ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

॥ পর্ব -ছয় ॥ (গত শুক্রবারের পর) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গবর্নর ডাঃ মালিক ও স্বল্প পরিচিত কিছু রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতার সমন্বয়ে গঠিত সরকার কি করছে, জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার আঞ্চলিক অধিনায়করা কিভাবে তাদের বাঙালী নিধন অপারেশন পরিচালনা করছে এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় কখন এবং কিভাবে তাদের দৈনন্দিন প্রতিরোধ অভিযান পরিচালনা করে বিজয়ের অগ্রযাত্রায় সাফল্য অর্জন করে যাচ্ছে সেসব খবর আমাদের সাইকোলজিক্যাল পরিচালনার কাজে সঠিকভাবে সময় উপযোগী করে কার্যকরীভাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা আমাদের সব সময়ই ছিল। এই ধরনের তথ্য সংগ্রহের একটা গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান ছিল কলকাতার কোকাকোলা বিল্ডিংয়ে স্থাপিত আওয়ামী লীগের অস্থায়ী অফিস যেখানে সন্ধ্যার পর গেলে অনেক আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও কর্মীদের সঙ্গে দেখা হতো। সন্ধ্যার পরে আওয়ামী লীগ অফিসে গেলে আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম খন্দকার ওবায়দুর রহমানকে প্রায় দিনই পাওয়া যেত। প্রচুর লোকের সঙ্গে দেখা হতো এবং এদের অধিকাংশই ছিলেন আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী। বিভিন্ন সেক্টর থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও আসত সেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অন্যান্য সেক্টরের কর্মতৎপরতা বিষয়ে এবং মুজিবনগর সরকারের দৈনন্দিন রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং অন্যান্য খবরাখবর বিষয়ে অবহিত হওয়ার জন্য। সেখানে দেখা হতো সদ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা যুবক শ্রেণীর অনেক উৎসাহী এবং ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক কর্মীদের সঙ্গে। এদের অধিকাংশের চেহারা দেখে এবং কথা বলে যে বিষয়টা দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত হতো সেটা হলো তারা যেন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মা-বাবা-ভাইবোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে তাদের আশীর্বাদ নিয়ে এসেছে প্রয়োজন হলে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে। তবে তাদের কাছে তাদের স্থানীয় এলাকায় পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা কিভাবে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে হিন্দুদের ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এবং রাজাকারদের দ্বারা চিহ্নিত মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে। কিভাবে নিরীহ গ্রামবাসীদের গুলি করে হতাহত করছে এবং অন্যদিকে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাই-বোনেরা কিভাবে নিজেদের জীবনবাজি রেখে পাকসেনা ও রাজাকারদের দিনের পর দিন সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিহত করে যাচ্ছে সেসব বিস্তারিত তথ্য পাওয়া সম্ভবপর হতো আমাদের। গ্রামগঞ্জে অতি সাধারণ মা-ভাইবোনেরা কিভাবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়ে আশ্রয় দিয়ে এবং রাজাকারদের খবরাখবর দিয়ে সাহায্য অহযোগিতা করে যাচ্ছে সে সমস্ত তথ্যও পাওয়া যেত তাদের কাছে। আমাদের সহকর্মী সাংবাদিক আল মুজাহিদ যেহেতু দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করতেন তাই স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে তার পরিচয় থাকার কথা। তাই তাকে মাঝে মধ্যেই আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠানো হতো তথ্য সংগ্রহের কাজে। আমাদের জন্য সহকর্মী কবি আল মাহমুদও যেতেন আওয়ামী লীগ অফিসে। তারা দুজনেই আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে আসর জমিয়ে আসতেন সাহিত্য কবিতা প্রভৃতি বিষয়ে গল্প-স্বল্প করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মন জয় করে তাদের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী শুনে। এভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে আমাদের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার কাজে ব্যবহার করার জন্য যে সমস্ত তথ্যাবলী সংগৃহীত হতো সেগুলো নিয়ে প্রতিরক্ষা সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরবর্তী সভায় আলাপ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হতো। প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ সাহেবও তার তরফ থেকে অনেক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পেশ করতেন আমাদের অবগতির জন্য। একইভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. বেলায়েত এবং উপ-সচিব আকবর আলি খানও আমাদের অনেক তথ্য দিতেন যা আমাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে অনেক সময় ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী এবং বিবিসি ছাড়াও অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হতো আমাদের প্রেরিত প্রতিবেদন। এছাড়া অন্য যেসব স্থান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী বিশেষ করে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা এবং দুনিয়ার বড় বড় শহরের ওইসব স্থানে বসবাসকারী বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে গৃহীত কর্মসূচী বিশেষ করে পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদানকারী কূটনৈতিকদের বিভিন্ন কর্মসূচী এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের গৃহীত হত্যাযজ্ঞ পাশবিক অত্যাচার নারী ধর্ষণ, শিশুহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী বিষয়ক খবরাখবর সংগ্রহ করে বিশ্ববাসীকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিবেদন তৈরি করে দেশী-বিদেশী রেডিও, টিভি এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হতো। আমরা জানতাম যে, আমাদের প্রেরিত সব প্রতিবেদনই দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম সঙ্গে সঙ্গে প্রচার বা প্রকাশ করবে না। তবুও আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আমাদের প্রেরিত ওইসব তথ্যসমূহ সম্পর্কে অবহিত হবে ও সংগ্রহে রাখবে এবং সময় ও প্রয়োজন মতো তারা সেটা ব্যবহার করবে। তবে আমাদের প্রেরিত প্রতিবেদন থেকে অধিকাংশ তথ্যই কোন না কোন সময়ে কোন না কোন দেশের গণমাধ্যমে যে ব্যবহৃত হয়েছে সেটা আমরা পরবর্তীকালে জেনেছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত অফিস অথবা সেখানে কর্মরত বাঙালীদের প্রেরিত খবরাখবরে। উপরোক্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রতি সপ্তাহে একদিন অথবা দুদিন যেতাম কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরিতে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে আমাদের ৮নং থিয়েটার রোডের অফিস থেকে পাবলিক লাইব্রেরিতে তখনকার বাসস্থান থেকে যেতে সময় লাগত বেশি এবং ঝামেলাও হতো বেশ। তাই প্রতিরক্ষা সচিবের অনুমতি নিয়ে নির্ধারিত দিনে ১১৬ ইলিয়ট রোডের বাসা থেকেই চলে যেতাম লাইব্রেরিতে এবং কয়েক ঘণ্টা সেখানে কাটিয়ে দুপুরের মধ্যেই চলে আসতাম অফিসে। এ কাজটা আমাকেই করতে হতো। কবি আল মাহমুদ ও সাংবাদিক আল মুজাহিদ সাহেব সাধারণত কলকাতার দৈনিক কাগজ অফিসে যেতেন যেহেতু কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে দুজনেরই মোটামুটিভাবে পরিচিতি ছিল তাই সংবাদপত্র অফিসে আলাদা একটা সমাদর ছিল তাদের যার ফলে তথ্য সংগ্রহের কাজটা তাদের জন্য হতো সহজতর এবং কিছুটা আনন্দের। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতাটা তাই সম্ভবত কবি আল মাহমুদের স্বাধীনতা উত্তরকালে একটা জনপ্রিয় দৈনিক কাগজের দায়িত্ব পালনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। উল্লেখ্য, আমাদের থিয়েটার রোডের অফিসের উল্টো দিকে রাস্তার পাশে অস্থায়ী চায়ের দোকানের মাটির চায়ের কাপে দেয়া চা খুবই প্রিয় ছিল কবি আল মাহমুদের। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় কাহিনী গুরুত্বসহকারে যেসব আমেরিকান দৈনিক প্রকাশ করত তারমধ্যে অন্যতম ছিল নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়ালস্টিট জার্নাল, বাল্টিমোর সান ও ক্রিশ্চিয়ান আইস মনিটর। টাইমসসহ নিউজউইকের মতো ব্যাপকভাবে প্রচারিত জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ও মাঝে মধ্যে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ বীরত্বগাথা তুলে ধরে আমাদের স্বপক্ষে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধের রিপোর্ট গুরুত্বসহকারে যেসব ব্রিটিশ দৈনিক ছাপত তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ডেইলি মিরোর, গার্ডিয়ান ও ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস। কানাডার টরেনটো স্টার ও অটোওয়া সিটিজের দৈনিক কাগজ অস্ট্রেলিয়ার দৈনিক ডেইলি টেলিগ্রাফ ও দি এজ, জার্মানির বার্লিনার বেইটাং এবং জেনারেল আলজিজারা কাগজও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কয়েকবার বড় বড় রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×