ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দীর্ঘ মনোনয়ন প্রত্যাশীর ভিড় আওয়ামী লীগে, বিএনপিতে কোন্দল ॥ রাজবাড়ী

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

দীর্ঘ মনোনয়ন প্রত্যাশীর ভিড় আওয়ামী লীগে, বিএনপিতে কোন্দল ॥ রাজবাড়ী

অভিজিৎ রায়, রাজবাড়ী ঘুরে এসে ॥ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজবাড়ী জেলার নির্বাচনী মাঠ সরগরম। সর্বত্র বইছে নির্বাচনী হাওয়া। সম্ভাব্য প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের কাছে। উঠান বৈঠক, জনসভা, গণসংযোগ কোন কিছুই থেমে নেই। পাশাপাশি দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করার জন্য প্রার্থীরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ রকম তৎপরতার কারণে রাজবাড়ী জেলার ভোটাররা ভোটের আগেই ভোটের উত্তাপ বেশ ভালই পেতে শুরু করেছেন। পাঁচটি উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজবাড়ী জেলায় মোট আসন দুটি। দুটি আসনেই বিভিন্ন সময়ের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থীরাই বরাবর জয়লাভ করেছেন। কার্যত এ জেলাকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিও বলা হয়ে থাকে। ছোট জেলা হলেও এই জেলার ভোটাররা অনেক বেশি রাজনৈতিক সচেতন। জনগণ ভোটের মাধ্যমে বরাবরই মানুষের জন্য কাজ করেন এরকম প্রার্থীদের বেছে নিয়েছেন তাদের প্রতিনিধি হিসেবে। জেলার ভোটারদের এরকম মনোভাবের কারণে সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পুরোদমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজবাড়ী-১ (সদর ও গোয়ালন্দ) ॥ রাজবাড়ী সদর এবং গোয়ালন্দ উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজবাড়ী-১ সংসদীয় আসন। এই আসনটি জেলার অন্য আসনের চেয়ে আকারে ও আয়তনে ছোট হলেও ভৌগোলিক কারণে এ আসনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের দ্বারপথ খ্যাত দৌলতদিয়া ফেরিঘাটটি এ আসনের গোয়ালন্দ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত। এ আসনটি ঐতিহ্যগতভাবেই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ সালে এ আসনে জয়লাভ করেছিলেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ভাষা সৈনিক এ্যাডভোকেট আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরী। মাত্র এক বছরকাল তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন। ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন ওই সময় বয়সে তরুণ রাজনীতিতে নবীন বর্তমানে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও মনোনয়ন পেয়ে জয়ী হন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বিএনপিতে যোগদানকারী আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম চার দলীয় জোটের প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগের কাজী কেরামত আলী চার দলীয় জোটের প্রার্থী আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মকে পরাজিত করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন কাজী কেরামত আলী। কাজী কেরামত আলী বর্তমানে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকা দীর্ঘ। এমপি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রসহ আট জন রয়েছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায়। এর মধ্যে দুই পরিবারেই রয়েছেন চারজন। এ চারজনের দুজন আপন ভাই, অপর দুজন স্বামী স্ত্রী। রাজবাড়ীর আওয়ামী রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই কাজী ও চৌধুরী পরিবারের আধিপত্য রয়েছে। এই দুই পরিবারের মধ্যে কাজী পরিবারের কাজী হেদায়েত হোসেন ছিলেন গণপরিষদ সদস্য। ছিলেন গোয়ালন্দ মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছের লোক বলেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার তিন দিনের মাথায় ১৮ আগস্ট কাজী হেদায়েত হোসেন দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। ১৯৮২ সালে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কাজী ইরাদত আলী মাত্র ১৮ বছর বয়সে গোয়ালন্দ মহকুমা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৯১ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কাজী হেদায়েত হোসেনের বড় ছেলে কাজী কেরামত আলী। পরের বছর ১৯৯২ সালের উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। এরপর চারবার তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আগামি নির্বাচনে কাজী কেরামত আলী ও তাঁর ভাই কাজী ইরাদত আলী দুজনই মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। অপরদিকে সাবেক এমপি এ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী চৌধুরী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর বলে পরিচিত ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং গোয়ালন্দ মহকুমার গবর্নর। সর্বশেষ তিনি সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর ভাতিজা মহম্মদ আলী চৌধুরী রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। মহম্মদ আলী চৌধুরীর স্ত্রী কামরুন্নাহার চৌধুরী লাভলী সংরক্ষিত নারী কোটায় এমপি হয়েছেন। জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। স্বামী ও স্ত্রী দুজনই এবার মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের অপর মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফকির আব্দুল জব্বার, সাবেক জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আকবর আলী মর্জি, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জেলা বার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ্যাডভোকেট গণেশ নারায়ণ চৌধুরী এবং জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক এসএম নওয়াব আলী। রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগে প্রকাশ্য কোন কোন্দল বা গ্রুপিং না থাকলেও নেতাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে না পাওয়ার হতাশাও রয়েছে। অবশ্য এ বিষয়টি নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন নেতারা। তবে প্রার্থী বাছাই হতে পারে বড় ফ্যাক্টর বলে মনে করছে তৃণমূল। তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, তৃণমূল যাকে চায় দল যেন তাকেই মনোনয়ন দেয়। তাহলে আগামি নির্বাচনে এ আসনে অবশ্যই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করবে। তা না হলে ফল অন্যরকম হলেও হতে পারে। হ্যাট্রিক পার করে চারবারের এমপি কাজী কেরামত আলী। সেই ১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সেই সঙ্গে বর্তমান সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। তিনি বলেন, দল ক্ষমতায় থাকলে সবারই চাওয়া পাওয়া থাকে। কিন্তু সকলের চাহিদা মেটানো খুবই কঠিন কাজ। সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার কাজে হাত দিয়েছি। আমি রাজবাড়ীতে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকা- করেছি। এবারও মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি। মনোনয়ন প্রত্যাশী কাজী কেরামতেরই ছোট ভাই কাজী ইরাদত আলী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। তরুণ বয়স থেকেই তিনি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত রয়েছেন। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, রাজবাড়ীতে আমি বহু উন্নয়নমূলক কর্মকা- করেছি। দলের ঘোর দুর্দিনে হাল ধরে দলকে শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করিয়েছি। এযাবৎকাল যত নির্বাচন হয়েছে দলের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। বিগত পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে আমি নির্বাচন পরিচালনা করেছি। রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাহিদার কারণে আগামী সংসদ নির্বাচনে আমি এমপি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি। আশা করি দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। মনোনয়ন চাইবেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য কামরুন্নাহার চৌধুরী লাভলী ও তার স্বামী পৌর মেয়র মহম্মদ আলী চৌধুরী। দুজনের কণ্ঠে অভিন্ন সুর- আমাদের দুজনের যে কাউকে মনোনয়ন দিলে আপত্তি নেই। কামরুন্নাহার চৌধুরী লাভলী বলেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। সকল নির্বাচনে আমরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করি। কখনও তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখিনি। মহম্মদ আলী চৌধুরী বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে প্রচুর উন্নয়ন কর্মকা- করেছেন। কিন্তু কারও কারও কারণে সাধারণ জনগণের কাছে উন্নয়নের সেই বার্তা পৌঁছেনি। প্রভূত উন্নয়নের কারণে জনগণ আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনবে। কিন্তু রাজবাড়ীর জনগণ পরিবর্তন চায়। রাজবাড়ী-১ আসনের মানুষ নতুন মুখ দেখতে চায়। আমি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফকির আব্দুল জব্বার বলেন, শেখ হাসিনা চাইলে আমি অবশ্যই নির্বাচন করব। রাজবাড়ী জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আকবর আলী মর্জি বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করে আসছি। যখন ভয়ে কেউ আওয়ামী লীগের নাম মুখে নিতে পারত না তখন রাজবাড়ীতে তিল তিল করে সংগঠনকে গড়ে তুলেছি। আমি সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য রাজনীতি করি। যখন জেলা পরিষদ প্রশাসক ছিলাম যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। এ আসনে বিএনপিরও রয়েছে শক্ত অবস্থান। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত বিএনপিতে মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন চারজন। এই আসনে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে খুবই আত্মবিশ^াসী সাবেক এমপি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম। রাজবাড়ীতে জেলা বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই দু-ভাগে বিভক্ত। জেলা কমিটি ঘোষণার পর কোন্দল আরও তীব্র হয়েছে। এক গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম। অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে জেলার সহ-সভাপতি ও রাজবাড়ী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট এম এ খালেক এবং সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ। দুটি কমিটি দীর্ঘদিন ধরে আলাদা আলাদাভাবে তাদের কর্মসূচী পালন করে আসছে। দলের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আলী নেওয়াজ খৈয়ম খুবই আত্মবিশ^াসী। তিনি বলেন, দলে বিভেদ ও কোন্দল থাকতেই পারে। নির্বাচনের সময় দল ও দেশের স্বার্থে সবাই এক হয়ে যাবে। মনোনয়ন যে কেউ চাইতে পারে। কিন্তু দল আমাকেই মনোনয়ন দেবে। অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী রাজবাড়ী জেলা বিএনপির সহসভাপতি এ্যাডভোকেট এম এ খালেক। বর্তমানে রাজবাড়ী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তিনি। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে রয়েছেন দলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আলী নেওয়াজ খৈয়ম বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। এরপর প্রতিকূল সময়ে আমি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। আমি নিজের স্বার্থের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করি। দল আমাকেই মনোনয়ন দেবে। জেলা বিএনপির সহসভাপতি আসলাম মিয়াও দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একজন স্বচ্ছ ইমেজের মানুষ হিসেবেও এলাকায় তার সুনাম রয়েছে। আসলাম মিয়া বলেন, দলের দুর্দিনে আমি পাশে ছিলাম। আছি এবং থাকব। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। তৃণমূলের সঙ্গে আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। মনোনয়ন প্রত্যাশী তোফাজ্জেল হোসেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি। ছিলেন রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়র। বলেন, আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করব। ১৯৯১ সালের পরে এই আসনে মাত্র একবারই জাতীয় পার্টির প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পেরেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম মোস্তফা। আগামী নির্বাচনে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান বাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক মোকছেদুর রহমান মোমিন মনোনয়ন প্রত্যাশী। জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বাচ্চু বলেন, জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলে আমি প্রার্থী হবো। মহাজোটগতভাবে নির্বাচন করলেও আমি মনোনয়ন চাইব। রাজবাড়ীর-২ (পাংশা-বালিয়াকান্দি-কালুখালী) ॥ ঐতিহ্যগতভাবেই আসনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আসনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের খোন্দকার নুরুল ইসলাম। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জাসদের আব্দুল মতিন মিয়া, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে নাজির হোসেন চৌধুরী, ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জাসদের মোসলেম উদ্দিন মোমেন এমপি নির্বাচিত হন। নব্বই’র গণঅভ্যুত্থানের পর ৯১ সালের সংসদ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ন্যাপের ইঞ্জিনিয়ার নাসিরউদ্দিন। ওই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ডাঃ আসজাদ হোসেনের কাছে পরাজয় বরণ করতে হয় তাকে। ‘৯৬ সালের নির্বাচনে জিল্লুল হাকিমের বিজয়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো বিএনপির কোন প্রার্থী জয়লাভ করেন। এ নির্বাচনে বিএনপির নাসিরুল হক সাবু জয়ী হন। পরাজিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিল্লুল হাকিম। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন জিল্লুল হাকিম। ২০১৪ সালে অন্য প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবারও নির্বাচিত হন জিল্লুল হাকিম। আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি জিল্লুল হাকিম এবারও মনোনয়ন চাইবেন। মনোনয়নের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন আরও তিনজন কেন্দ্রীয় নেতা। এই তিন কেন্দ্রীয় নেতা হলেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ এম ইকবাল আর্সনাল, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী হক এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ সোহেল রানা টিপু। বর্তমান এমপি জিল্লুল হাকিম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিন তিনবারের নির্বাচিত এমপি তিনি। সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। হাজার হাজার নেতাকর্মী রয়েছে এ দলে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আমি পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। আমি দলকে সুসংগঠিত করেছি। সাংগঠনিকভাবে দল এখন শক্তিশালী। আগামী নির্বাচনে আমি মনোনয়ন পাবো বলে আশা করি। এদিকে মনোনয়ন প্রত্যাশী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ডাঃ ইকবাল আর্সনাল বলেন, আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা আজ উপেক্ষিত। তাদের দুর্দিনে আমি তাদের পাশে থাকতে চাই। ডাঃ ইকবাল আর্সনাল দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় গণসংযোগ করছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। এলাকায় পোস্টার, ব্যানার দিয়ে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিয়েছেন। ইকবাল আর্সনাল বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। দীর্ঘদিন ধরে আমি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। নিজ পেশার জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি। অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। কিন্তু ছোট এ পরিসরে থেকে সেটা সম্ভব নয়। বর্তমানে রাজবাড়ীতে আওয়ামী রাজনীতির যে অবস্থা তা খুবই দুঃখজনক। আজ দলের ত্যাগী পরীক্ষিত ও প্রবীণ নেতাকর্মীরা চরমভাবে উপেক্ষিত। তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। এজন্য আমি তৃণমূলে যেতে চাই। নিপীড়িত কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে চাই। আগামী নির্বাচন দেশ ও দলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন মুহূর্তে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে আমি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও দৈনিক জনতার আদালত পত্রিকার সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী হক। অনেকদিন ধরেই মাঠে তিনি। সামাজিকমূলক কর্মকা- করে ইতোমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন মাঠ পর্যায়ে। ২০১৪ সালে কালুখালী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নজর কাড়েন সকলের। খুব সামান্য ভোটে পরাজিত হলেও ভোটারদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনিও মনোনয়নের অন্যতম দাবিদার। নুরে আলম সিদ্দিকী হক বলেন, আমি দলের দুর্দিনে বঙ্গবন্ধুর একজন সৈনিক হিসেবে কাজ করেছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সুখে দুঃখে পাশে থেকেছি। বর্তমান সময়ে দলের যে দুরবস্থা বিরাজ করছে সেটা কাটিয়ে ওঠা খুবই জরুরী। তাই এ আসনে প্রার্থী বদলের কোন বিকল্প নেই। আমি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। তরুণ উদীয়মান নেতা শেখ সোহেল রানা টিপু স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। ছিলেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখার সভাপতি। ওয়ান ইলেভেনের সময় দলের দুর্দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়নের অন্যতম দাবিদার ছিলেন। এবারও অনেক আগে থেকেই মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। গণসংযোগ করছেন নিয়মিতই। শেখ সোহেল রানা বলেন, ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে রাজনীতি করছি। দলের দুর্দিনে পাশে থেকেছি। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের পাশে আছি। দলের নীতি আদর্শ থেকে কখনও বিচ্যুত হইনি। সব সময় নেত্রীর নির্দেশ মেনে চলেছি। অবশ্যই আমি মনোনয়নের অন্যতম দাবিদার। নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করব। এই চারজনের বাইরে মনোনয়ন চাইতে পারেন পাংশা পৌরসভার বর্তমান মেয়র আব্দুল্লাহ আল মাসুদ বিশ^াস, পাংশা উপজেলা চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদ। রাজবাড়ী-২ আসনে অন্যান্য মনোনয়নপ্রত্যাশীর মতো নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য সলিসিটর মুহাম্মদ মেহেদী হাসান। মেহেদী হাসান বলেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নৌকা মার্কার পক্ষে আমি প্রচার করছি। আমাকে মনোনয়ন দিলে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিষয়ে সোচ্চার থেকে কাজ করব। মনোনয়ন না দিলেও নৌকার পক্ষে কাজ করব। আশা একটাই নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করব। বিএনপির জন্য আসনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিগত দশটি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারির ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন বাদ দিলে মাত্র একবার এই আসন থেকে জয়লাভ করতে পেরেছে তারা। রাজবাড়ীতে বিএনপি দলীয় কোন্দলে জর্জরিত। দুই ভাগে বিভক্ত জেলা বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরে খৈয়ম গ্রুপ এবং খালেক-হারুন গ্রুপ পৃথক পৃথকভাবে কর্মসূচী পালন করে আসছে। সাবেক সাংসদ নাসিরুল হক সাবুর সঙ্গে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদের দ্বন্দ্বটাও দীর্ঘদিনের। বিএনপির মধ্যেকার কোন্দল নিরসন না হলে এই আসন পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে। মনোনয়ন প্রত্যাশী নাসিরুল হক সাবু জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি। ২০০১ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। এবারও মনোনয়নের জন্য চেষ্টা চালাবেন। যদিও পাংশায় বিএনপির কার্যক্রম অনেকটাই ঢিলেঢালা ভাবে চলছে। মনোনয়ন প্রত্যাশী নাসিরুল হক সাবু বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আমি মাঠে আছি। ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। দলের কোন কোন নেতা আওয়ামী কানেকশনে থাকে। তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। নির্বাচনের আগে এসব সমস্যার সমাধান করাও জরুরী। মনোনয়নের অন্যতম দাবিদার জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ। তরুণ এই নেতা অনেক আগে থেকেই শুরু করেছেন গণসংযোগ। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা যে কোন উপলক্ষে সব শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনিও বেশ আশাবাদী। তিনি বলেন, নির্বাচনে গেলে আর আমাকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই আমি ভাল কিছু উপহার দেব। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা খুব কঠিন। এর মধ্যে খুব কৌশলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি। রাজবাড়ী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর আমি দায়িত্ব পালন করেছি। কেন্দ্রের নির্দেশ শতভাগ পালন করেছি। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সেন্টিমেন্টকে প্রাধান্য দিয়ে সেভাবে চলার চেষ্টা করেছি। আমার কোন দুর্বলতা নেই। আমি মনোনয়ন পাব বলেই আশা করি। তারপরও আমাকে বাদ অন্য কাউকে যদি দল মনোনয়ন দেয় তাহলে ধানের শীষ প্রতীককে বিজয়ী করার জন্য আমি তার পক্ষে কাজ করবো। বিএনপির এ দুজনের বাইরে মনোনয়ন চাইবেন কালুখালী উপজেলা বিএনপির সভাপতি লায়ন আব্দুর রাজ্জাক। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী তিনি। ইতোমধ্যে পোস্টার ব্যানার করে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি খুবই আশাবাদী। মনোনয়ন চাইবেন বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি গোলাম শওকত সিরাজ। এ দুদলের বাইরে জাতীয় পার্টি থেকে চাইবেন পাংশা উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা জাতীয় পার্টির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শাহ মোঃ রাকিবুল ইসলাম শামীম। ইতোমধ্যে তিনি এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছেন। মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে লবিং করছেন। বয়োবৃদ্ধ বর্ষীয়ান নেতা এ্যাডভোকেট এবিএম নুরুল ইসলামও মনোনয়ন চাইতে পারেন। বর্তমান এমপি জিল্লুল হাকিম তৃণমূলে ব্যাপক কাজ করেছেন। এই আসনে ব্যাপক যে উন্নয়ন কার্যক্রম হয়েছে সেটা বর্তমান এমপির হাত ধরেই হয়েছে। কর্মীরা তার কাছ থেকে কোনদিন নিরাশ হয়ে ফিরে যাননি। এলাকায় থেকে কর্মীদের সুখে দুঃখে পাশে থেকেছেন। তাদের যে কোন বিপদে আপদে এগিয়ে এসেছেন। এই কারণে জিল্লুল হাকিম তৃণমূলের সমর্থনে আবারও এই আসনে মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে কর্মীদের ধারনা। অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী ডা. ইকবাল আর্সনাল এর পিতা এই আসনের সাবেক এমপি জামায়াতে ইসলামীর ডা. আসজাদ হোসেনের কারণে ইকবাল আর্সনালের প্রতি ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরূপ ধারণা রয়েছে।
×