ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এক কর্মজীবী নারীর সফল মা হয়ে ওঠা

প্রকাশিত: ০৭:০১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

এক কর্মজীবী নারীর সফল মা হয়ে ওঠা

সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রার নারীরা আজ নিজের অংশীদারিত্বকে সফলভাবে প্রমাণ করে যাচ্ছে। সংসার, পরিবার তার সঙ্গে কর্মজীবনকে সামলিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাই নয় বরং সমাজ-সংস্কারের যাত্রা পথকেও অবারিত করছে। যার যুগান্তকারী প্রভাব পড়ছে সময়ের প্রজন্ম তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রেও। একজন মাই পারে একটি সুশৃঙ্খল জাতি উপহার দিতে। এ কথা বহু আগে বলে গেছেন নেপোলিয়ান। কর্মজীবী মায়ের পক্ষে অত সহজ আর স্বাভাবিক হয় না সংসার আর সন্তান সামলানোর ব্যাপারটি নির্বিঘœভাবে সম্পন্ন করতে। কারণ প্রচলিত সমাজ এবং ঐতিহ্যিক মৃল্যবোধ এখনও নারীর চলার পথকে অতখানি অবারিত করতে পারেনি। ফলে সংসার আর সন্তানের আঁচ লাগে পেশাগত জীবনে- অপরদিকে কর্মজীবনের বিধিনিষেধ সন্তান পালনের বিপক্ষে চলে যায়। দুটো জগত সফল ভাবে যারা অতিক্রম করতে পারছেন তারাই শুধু দক্ষ কর্মকর্তাই নন একজন কৃতী মাও বটে। তেমনই একজন সফল নারীর সঙ্গে আলাপচারিতায়- নাজনীন বেগম শিখা দাশ চৌধুরী । চট্টগ্রামের মেয়ে। গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনিয়ায়। বড় হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র জামাল খান লেনের পৈত্রিক বাড়িতে। বাবা সন্তোষ ভূষণ দাশ একজন আইনজ্ঞ, রাঙ্গুনিয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকমিশনের সদস্য হিসেবেও তার পেশাগত জীবনকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয়া শিখা শৈশব-কৈশোর পার করেছে অন্য দশটি সাধারণ বাঙালী মেয়ের মতো। সাত ভাই-বোনের মধ্যে শিখা চতুর্থ। মা রেণুকা প্রভাদাশ ধনী সংসারের গৃিহণী শিখা চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা কৃতিত্বের সঙ্গে উন্নীত হলেও সে সময় অন্য এক বিপর্যয় পুরো সংসারকে বেসামাল করে দেয়। হঠাৎ করেই মমতাময়ী মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক সময় মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। তখন বাবাই মোটামুটি সংসার আর পেশাগত জীবনকে সামাল দিয়ে অসুস্থ স্ত্রীসহ সন্তানদের দেখাশোনা করতেন। সাত সন্তানকেই সন্তোষ দাশ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। শুধু তাই নয় প্রত্যেকেই স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। শিখা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে (সম্মান) ভর্তি হয় ১৯৮১ সালে বাবার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে শিখার বিয়ে হয়ে যায়। সে তখন মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা দেয়ার আগে। স্বামী নীতিশ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে ¯œাতক-¯œাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে ঢাকায় চলে আসেন। সাভারের গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালে যোগদান করেন কেমিস্ট হিসেবে। ১৯৮২ সালে শিখা এক সন্তানের মাও হয়ে যায়। ইতোধ্যে শিখার শিক্ষাজীবনে হরেক রকম টানপোড়েন শুরু হয়। লেখাপড়া প্রায়ই বন্ধ হওয়ার উপক্রম। একান্ত সুহৃদ সহপাঠীরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অনমনীয় মনোযোগ এক সময় স্বামী-সন্তান আর সংসার নিয়েই সাবসিডিয়ারি পাস করে যায়। পরবর্তীতে ¯œাতক পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুতি নিতে থাকে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম করতে করতে প্রায়ই দুই বছর কেটে যায়। স্বামীও ফ্রান্সে চলে যান উচ্চতর ডিগ্রী পিএইচডি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে। ফলে পরের কয়েক বছর স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামের বাবার বাড়িতে থাকতে শুরু করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ হয়। পরবর্তীতে বিএড ডিগ্রীও সম্পন্ন করেন। স্বামী ফিরে আসলে আবারও সাভারের গণস্বাস্থ্যের আঙিনায়। শিক্ষা জীবনের অনেক মূল্যবান ধাপ পার করে শিখার পরবর্তী লক্ষ্য কোন সরকারী কর্মকা-ে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। তখন অবধি সরকারী চাকরিতে পিএসসি কার্যক্রমের মাধ্যমেও পেশাগত জীবন শুরু করা যেত। শিখা পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে যোগদান করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায়ই ২০ বছর বদলির পালাক্রমে এক জায়গা থেকে অন্য কোন স্থানে থাকতে হয়েছে। চাকরি জীবনের পালা বদলের অস্থির সময়ে জন্ম নেয় দ্বিতীয় সন্তান ধীমান। দুই সন্তানকে শুধু পৃথিবীর আলো দেখানোই নয় দেশের ভাবী প্রজন্ম হিসেবে যোগ্যতম আসনে বসানো প্রত্যেক বাবা-মায়ের নৈতিক দায়বদ্ধতা। সে কর্তব্যও সুষ্ঠুভাবে পালন করেছে শিখা এবং নীতিশ বাবু। শিখাকে যখন চাকরির কারণে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তখন সন্তানদের সার্বিক দেখাশোনার দায় ভাগ পড়েছে বাবার ওপর। তিনিও তার সমস্ত প্রচেষ্টা এবং মমত্ববোধে পুত্র এবং কন্যার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবেও বেড়ে উঠেছে। কন্যা নিশি ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রী অর্জন করে তার পেশাগত জীবনকেও সুষ্ঠু ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। পুত্র ধীমান বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে আমেরিকার সাউথ ক্যারোলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণায় নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে ধীমান সেখানে পড়াশানার সুযোগ পায়। কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে শিখা এখন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে (কাওরান বাজার অফিস) উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে তার পেশাগত জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন। এখনও তাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিবার পরিকল্পনার যথার্থ প্রয়োগ নিয়ে কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। সেমিনার, সম্মেলন এবং বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে আজও সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে ছোট দেশের ওপর যে পরিমাণ চাপ তৈরি হবে তাতে ভবিষ্যত প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেয়া কঠিন হবে। শিখা যেভাবে তার জীবনের সমূহ লড়াইকে মোকাবেলা করে শিক্ষা জীবনকে ভেসে যেতে দেয়নি একইভাবে পেশাগত জীবনকেও দারুণভাবে মোকাবেলা করছে। মাতৃত্বের অকৃত্রিম মহিমায় সন্তানদেরও যথার্থ পথে চালিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি। সন্তানরাও কর্মজীবী মায়ের অনেক সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে নিজেদের সামনে চলার পথকে এগিয়ে নিয়েছে। সফলও হয়েছে তারা। শিখার জীবনে এসেছে পরম শান্তি আর তৃপ্তি। একজন সফল সরকারী কর্মকর্তা অবসরের কাছাকাছি সময়ে এসে ভাবতে পারে কর্মক্ষেত্রে কখনও অন্যায় সুযোগ-সুবিধা নেননি সংসার কিংবা সন্তানদের কারণে। আবার সন্তানরাও তৈরি হয়েছে বাবা-মার পছন্দ অনুযায়ী। সংসার এবং সফলভাবে পেশাগত জীবন চালিয়ে নেয়া সত্যিই এক বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। যাকে অতিক্রম করা অনেক মেয়ের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর যারা পারে তারা সত্যি দৃষ্টান্তই শুধু নয় তার চেয়েও বেশি নারী হিসেবে নয় মানুষ ভেবে নিজেকে জোর কদমে সামনে এগিয়ে নেয়া।
×