ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

(গত বুধবারের পর) জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের মূল্যায়নে ভিন্নতা রয়েছে। কিছু অফিসার তাকে একজন নীতিবান শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন এবং ব্যক্তিত্ববান ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করেন। আবার অনেকে তাকে ‘হুইমজিক্যাল’ এবং যুক্তিতে বিশ্বাস না করে নিজের খেয়াল-খুশি মতো কাজ করতেন বলে অভিহিত করেন। তবে এহেন পরিপূর্ণভাবে সঠিক যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর জন্য চিফ অব স্টাফ নিয়োগ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত সামরিক বাহিনী বিষয়ক সব সিদ্ধান্ত জেনারেল ওসমানীর পরামর্শ মোতাবেকই নিতেন। এমনকি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেক্টর কমা-ার এবং মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট হওয়া সত্ত্বেও জেনারেল ওসমানীর পরামর্শেই কেএম শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মেজর ডালিম, আমার ছাত্র জীবনের সহপাঠী এবং বন্ধু আহম্মদ শরফুল হোসেন বটু, মেজর হুদা প্রভৃতি কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর হত্যায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় যে, হত্যাকারীরা ১৫ আগস্টের পরের দিনই মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর স্থলে আরও ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ, যোগ্য ও সাহসী কোন কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীপ্রধান নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। খন্দকার মোশতাক চেয়েছিলেন তাদের দলের একজন সিনিয়র নেতা এবং তৎকালীন এমপি রাশেদ মোশাররফের ভাই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে পরবর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে। জেনারেল ওসমানীও খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধল বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত লে. কর্নেল ও মেজরদের অধিকাংশ সদস্য। তারা একত্রিত হয়ে খুবই শক্তভাবে স্ট্যান্ড নিল যে, আরও অধিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, যোগ্য এবং নীতিবান কাউকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া না হলে ওই সময়কার ঘোলাটে পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভবপর হবে না এবং সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে চলে গেলে ক্ষমতায় টিকে থাকাই হবে তাদের জন্য কঠিন ও অনিশ্চিত। হত্যাকারীদের দুই গ্রুপের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব চলে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। শেষ পর্যন্ত ২৪ আগস্ট জিয়াউর রহমানকেই সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। জেনারেল ওসমানী যেহেতু জেনারেল জিয়াকে পছন্দ করতেন না তাই সেনাপ্রধান হিসেবে তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হ্রাস করার জন্য পাকিস্তান ফেরত অফিসার এবং তৎকালীন ইপিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে চিফ অব ডিফেন্স চিফ হিসেবে নিয়োগ দিতে খন্দকার মোশতাককে দিয়ে ফাইলে সই করান। তবে পরবর্তীতে কখনও এই নতুন পদ সৃষ্টি এবং নিয়োগ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। যদিও পুরনো হাইকোর্ট ভবনে অবস্থিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বসেই কিন্তু জেনারেল খলিল চিফ অব ডিসেন্স হিসেবে অফিস করেছেন যতদিন তিনি ওই পদে ছিলেন। জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে এসব বক্তব্যগুলো হয়ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার সংক্রান্ত নয় বলে অনেকে অপ্রাসঙ্গিক বলে অভিহিত করতে পারেন। কিন্তু তিনি যেহেতু আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রধান সেনাপতি ছিলেন তাই তার সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়ার জন্য এই প্রচেষ্টা। তবে অনেকেই মনে করেন যে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হওয়ার প্রচ- আকাক্সক্ষা তার প্রথম থেকেই ছিল। তাই প্রথম সুযোগেই তিনি তার পূর্ব আকাক্সক্ষা পূরণ করে নিলেন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করে। আবার অনেক সেনা কর্মকর্তাকে বলতে শুনেছি যে, জেনারেল ওসমানী যেহেতু একটু ভীতু প্রকৃতির লোক ছিলেন তাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ না করলে তারা হয়ত তাকে জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের বিরোধী হিসেবে বিবেচনা করে জেলে পাঠিয়ে দিতে পারেন, তাই সেটা ভেবে সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটা গ্রহণ করে নিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে তৎকালীন কর্নেল ওসমানীর হাতেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা এবং এই সেনাবাহিনী কোনভাবে কোন কারণে বিশৃঙ্খলার মধ্যে পতিত হয় এবং নিজেদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হয়ে দেশ ও জাতির জন্য যাতে কোন সঙ্কটের সৃষ্টি না করে সে বিষয়ে ওসমানী বিশেষভাবে সজাগ ছিলেন বলেই ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের পর রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার পদ গ্রহণে এতটুকু বিলম্ব করেননি তিনি নিজ হাতে গড়া মাত্র কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সার্ভিং অফিসারদের দুষ্ককর্মের কারণে সেনাবাহিনী অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে নিজেদের সুনাম ও ভাবমূর্তি নষ্ট করবে সেটা তিনি কোনভাবেই হতে দেবেন না বলেই তিনি প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেছিলেন বলেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফের নতুন পদ সৃষ্টি এবং জেনারেল খলিলকে এই পদে নিয়োগের বিষয়টি তিন বাহিনীর তখনকার বাহিনীপ্রধানদের কেউ মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি এবং তারা বিষয়টি তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব মুজিবুল হককে জানিয়েও দেন সেটা। চলবে...
×