ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তির বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তির বিপ্লব

২৭ জুলাই ১৮ প্রকাশিত টেক শহরের প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক প্রতিবেদনের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘হাজার হাজার কোটি নিরাপদ সংযোগ তাৎক্ষণিকভাবে গড়তে পারবে ফাইভজি প্রযুক্তি। পরিবহন, স্বাস্থ্য, জরুরী সেবা, উৎপাদন ও বিতরণ থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বড় প্রভাব ফেলবে এ প্রযুক্তি।’ ‘থ্রিজি বা ফোরজির চেয়ে ফাইভজি প্রযুক্তি বিশ্বকে বেশ বড়ভাবে নাড়া দেবে। বিদ্যুত বা পেট্রলচালিত গাড়ির উদ্ভাবনের চেয়ে এটা কম বৈপ্লবিক হবে না। পুরো অর্থনীতির মোড় আর সামাজিক ব্যবস্থা পাল্টে ফেলার মতো প্রযুক্তি এটি। যদি এই হয় অবস্থা তখন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ফাইভজি ইকোসিস্টেম কতটুকু তৈরি হবে এবং এমন পরিবর্তনের সঙ্গে কতটুকু খাপ খাওয়াতে পারবে সেটি আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। গত ২৫ জুলাই ফাইভজি প্রযুক্তির পরীক্ষা করে বাংলাদেশ বিশ্বের যে অল্প কয়েকটি দেশে এই পরীক্ষা হয়েছে সেই তালিকায় ঢুকে গেছে।’ টেকশহর আমার সঙ্গে আলাপের কিছু উদ্ধৃতিও দিয়েছে। ‘ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার টেকশহরডটকমকে বলছিলেন, কোন দেশে যখন ফাইভজি হবে তখন কিছুদিন পর দেখা যাবে লাখ লাখ গাড়ি চালক চাকরি হারিয়ে বসে আছে। বিশ্বে এই প্রযুক্তিকে এক রকম ‘ভয়ংকর’ প্রযুক্তিই বলা হচ্ছে। কারণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে এই প্রযুক্তি, তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে উল্টো নানা বিপদের মধ্যে পড়বে- বলছিলেন মোস্তাফা জব্বার। মোস্তাফা জব্বার বলছিলেন, ফাইভজির সঙ্গে যখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি বা রোবোটিক্স কিংবা বিগ ডেটা এ রকম বিষয়গুলো একদম জড়িত হয়ে যাবে তখন আমাদের সমাজকাঠামো হতে প্রযুক্তিচিন্তার সঙ্গে এসবের সমন্বয় করতে না পারলে আমরা হুট করে এমন যুগে গিয়ে পড়ব যে যুগে খাপ খাওয়াতে পারব না। আমাদের ব্যাপক কাজ করার আছে, চ্যালেঞ্জ আছে। যার শুরুটা এই ফাইভজি সামিট দিয়ে হলো- উল্লেখ করছিলেন তিনি। সত্যিই এমন ভাবনার বিষয় আছে। খ্যাতনামা কনসালটেন্সি ফার্ম ম্যাকিনজি গ্লোবাল ইনস্টিটিউট বলছে, রোবটের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ ৪৬টি দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরি হারাবে। এতে পুরো বিশ্বজুড়ে পাঁচ ভাগের এক ভাগ চাকরিজীবী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বের ৮০ কোটি মানুষের চাকরি দখল করে নেবে রোবট। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ফাইভজির প্রভাবে আসা নতুন পণ্য ও সেবার মূল্য হবে ১২ লাখ কোটি ডলার। নতুন ওই অর্থনীতিতে দ্রুত ঢুকে পড়ার প্রবল তাড়াও থাকবে বাংলাদেশের। ওয়ার্ল্ড রেডিও কমিউনিকেশন কনফারেন্স বা ডব্লিউআরসিতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো আগামী এক যুগ পর্যন্ত ফাইভজি উন্নয়নে কাজ করবে। ২০১৯ সালের শেষে ডব্লিউআরসি সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার ফাইভজির কোন ব্যান্ড নিয়ে কি পলিসি নেবে তার ওপর অনেকটাই ফাইভজি স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন নির্ভর করবে। ফাইভজির জন্য স্পেকট্রাম হারমোনাইজেশন খুবই প্রয়োজন। এর ফলে ইকুইপমেন্ট ও ডিভাইস খরচ কমে আসে। আর তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বর্ডার এলাকায় দুটি দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে সংঘর্ষ হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ভারতের ৫ কিলোমিটার সীমান্তের মাঝে আমাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক গড়তে পারি না-ফাইভজি এই সমস্যাটির সমাধান দেবে। ডব্লিউআরসিতে আইএমটি ব্যান্ড দেখভাল করার জন্য এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটি বা এপিটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি বা এপিজি মিটিংয়ে সকল দেশের থেকে প্রাথমিকভাবে ফাইভজির ব্যান্ডের রিভিউ পাওয়া গেছে। দেশগুলো কোন ব্যান্ড নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী তা তুলে ধরেছে। এপিটি মেম্বার সম্মেলনে বাংলাদেশ ২৬ ও ৩২ গিগাহার্জ ব্যান্ডের কথা বলেছে, যদি পরীক্ষায় সেগুলো ব্যবহারে কোন বাধা না পাওয়া যায়। জিএসএমের ওই কর্মকর্তা বলছিলেন, বাংলাদেশ সরকারকে ডব্লিউআরসি-১৯ সম্মেলনে ৩ দশমিক ৫ ও ২৬ থেকে ২৮ এবং ৪০ গিগাহার্জ ব্যান্ডের বিষয়ে জোর দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করাটা জরুরী। তিনি বলছেন, প্রযুক্তিগত নিউট্রালিটি অর্থাৎ একই স্পেকট্রাম একাধিক সেবায় ব্যবহার করার পলিসি নিয়ে বাংলাদেশ প্রশংসিত। সেটি ফাইভজির ক্ষেত্রেও ধরে রাখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি ফাইভজি বিনিয়োগের জন্য অর্থনীতি ধরে রাখতে হবে বাংলাদেশের। আর এটা যে বেশ চ্যালেঞ্জেরই হবে। তারা বলছেন, সত্যিকার অর্থে ফাইভজি চালুর অনেকটাই নির্ভর করবে সরকারের পলিসি খাত সংশ্লিষ্টদের প্রতি কতটুকু উদার হচ্ছে তার ওপর। আর এখন পর্যন্ত যা দৃশ্যমান তাতে সরকার তার ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে সবকিছু করতে উদারহস্ত।’ টেক শহরের প্রতিবেদনে হ্যান্ডসেটসহ আরও কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। তবে বস্তুত চ্যালেঞ্জটা হ্যান্ডসেট বা স্পেকট্রাম বরাদ্দ নিয়ে যতটা হবে তার চাইতে অনেক বেশি হবে ফাইভজির প্রভাবে সমাজে, রাষ্ট্রে ও সভ্যতায় যেসব প্রভাব ফেলবে তার চ্যালেঞ্জ। একদিকে নতুন প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে বেকারত্ব তৈরি হওয়া এবং অন্যদিকে নতুন প্রযুক্তির সুযোগটা কাজে লাগানোই হবে আমাদের চ্যালেঞ্জ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে যে, আমরা ফাইভজির দরোজা বন্ধ করে রাখলেও দুনিয়ায় ফাইভজি প্রচলনের ফলে আমরা এর প্রভাবের বাইরে থাকতে পারব না। বালির নিচে মাথা দিলেই আমরা ভাবতে পারব না যে, দুনিয়া আমাকে দেখছে না। আমার নিজের বিবেচনায় ফাইভজি বস্তুত একটি নতুন সভ্যতার প্লাটফরম হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফাইভজির ওপর ভর করেই দাঁড়াবে অন্যপ্রযুক্তিসমূহ। সেজন্য ফাইভজির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও যেসব প্রযুক্তি বিশ্ব সভ্যতাকে, মানুষের জীবনধারাকে বদলে দেবে তার প্রতি নজর দিতে হবে। ফাইভজির সহযোগী প্রযুক্তি : ফাইভজি প্রযুক্তির পাশাপাশি দুনিয়াতে বিকাশমান অন্যান্য প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, বিগ ডাটা, ইন্টারনেট অব থিংস ইত্যাদির কথাও আমাদের মনে রাখা দরকার। ফাইভজির প্রযুক্তি সম্পর্কে এখনকার প্রযুক্তিবিদরা যা মনে করেন তার ছোট একটি বিবরণ এখানে উল্লেখ করছি, We are now in the early stages of the next technological revolution: the development of a ubiquitous wireless network that will marry data collection and computation with billions of devices. This will provide us with unprecedented insights and abilities that will change what we do and how we do it. This network is called 5G. Outside of a few tech-focused circles, the benefits of 5G aren’t widely understood. Reduced to its most elementary definition, 5G may sound a lot like its predecessors — a set of invisible radio waves that transmit information between devices, just faster. Replete with a host of alphanumeric acronyms, it’s going to radically upend many aspects of our lives, just like 4G LTE and 3G before it.Unlike its predecessors though, 5G is a technological paradigm shift, akin to the shift from typewriter to computer. And it isn’t just a network. 5G will become the underlying fabric of an entire ecosystem of fully connected intelligent sensors and devices, capable of overhauling economic and business policies, and further blurring geographical and cultural borders. It will be capable of delivering at every rung of the ecosystem’s ladder, and will provide seamless, continuous connectivity for business applications.All industries will feel the effects of the shift to 5G. In particular, automotive, health care, and the Internet of Things (IoT) are expected to bring about dramatic transformations in our daily lives. For example, think about the relationship between the smart city and an autonomous car. With a 5G connection, your car will know your ETA at work, taking the optimal route based on traffic data communicated from other cars and the roadways. While a handful of companies are working on this level of automation, the ability to deliver this type of functionality at scale will require the marriage of intelligent devices and the 5G network.Ó(https://www.technologyreview.com/s/603770/the-5g-economy-how-5g-will-impact-global-industries-the-economy-and-you/) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স নিয়ে দুনিয়াতে আলোচনা চলছে বহুদিন ধরে। তবে ফাইভজির মতো ব্রডব্যান্ড সংযুক্তির সময়কালে বা প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে বিবেচনায় নিলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স বা মেশিন লার্নিং সম্পূর্ণভাবেই একটি নতুন অভিজ্ঞতার যুগে আমাদের বিশ্বটাকে নিয়ে যাবে। এই প্রযুক্তিসমূহের সমন্বয়ে দুনিয়া দেখবে একটি নতুন প্রযুক্তি বিশ্ব। বলাই বাহুল্য, বস্তুত সারা বিশ্বের রূপান্তর থেকে আমরা আলাদা থাকতে পারব না বলে ফাইভজি প্রযুক্তির পাশাপাশি আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যান্ত্রিক শিক্ষা, রোবোটিক্স, বিগডাটা, ব্লক চেইন এবং আইওটির মতো প্রযুক্তিকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সাম্প্রতিককালে যখনই কোন প্রযুক্তিবিষয়ক সেমিনারে যাই তখনই বলা হয় চালকবিহীন গাড়ি বা কারখানার রোবট যুক্ত হবার ফলে দুনিয়া পাল্টে যাবে। আমি নিজেও ভাবি যদি এমন হয় যে রোবট দিয়ে পোশাক কারখানা চালানো যায় তবে বিশ্বের পোশাক কারখানা থাকবে কেমন করে। যদি চালকবিহীন গাড়ি প্রচলিত হয়ে যায় তবে আমার নিজের দেশের কর্মসংস্থান তো বটেই বিদেশে যারা গাড়ি চালিয়ে বাংলাদেশে পেট চালান তাদের কি হবে? প্রশ্ন উঠেছে যে আইওটি কি পাহারাদার-দারোয়ানের কাজটাও দখল করে নেবে? বিগ ডাটা কি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নামক কোন কিছুই গোপন রাখবে না? আমরা কি রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে রোবটের সঙ্গে ধাক্কা খাব? আমাদের অফিস বা ঘরের কাজ বা সরকারের ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ ক্লান্তিহীনভাবে রোবট করে দেবে? রোবট কি জেনে যাবে আমি কি ভাবছি এবং আমার মন ভাল করার জন্য যা করণীয় তাই করে বসবে? লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
×