলতার মুখ দেখেনি। এক পর্যায়ে ট্রাফিক বিভাগ তা বন্ধ করে পুরনো নিয়মে ফিরে আসে। এ বিষয়টিও আলোচনায় ওঠে আসে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুরো রাজধানীকে যদি ডিজিটালি সিগন্যালিং করা যায়, দক্ষ কয়েক শ’ ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করা যায় তবে দ্রুতই শৃঙ্খলা ফিরবে। সংকটের সমাধান হবে। বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিসব উদযাপন জাতীয় কমিটি আয়োজিত মত বিনিময় সভায় অংশ নিয়ে বক্তারা আরো বলেন, রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য, যানজটমুক্ত ও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে মেগা পরিকল্পনা নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। এর কারণ সরকারের কৌশল ও পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক বরাদ্দ না থাকা, বিভিন্ন সংস্থা, কর্তৃপক্ষ ও থার্ড পার্টি স্বার্থ। তবে পরিকল্পনা গ্রহণ করে স্বল্পমেয়াদেই বাস্তবায়নের নজির রয়েছে খোদ রাজধানীর গুলশান ও হাতিরঝিলে। এখান থেকেই সরকার, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) শিক্ষা নিতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা। ডিটিসিএ এর নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খন্দকার রাকিবুর রহমানের সঞ্চালনায় সভায় পৃথক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ। কলামিস্ট আবুল মকসুদ বলেন, ‘ঢাকা শহরের সঙ্গে অন্য শহরের যদি যোগাযোগ উন্নয়ন না হয় তবে সরকারের সব উন্নয়ন পরিকল্পনাই ব্যর্থ। কী শিক্ষা আর প্রযুক্তি? অন্য সব খাতের তুলনায় এখনই সময় বরাদ্দ বাড়িয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করা।’ তিনি বলেন, ‘কিছু করতে চাইলেই আমরা অন্য সব উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করি। এ তুলনায় বাংলাদেশের কোনো লাভ নেই। বরং দেশের সব মানুষের মানসিকতা, বাস্তবতা, মতামত, দেশের ভৌগলিক অবস্থা এবং মানুষের সংখ্যা উপলব্ধি করতে হবে। শুধু সড়কের কথা বললে হবে না, সড়কের সঙ্গে নৌ ও রেলের সমন্বয় জরুরি। তিনি বলেন, ডিটিসিএ রিভাইস স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) তৈরি করেছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবার মতামত নিয়ে খুব দ্রুত একটা শক্তিশালী কমিশন বা কমিটি গঠন করতে হবে। যা কাজ শুরুর রুট ম্যাপ করে দেবেন। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘মানুষ বেশি সড়ক কম। আগে আমাদের চিন্তা, আচরণের পরিবর্তন, নিয়ম মানার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ফুটওভার ব্রিজের চেয়ে রাজধানীতে বেশি সুবিধাজনক আন্ডারপাস সে ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, এক রাজধানীতে সব আনতে হবে কেন? জীবিকার টানে কেনই বা সবাইকে ঢাকা আসবে হবে? এই কেন এর জবাব আমরা জানি। কিন্তু বাস্তবায়নের সদিচ্ছা নেই। ডিসেন্ট্রালাইজেশন না হওয়া পর্যন্ত ট্রাফিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘শহরের পরিবহনকেন্দ্রিক চিন্তা বাড়াতে হবে। মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। পরিকল্পনাও হচ্ছে এখন অ্যাকশন জরুরি।’ বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘রাজধানীর ভূখণ্ড ব্যবহার ও নতুন নতুন রাস্তা তৈরি করে থাকে সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু তাদের কোনো গাইড লাইন নেই। একটা রাস্তা তৈরির আগে অনেক কিছুই বিবেচনায় আনতে হয়। সেগুলো শুরু করা উচিত। বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘রাজধানীতে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরানো গেলে যানজট এমনিতেই কমে আসবে। কিন্ত সেটা সরকার, কিংবা ডিটিসিএ পারেনি। তাহলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যাই গ্রহণ করা হোক না কেন, সেটার বাস্তবায়ন জরুরি।’ তিনি বলেন, ঢাকা উত্তর সিটির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক দরদ ও সাহসিকতার সঙ্গে স্বল্প সময়ের মধ্যে গুলশানে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সেখানকার ফুটপাত এখন রাজধানীর জন্য আদর্শ। তেমনিভাবে রাজধানীর হাতিরঝিলও আদর্শ উদাহরণ। তাহলে আমরা পুরো রাজধানীতে পারছি না কেন?’ তিনি বলেন, ‘খাম্বা মার্কা উন্নয়ন দেশের জন্য টেকসই নয় বরং এটা যে কত বড় ক্ষতি তা পরে টের পাওয়া যাবে। দেশে এতো এতো ফুটওভার ব্রিজ পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। আবার সেই দেশে জোরপূর্বক ফুটওভার ব্রিজে উঠানোর চেষ্টা চলছে। আমাদের সিগন্যাল বাতি জ্বলে না কেন? পুলিশ হাতের ইশারায় যা করছে সঠিক করছে। কিন্তু তা করা হচ্ছে বেআইনীভাবে। পুরো রাজধানীকে যদি ডিজিটালি সিগন্যালিং করা যায়, দক্ষ কয়েক শ’ ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করা যায় তবে দ্রুতই শৃঙ্খলা ফিরবে বলেও মত দেন এই বিশেষজ্ঞ।
×