ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা নিয়ে সঙ্কট

সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকার স্থলে মিলছে এক লাখ টাকার

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকার স্থলে মিলছে এক লাখ টাকার

রহিম শেখ ॥ নিয়মানুযায়ী একজন নারী বা কোন প্রবীণ নাগরিক (৬৫ উর্ধ্ব) সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। কিন্তু সঙ্কট দেখিয়ে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করছে বিভিন্ন সরকারী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যংকের শাখা অফিসগুলো। সঞ্চয়পত্র নিয়ে এই সঙ্কট শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়। চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় ব্যাংক বা ডাকঘর অফিসে গিয়ে চাহিদা অনুযায়ী পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। সরকারী বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, সর্বোচ্চ এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মতিঝিল শাখা অফিস থেকে বলা হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি পরিমাণে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে আপাতত বই বা স্ক্রিপ্ট না থাকায় পরে আসতে হবে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে তাকে কোন তারিখ বলা হয়নি। তবে স্ক্রিপ্ট সরবরাহ বন্ধ করার বিষয়টি সঠিক নয় বলে জানিয়েছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, নোটিস বোর্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় বড় অক্ষরে লেখা আছে- ‘পরিবার সঞ্চয়পত্রের এক লাখ টাকা মূল্যমানের স্ক্রিপ্ট ছাড়া অন্যান্য মূল্যমানের স্ক্রিপ্ট না থাকায় সাময়িকভাবে বিক্রি বন্ধ থাকবে।’ মতিঝিল অফিসের কাউন্টারের সামনে ঘুরতে থাকা সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বললে তারা নিজেদের ক্ষোভের কথা জানান। সবার বক্তব্যের মূল কথা, ব্যাংকে আমানত রেখে এখন ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ পাচ্ছেন। এর ওপর রয়েছে নানা চার্জ। আবার অনেক ধরনের হয়রানিতেও পড়তে হয়। এ কারণে সঞ্চয়পত্র কিনে রাখতে চান তারা। অনেকের সংসার চলে সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়া মুনাফার টাকায়। বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা যাচ্ছে না। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকও সে পথে হাঁটছে। তুলনামূলক বেশি মুনাফার কারণে তাদের বেশির ভাগই পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে এসেছেন। স্ত্রীর নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে রামপুরা থেকে আসা মিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রচ- গরম ও দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে আসার পর এ অবস্থা দেখে তিনি হতাশ। এ সময় তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মমিনুর রহমান নামে আরেক গ্রাহক বলেন, এতদিন বড় অঙ্কের সঞ্চয়পত্র কিনতে চাইলে এক লাখ টাকার অনেকগুলো স্ক্রিপ্ট দেয়া হতো। তবে আজ (বৃহস্পতিবার) একজনের কাছে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হচ্ছে না। এ রকম না করে সরকার একবারে নোটিস দিয়ে বিক্রি বন্ধ করে দিলে আর তাদের হয়রানিতে পড়তে হতো না। দেশের সবচেয়ে বড় এবং সরকারের ট্রেজারি কার্যক্রম পরিচালনাকারী সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসে সরেজমিনে গিয়ে আরও ভয়াবহ চিত্র মিলেছে। এই শাখা থেকে বেশ কিছুদিন ধরে সব মূল্যমানের পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। এজন্য বিভিন্ন সময়ে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। অন্য ব্যাংকে গিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে না পারার অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসের মহাব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে চাহিদামতো স্ক্রিপ্ট না পাওয়ায় তারা বিক্রি করতে পারছেন না। এক্ষেত্রে বেশি সমস্যা হচ্ছে পুনর্বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। তবে কেন এ রকম হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কিছু জানেন না। বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য এক কর্মকর্তা জানান, এই শাখার মাধ্যমে আগে প্রতিদিন গড়ে তিন কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হতো। এখন তা নেমে এসেছে দেড় কোটি টাকার নিচে। এ ছাড়া অনেকে জানেন না, সঞ্চয়পত্র সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব কোন প্রোডাক্ট নয়। এটা সরকারের একটি স্কিম। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক অর্থবছর ধরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে। এতে করে সুদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমানোর লক্ষ্যে স্ক্রিপ্ট সরবরাহ বন্ধ রাখা সরকারের কৌশল হতে পারে। যদিও এ বিষয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক কোন নির্দেশনা নেই। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকদের রোষানলে পড়তে হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, অর্থবছরের প্রথম জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ঠেকেছে দুই লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের এ অর্থের বিপরীতে সরকারকে গড়ে ১১ শতাংশের বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। অথচ ব্যাংক এখন ৪ থেকে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো অনেক দিন ধরে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়ে গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত করার দাবি জানাচ্ছে। যদিও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনের আগে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমাবে না সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিলসহ বিভিন্ন শাখা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিভিন্ন মূল্যমানের সঞ্চয়পত্রের স্ক্রিপ্টের জন্য চাহিদাপত্র দেয়। সে আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক সঞ্চয় ব্যুরোতে চিঠি লেখে। গত কয়েক মাস ধরে বারবার চিঠি এবং তাগাদাপত্র দিয়েও স্ক্রিপ্ট পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, এ রকম সঙ্কটের বিষয়টি নিয়ে সঞ্চয় অধিদফতরে দফায়-দফায় যোগাযোগ করেও কোন সুরাহা হচ্ছে না। আবার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানোও হচ্ছে না। তবে মৌখিকভাবে একেক সময়ে একেক রকম বক্তব্য দিচ্ছে সঞ্চয় অধিদফতরের কর্মকর্তারা। কখনও বলা হচ্ছে, চাহিদামতো স্ক্রিপ্ট ছাপানোর সক্ষমতা না থাকায় এমন হচ্ছে। কখনও লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করায় সরকারের বিক্রি কমানোর চেষ্টার কথা বলা হচ্ছে। কখনও বলা হচ্ছে, সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং অটোমেশনের জন্য আপাতত স্ক্রিপ্ট ছাপানো কমিয়ে দেয়ায় এ রকম হয়েছে। এ অভিযোগ অস্বীকার করে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের মহাপরিচালক সামছুন্নাহার বেগম বলেন, যখন যে চাহিদা আসছে সে অনুযায়ী স্ক্রিপ্ট সরবরাহ করা হচ্ছে। স্ক্রিপ্ট সরবরাহ বন্ধ করার বিষয়টি সঠিক নয়।
×