ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বই ॥ স্মৃতির শ্রাবণ মেঘ

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বই ॥ স্মৃতির শ্রাবণ মেঘ

মুশফিকুর রহমানের বই ‘ স্মৃতির শ্রাবণ মেঘ নাজনীন বেগম প্রকাশ পায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সদ্য প্রকাশিত এই গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন লেখক নিজেই। প্রকাশনার দায়িত্বে ছিলেন ‘অন্বেষা প্রকাশন’। চ্যানেল আই-এর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ফরিদপুর রেজা সাগরকে উৎসর্গ করা গ্রন্থটি লেখকের প্রথম উপন্যাস। অনেকটা বড় গল্পের আদলে লেখা এই উপন্যাসের রচয়িতা বৈচিত্রিক জীবনের নানা অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর সৃজন দ্যোত্রনাকে নিবেদন করেন। সে অভিজ্ঞতা শুধু দেশেই নয় বিশ্বজুড়েও তার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত। বইটি মূলত” খুব হাতে গোনা চরিত্র, ঘটনা বিন্যাসের পরিধিও সংক্ষিপ্ত। ব্যক্তিক অনুভব এবং আবেগ নিয়ে লেখা এই বইয়ের সারসংক্ষেপ হৃদয়বৃত্তির এক অপরূপ নির্মাণ শৈল। লেখক ভূমিকাতে উল্লেখ করেন কোন বিশেষ স্থান, কাৎর কিংবা পাত্র গ্রন্থটির মুল অবয়বে প্রভাবিত করে না। বরং জীবনের বাঁকে বাঁকে হরেকরকম ঘটনা কিংবা চরিত্রের সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ গ্রন্থের রূপকারকে যে মাত্রায় প্রাণিত আর উদ্দীপ্ত করে সেখানেই গল্পের সারবত্তা। তারপরেও কঠিন বাস্তব, আধুনিক জীবনবোধ সাথে ঘটনার আবশ্যিকতার সম্মিলনে বইটির পটভূমির আবর্তিত। যেখানে প্রতিদিনের যাপিত জীবনের সঙ্গে সখ্য স্থাপন বিচিত্র কিছু নয়। সৃষ্টির ভাব কল্পনা যখন প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ব্যক্তি আর বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলে তখন শিল্পী সে আবেদনে নিজেকে সমপর্ণই করে না সৃজন দ্যোতনায় সার্বিক মনন জগৎও নির্বিষ্ট হয়। কোন এক সময় শৈল্পিক সত্তা সচকিত হয় নতুন কিছু উদ্ভাবনে আর সেভাবেই সমৃদ্ধ হয় নবসৃষ্টির আলোকিত জগত। সে আলোকে উদ্ভাসিত লেখকের এই ‘স্মৃতির শ্রাবণ মেঘ’ উপন্যাসটি। কাহিনী নির্মাণে গ্রন্থকার সহজ স্বাভাবিক পথে গল্পের অবতারণা করলেও শেষ মেশ অনেক গূঢ় রহস্য ও পাঠককে চমকৃত করে। এর মধ্যে আড়ালে আবডালে প্রচ্ছন্ন থাকে সমকালীন সমাজ, নারী ব্যক্তিত্ব তার সঙ্গে আধুনিকতার জয়মাল্য এমনকি মানুষ ভেদে সূক্ষ্ম ভাবনা-চেতনাও গল্পের গতি নির্ণয় করে। নারী শক্তির অবধারিত সচেতনতা তার নিজস্ব সত্তা বিকিরণে অবিচল দৃঢ়তা প্রকাশ পেলেও নারীরা যে আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পণ্যের বাজারে পরিণত হয় সে অমোঘ সত্যটিও বিশেষভাবে প্রকাশিত। তবে নায়িকা ইরায়াকে লেখক আপন ঐশ্বর্যে মহীয়ান করে তোলেন। তার সুদৃঢ় ব্যক্তিসত্তা, নিজের প্রতি অনমনীয় বোধই শুধু নয় বরং সমর্পণের আলোকে পরিশালিত রুচির যে স্পষ্ট প্রকাশ তাতেই চরিত্রটি তার যথার্থ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকে। যে পেশায় ইরায়া নিজেকে উৎসর্গ করে সেখানে একজন নারী নিজের ইচ্ছে, অনিচ্ছ কিংবা আশা আকাঙ্খার নিবেদন আর বিরোধকে নানা মাত্রিকে লালন ও করে। আধুনিক, আত্মসচেতন, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব তার সঙ্গে শারিরীক ও মানসিক ঐশ্বর্য একজন নারীকে যে মাত্রায় অভিষিক্ত করায় সেখানে যথার্থ অর্থে তার মর্যাদা কোনভাবেই ক্ষুণœ হয় না। এখানে নারী জাতির সম্মান রক্ষায় লেখকের সচেতন এবং মানবিক সত্তা তাকে চালিত করে। নায়কের বলিষ্ঠ, সংহত মনোজগত নায়িকাকে কোন অবস্থাতে বিপন্ন কিংবা দিশেহারা অবস্থায় যেতে দেয় না। নায়ক ইমরান ধর্নাঢ্য পরিবারের সন্তান। সোনার তালে দুধভাত খেয়ে বড় হলেও অতি বাল্যকালে মাকে হারায়। অগাধ সম্পদের প্রতিভু হয়েও জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সে সর্বস্ব হারায়। কাহিনীর মোড় ঘুরে যায় অন্যদিকে। যেখানে যৌবনের স্বর্ণ অধ্যায়ে এক পাকিস্তানী নারী ফরিযাকে ভালবেসে স্বর্ণ অধ্যায়ে এক পাকিস্তানী নারী ফারিয়াকে ভালবেসে সে তার নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করে। মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতি আর ভাষা ও অঞ্চলগত বৈষম্য। এই পর্বত প্রমাণ বাধাকে কেউই শেষ অবধি অতিক্রম করতে পারেনি। নিজস্ব পরিবার থেকে দু’জনই ছিটকে পড়ে। জীবনের দুঃসময়ে অনেক দিন এক সাথে কাটালেও দৈন্যতার মহা দুর্বিপাকে আবারও চির বিদায়ের সুর সংস্কৃত হয়। ইমরান তার বাবার কাছে ফিরে যায় একাই। ফারিয়া অখন অন্তৎস্বতা। ফলে তার পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। একমাত্র কন্যাকে জন্ম দিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে নিজেকে সমপর্ণ করে। সমাজবর্হিভূত কাজে লিপ্ত একজন মায়ের সন্তানকেও একই পথের পথিক হতে হয়। তবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আরও আধুনিক, যুগোপযোগী এবং সচেতন ব্যক্তিসত্তায় দৃঢ় প্রত্যয়ী, প্রচলিত সমাজ ইরায়ার জন্য সুস্থ কিংবা স্বাভাবিক পথ তৈরি হতে দেয়নি। এমন কঠিন, বাস্তব সত্য প্রতিটি সমাজের আনাচে কানাচে নিত্যই ঘটে চরে। তবে তার খবরকে রাখে? ইয়ারার কাছে এক সময় পরিস্কার হয় ইমরানই তার বাবা। আর এটা জানার পর বাবার আত্মহনন এই নাটকীয় কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটায়। অভিনব এবং চমকপ্রদ হলেও একটি সামাজিক সমস্যাকে গল্পের আদলে পাঠকের সামনে নিয়ে আসার জন্য লেখককে অভিনন্দন। পাঠক প্রিয়তা পেতে অসুবিধা হবার কথা নয় গল্পের স্পর্শকাতর ঘটনা বৈচিত্র্যে। বইটির বহুল প্রচার আশা করছি। নাজনীন বেগম
×