ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ কলহ অস্বচ্ছতা জবাবহীনতার রাজনীতি আর কতদিন?

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ কলহ অস্বচ্ছতা জবাবহীনতার রাজনীতি আর কতদিন?

মুখে আমরা যাই বলি না কেন পরিবেশ উত্তপ্ত। সম্প্রতি প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নতুন বই এই আগুনে ঘি ঢেলেছে। তাকে নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। বাংলাদেশে এখন এই খবর দাবানলের মতো মানুষকে গ্রাস করছে। এ কথা বলা যাবে না তার সবকিছু অবিতর্কিত। সরকার হটানোর জন্য তার ভূমিকা বা নেপথ্যের ঘটনা মানুষ ততটা জানে না। মানুষের সামনে এসেছে তার বিদায়ের অস্বাভাবিকতা। যেটা নানাভাবে করুণ ও বিষাদের বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর সঙ্গে আছে খালেদা জিয়ার কারাবাস। বেগম জিয়া এখন শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে বেশ ভাল সহানুভূতি কুড়াচ্ছেন। দেশের মানুষের মন স্বভাবতই সংবেদনশীল। মনে পড়ে আওয়ামী লীগকে যখন দুঃসময় মোকাবেলা করতে হয়েছিল তখনকার কথা। চারদিকে নাগিণীর বিষাক্ত নিঃশ্বাস। বিএনপি-জামায়াতের ঘোর চক্রান্ত আর রমরমা সময়। তখন আওয়ামী লীগ মানেই জেল-জুলুম আর হয়রানি। সে সময় ঢাকার প্রাক্তন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এক ভরা জনসভায় সবার কাছে হাতজোড় করে মাফ চেয়ে বলেছিলেন, আমাদের ভুল হলে আপনারা সে ভুল মাফ করে আওয়ামী লীগকে আবার সুযোগ দিন। সে কথা ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল। এরপর আওয়ামী লীগের নৌকা তরতর করে তীরে ভিড়ে গিয়েছিল। আজ যারা গদির লোভে অন্ধ তাদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘ সময় ধরে একমুখী বলেই হয়ত মানুষের মনে এক ধরনের সন্দেহ আর সংশয় দানা বাঁধছে। এটাও মানি রাজনীতির নামে যারা নেতা বা সরকারের মন্ত্রী কিংবা সমাজের মাথা তাদের অনেকেরই আদর্শ আজকাল নেই বললেই চলে। সেটা যেমন সত্য তেমন সত্য নানা ধরনের কারচুপি আর লুটপাট। এই লুটপাট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরের বাইরে থাকে হয়ত, হয়ত যখন তিনি জানেন তখন অনেক সময় বয়ে যায়। ফলে সে দুর্নীতি বা চুরি ডাকাতি আর সমাধানের পথ খুঁজে পায় না। কিন্তু মনে রাখা দরকার নির্বাচনের সময় এগুলো ইস্যু হবে। তখন জবাব দিতে হবে সরকারকেই। সবাই এটা মানেন এমন সুসময় আমাদের জনগণের জীবনে আর আসেনি। বিশেষত আর্থিকভাবে মানুষ এখন সচ্ছল। দেশের চেহারা পাল্টে গেছে। আগে যেখানে মানুষ সাহায্য দান বা অনুদান ছাড়া চলতে পারত না সেখানে এখন তারা স্বাবলম্বী। কিন্তু সেটাই শেষ কথা না। যেভাবেই হোক শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে মানুষের উদ্বেগ যায়নি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি আওয়ামী লীগের সরকার তার সুরাহা করতে পারেনি। একশ্রেণীর মানুষ ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ আর সাধারণ মানুষ তা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তারা জানে সবকিছুর সমাধান হয়ত অসম্ভব। কিন্তু যে জবাবদিহিতা আর স্বচ্ছতা তারা চেয়েছিলেন তা খুব একটা মেলেনি। বরং কয়েকজন মন্ত্রীর উদ্ভট কথাবার্তা আর হামবড়া ভাবের কারণে পুরো ইমেজই এখন ঘোর সঙ্কটে। একজন মানুষ কখন কি বলবেন সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় হলেও এ জন্য একটা নীতিমালা থাকা দরকার। বিশেষত কেউ যখন সরকার ও দেশের প্রতিনিধি তখন তাদের লাগাম থাকা প্রয়োজন বৈকি। সেটা অনেকেরই ছিল না, আজও নেই। এই জায়গাগুলো আগামী নির্বাচনে ব্যাপক নেগেটিভ প্রভাব ফেলবে। এসব কারণে বিএনপিও বুঝে গেছে তাদের অবস্থান পরিবর্তন দরকার। তাই তারা সামনে নিয়ে এসেছে ড. কামাল হোসেনের মতো মানুষকে। ড. কামাল হোসেনের বয়স ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় এটা স্পষ্ট তিনি এখন কি চান। খুব স্বাভাবিকভাবেই এদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার লোভ থাকবে তার। আওয়ামী লীগ যে তা করবে না সেটা তিনি খুব ভাল করেই জানেন। আমি নিশ্চিত কোনভাবে বৈতরণী পার হতে পারলেই তাদের ভেতর দ্বন্দ্ব আর সংঘাত শুরু হবে। বি চৌধুরী হয়ত ধরেই নিয়েছেন তিনিই হবেন সবার ওপরের কর্ণধার। কিন্তু সেটা হবে পালাবদলের পর। আর এই পালাবদলে শেখ হাসিনাকে সরাতে পারলে এদেশের ভাগ্যে যে বিপর্যয় আর কঠিন সময় নেমে আসবে তার দায় নেবে কে? এর ফলে যে নৈরাজ্য আর হানাহানি হবে তাতে বাংলাদেশ কম করে হলেও ৫০ বছর পিছিবে পড়বে। কারণ, যে যে পয়েন্ট থেকে কথা বলেন না কেন মূলত রাগ আর বেদনাই দেখছি মূল কারণ। খালি স্বার্থ আর ভোগের জন্য তৈরি আছেন নেতারা। বাকিরা হবেন ভিক্টিম। খুব সত্য বললে এটা বলতেই হয় আওয়ামী লীগ অনেকদিন রাজনীতি করছে না বা করতে পারছে না। কারণ, তাদের কাছে পাওয়ার এখন গ্যারান্টেড মনে হচ্ছে। এই ভ্রান্তির বাইরে পা রাখা হয়ত এখন কঠিন। কিন্তু মানতে হবে মানুষের মন ও ভোট পাবার জন্য দরকার মূলত রাজনীতি। যা সবাই মিলে সবার অংশগ্রহণে সম্ভব। সেটা কিভাবে হবে কে করবে তা ঠিক করবেন রাজনীতিবিদরা। দুনিয়ার দেশে দেশে উন্নতির জন্য এখন গণতন্ত্রের পাশাপাশি একজন সবল ও কর্মঠ নেতার দরকার। যার ভিশন আছে। প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিলে আর কার ভেতর তা আছে? তাই মানুষ এখন আসলেই বড় বিপদে। একদিকে তাদের মনে শেখ হাসিনার জন্য আস্থা আরেকদিকে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ডাকাতি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে ঘৃণা। কোথায় যাবেন তারা? অপপ্রচার আর নিন্দুকের তলোয়ার এদেশের রাজনীতিকে বার বার খ-িত করেছে। আমাদের ইতিহাস বলে আমরা যখনই ঘুরে দাঁড়াই তখনই আমাদের কাঁধে বন্দুক রাখে দুশমনরা। আর সে সুযোগ করে দেই আমরা। বিচারপতি সিনহাকে আওয়ামী লীগই এনেছিল প্রধান বিচারপতির আসনে। পরে জানা গেল মুক্তিযুদ্ধের সময় নাকি তাঁর ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। এই ঘটনা কি তাদের জানা ছিল না? অতঃপর যেসব কাহিনী তাও কি তারা জানতেন না? এতসব ঘটনা ঘটল আর সরকারের অজানা থেকে গেল এটা কেমন কথা? তাছাড়া বার বার সমবেদনা আর সহানুভূতির বিষয় তৈরি হতে দেয়াও তো বিপজ্জনক। এর দায় নিতে হবে না? তিনি এখন নাগালের বাইরে বসে বলছেন। সত্য মিথ্যা কিংবা আসল নকল চুলচেরাভাবে বের হয়ে আসার আগে যে নোংরামি আর কলহ বা যে কুয়াশা তা ভেদ করতে করতে সময় আমাদের কোথায় নিয়ে যায় কে জানে। দেশে দেশের বাইরে শেখ হাসিনা ও সরকারের বৈরীর অভাব নেই। মূলত অস্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার অভাবে এই অবস্থা। আমার মতো নগণ্য মানুষের একটাই ধারণা আওয়ামী লীগের জনসম্পৃক্ততা কমে যাওয়ায় আজ এতসব ঘটছে। অনেক বছর গদিতে থাকলে কি হয় সেটা আমরা ভারতে দেখেছি। পাশের বঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি সরকারে থাকতে থাকতে এমন ধারণা পোষণ করত যে, এটাই তাদের আসল জায়গা। কেউ কোনদিন হটাতে পারবে না এমন মনোভাবের পর মমতা ব্যানার্জীর মতো নেত্রী এসে তাদের সমূলে উৎপাটন করল। আমাদের সৌভাগ্য বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা। যিনি অচলায়তনে বিশ্বাসী নন। তাঁর সীমাবদ্ধতা ভেসে যায় কর্মের জোয়ারে। বিশেষত ইতিহাস আর ভবিষ্যতের প্রতি তাঁর দায়বোধ আর সাহস দেশকে নিয়ে এসেছে গৌরবের বড় জায়গায়। এটা ঘটছে বলেই মানুষ এখনও আস্থা হারায়নি। তবে এখন প্রচ- সাবধানতার প্রয়োজন। ড. কামাল হোসেন, বি চৌধুরীদের ভোট যাই থাক ষড়যন্ত্র আর নেপথ্যে থাকা শক্তি ভয়ঙ্কর। তারা পারে না হেন কাজ নেই। সঙ্গে জুটেছে অপপ্রচার আর বিচারপতির মতো মানুষেরা। এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার জায়গা পরিষ্কার হলে মানুষ শক্তি পাবে। বুঝতে পারবে কোনটা কি। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। এ কাজ এখনই শুরু করা দরকার। নির্বাচনের দৃশ্যপট সবসময় এক রকম থাকবে না। কোথায় কে ঘাপটি মেরে আছে বা কে কখন কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে কেউ জানেন না। তাই সাবধানতার পাশাপাশি মানুষের কাছে যাওয়া ও মানুষকে বোঝানোর কাজ শুরু করতে হবে। আমরা দেশ ও জনগণের মঙ্গল চাই। কিন্তু তার মানে এই না যে, কেবল একপেশে আর একদলের হয়ে লিখব বা বলব। বরং মন জয় করার যে শুদ্ধ রাজনীতি সেটাই আসুক। যা করে দেখিবে এদেশ স্বাধীন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যার আলোকে চার নেতাসহ মহান নেতারা এদেশকে মানুষের দেশ বানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সবার ওপরে যে মানুষ তাকে কেবল ভোটের গিনিপিগ না ভেবে মানুষ ভাবা আর তার কাছে যাবার কাজটা কেউ করেন না। একদল ভাবেন এরা আমাদের পোষ্য আরেকদল চান উস্কে দিতে। সে কারণেই কলহ যায় না। ভুল বোঝাবুঝি যায় না। আর আমরাও শান্তিপ্রিয় উন্নয়নমুখী এক মন এক প্রাণের জাতিতে পরিণত হতে পারি না। এবার কি সে অচলায়তন ভাঙার কাজ হবে আদৌ? [email protected]
×