ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

উন্নয়নে মেধাস্বত্ব

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

উন্নয়নে মেধাস্বত্ব

সম্পত্তির মালিকানাবোধের জন্মের পরে অনেক দিন লেগেছে যুক্তিসঙ্গত উপায়ে ভূমির স্বত্ব মানুষের দখলে নিতে। সাধারণত আমরা সম্পত্তি বলতে ভূমি নিয়েই বেশি আলোচনা করি। অপরদিকে সম্পত্তির সংজ্ঞায় বড়জোর ঠাঁই পায় বাড়িঘর, সোনা-গয়না আর টাকা। ইংরেজী ‘প্রোপার্টি’র সংজ্ঞা অনুযায়ী নিজের করায়ত্ত সবই ‘সম্পত্তি’। সে হিসেবে বউ-ছেলে-মেয়েও মালিকের সম্পত্তি! সামন্ত সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষের শক্তিমত্তা শৌর্য-বীর্যের কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পত্তির মালিকানা নিশ্চিত হতো বলে পুরুষপ্রধান পরিবারে নারী, শিশু ও তাদের অধিকৃত সকল বিষয়সম্পদ পুরুষের নেতৃত্বে পরিবারের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো। ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, পৃথিবীতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিকাশ ঘটেছে। পুঁজির বিকাশ পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে ঘরছাড়া করেছে। প্রাচীনকালে মানুষের মনে যে অধিকারবোধের জন্ম হয়েছিল তা ক্রমান্বয়ে বিভক্ত হতে শুরু করেছে ও তার প্রভাব শুধু ব্যক্তি জীবনে নয়, পুরো সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই প্রভাবিত করেছে। সম্পদের মালিকানা তখন চিন্তার মালিকানা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করল আর সেখানে বাধল বিপদ, চিন্তার মালিকানা কেমন করে নিশ্চিত হবে, তা নিয়ে। এ কথা সত্য যে, মানুষের অভিব্যক্তি, আবেগ বা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানা মাধ্যমে, যার মধ্যে শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীত থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবিষ্কার এমনকি সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন চিন্তাও রয়েছে। মানুষ সমাজের অংশ হিসেবে ও নিজেকে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী হিসেবে উচ্চপর্যায়ে নিতে পেরেছে এই চিন্তা দর্শনের প্রয়োগ করেই, কিন্তু তার সাফল্য নিয়ে নানারকম বিতর্ক আছে যার মধ্যে চিন্তার বা মেধাবুদ্ধির মালিকানা অন্যতম। সবচেয়ে জরুরী বিতর্ক এখন বিশ্ব উন্নয়নের অন্যতম অনুষঙ্গ তথ্য-প্রযুক্তি বিকাশের মেধাশক্তির মালিকানা নিয়ে যা অনেকটাই যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার শামিল। মেধার স্বত্ব-মালিকানা এর প্রায়োগিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। পুঁজি তার বণিক মানদ- দিয়ে এর বিচার করে, ফলে ‘স্বত্বে¡র দাবি আর বাজার’ পরস্পরের পরিপূরক ও সাংঘর্ষিক উভয়ই হয়েছে। অনেক নামী-দামী কোম্পানি এই বিতর্কে জড়িয়েও হেরে দেউলিয়া হয়েছে এমন উদাহরণও আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে মেধার স্বত্ব¡ নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে জরুরী হলো দেশের মেধাস্বত্ব¡ আইনকে যুগোপযোগী করে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এখন আমাদের দেশে বিদ্যমান যে আইনগুলো রয়েছে সেগুলোর একটি তালিকা দেখলে বুঝা যাবে আমাদের কোন কোন ক্ষেত্রে সামান্য কিছু কাজ করা দরকার। যেমন- কপি রাইট বা মেধাস্বত্ব¡ আইন যা ২০০০ সালের করা ও ২০০৫ সালে কিছুটা হালনাগাদ। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো যেমন- জিআই এ্যাক্ট ২০১৩ (যা কোন দেশের ঐতিহ্যগত সম্পদকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশনা দেয় যাতে ওই দেশের নির্দেশিত সম্পদের মালিকানা নিশ্চিত হয়)। যেমন বাংলাদেশ জামদানি শাড়ি, ইলিশ মাছ জিআই নিবন্ধন পেয়েছে। এর মাধ্যমে কিন্তু বাংলাদেশের ভৌগোলিক সম্পদের মেধার স্বীকৃতি ও মালিকানা নিশ্চিত হলো। আমাদের বুঝতে হবে যে, কোন দেশের ভৌগোলিক সীমার প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ, সংরক্ষণ ও গবেষণা প্রকৃতপক্ষে ওই দেশের মানুষের মেধাসম্পদ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঠিক সেরকম ব্যবসার মালিকানা নিয়ে ট্রেডমার্কস আইন ২০০৯ দিয়ে পরিচালিত হয়; কিন্তু আমাদের প্যাটেন্ট নিশ্চয়তার ১৯৩৩ সালের আইনের আধুনিকায়ন হওয়া দরকার যাতে দেশের কোন আবিষ্কার ও সে আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক যুক্তির স্বীকৃতি দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিধিতে নিশ্চিত থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মেধাবুদ্ধি নিশ্চিত করতে একটি প্রতিষ্ঠানও আছে (WIPO– World Intellectual Property Organization) যা ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থাকলে আমাদের মেধাস্বত্ব বেহাতের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। মেধাস্বত্ব¡ নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা আছে যা নিরসনে ব্যাপক আলোচনা ও প্রচারণা দরকার। অনেকে একে শুধু ‘কপি রাইট’ বা ‘মেধাস্বত্ত্ব’ বলেই সংজ্ঞায়িত করে ক্ষান্ত হন; কিন্তু এর সঙ্গে প্যাটেন্ট ও ট্রেড মার্কেরও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আমরা ইংরেজীতে যাকে বলি ‘এক্সপ্রেশন অফ আইডিয়া’ কপি রাইট মূলত তার মালিকানা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় যাতে আপনার কোন মৌলিক কাজ অন্য কেউ দাবি করতে না পারে। তাছাড়া মেধাস্বত্ব নিশ্চিত হলে আপনার কোন মৌলিক কাজ অন্য কেউ আপনার অনুমতি বা শর্ত ছাড়া ব্যবহার করতে পারবে না, কিন্তু ফলভোগে আপনার কোন আপত্তি থাকবে না। যেমন কেউ চাইলে ‘জনকণ্ঠ’ নামে একটি পত্রিকা বের করে সেখানে যা যা ছাপা হয় হুবহু তা প্রকাশ করে এমনকি ডিজাইন পর্যন্ত অনুসরণ করে তা প্রকাশ করতে পারবে না। এর সঙ্গে যত না আইনের বাধ্যবাধকতা তার চেয়ে বেশি নীতিনৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু ‘জনকণ্ঠ’ পত্রিকা পাঠে মালিকের কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। মানবিক বাংলাদেশে অসাধু উদ্দেশ্যে এমন নকলের কাজ কেউ করবে সরকার তা চায় না বলেই আইনের দ্বারা সেসব মেধা ও সম্পদের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো চিন্তার স্বাধীনতা। আমাদের সংবিধানের ৩৯.১ অনুচ্ছেদে জনগণকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। আর তার পরের অনুচ্ছেদেই (৪০) বলা আছে- ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে।’ বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক যোগ্যতা অনুযায়ী তার সৃজনশীল মেধা প্রয়োগ করে তার চিন্তাকে পেশা বা বৃত্তিমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারেন যাতে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত হয়। একটি স্বাধীন দেশে আমাদের মেধা সম্পদকে যদি আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নমুখী কাজে ব্যবহার করি তাহলে সে দেশের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে ঝগড়া করে আমাদের সময় নষ্ট করা অনুচিত। আমাদের দেখতে হবে দেশের কল্যাণে আমরা বিবেকের কোন অংশ কাজে লাগাচ্ছি বা আমি কি ভূমিকা রাখছি যা কি-না আমাদের উত্তরপুরুষের জন্য একটি মানবিক পরিবেশ নিশ্চিত করবে যেখানে বিজ্ঞানের চর্চা হবে উন্নয়নমুখী। এমনকি প্রযুক্তি, তার গবেষণা, প্রায়োগিক ফলাফল, কৃষি বা সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বা সাহিত্যচর্চা সর্বত্র মেধা বিকাশের সুযোগ আমাদের আছে, সম্পদের মালিকানা নিশ্চিতকরণের আইনগত সুযোগও আছে সেখানে আমরা কথকতার আড়ালে নিজেদের মেধা বিকাশের ক্ষতি করছি কি-না বা মেধাসম্পদের অপচয় করছি কি-না তা ভেবে দেখা দরকার। এদেশে এখনও মেধা বিকাশের অনেক সুযোগ আছে, তরুণ মেধা সম্পদও আছে। শুধু দরকার আমাদের চিন্তার স্বাধীনতাকে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের প্রয়োগে নিশ্চিত করা। যে দেশে পরাধীনকালেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশ বসু, জয়নুল আবেদিন বা জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম হয়েছে এখন সে স্বাধীন দেশে যেখানে সংবিধানে চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আছে সেখানে মেধা বিকাশের সংস্কৃতি মুখ্য রাজনীতি হওয়া উচিত কিনা, যারা বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তিত তারা আশা করি তা আর একবার ভেবে দেখবেন। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×