ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

তিউনিসিয়ায় নারী অধিকার রক্ষায় বিশেষ আইন

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 তিউনিসিয়ায় নারী অধিকার রক্ষায় বিশেষ আইন

তিউনিসিয়ায় গত বছরের ২৬ জুলাই পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হয়েছে যার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বিলোপ করাই আইনটির লক্ষ্য। আইনে অনেক কিছুর মধ্যে নারীদের বিরুদ্ধে শারীরিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং প্রকাশ্যে হয়রানি বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে। আগে ধর্ষণকারী পুরুষের ধর্ষিতাকে বিয়ে করে কারাবাস পরিহার করার একটা সুযোগ ছিল। নতুন আইনে সেই রেওয়াজটিও বাতিল করে দেয়া হয়েছে। তিউনিসিয়া এমন এক দেশ সেখানে যেখানে ২০১০ সালের এক জাতীয় জরিপ অনুযায়ী ৪৮ শতাংশ নারী কোন না কোন ধরনের সহিংসতার শিকার। সেদিক থেকে এই আইনটি নারী অধিকার কর্মীদের জন্য এক বিরাট বিজয়। কাগজে-কলমে দেখলে আইনটি এ অঞ্চলের সেরা আইন এবং সম্ভবত বিশ্বেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ আইন বলে মন্তব্য করেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর সিনিয়র গবেষক আষনা গুয়েল্লালি। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই আইনটি প্রত্যাশিত ফল বয়ে আনতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ইতিবাচক কিছু কিছু ফল যে পাওয়া যায়নি তা নয়, তবে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে এবং নারীদের স্বার্থ রক্ষায় ও অপরাধীর বিচারে এটি প্রতিশ্রুত উন্নতি ঘটাতে পারেনি। তাই অধিকারকর্মীরা এখন চাপ দিচ্ছে যাতে করে আইনটি নিশ্চিতভাবে নারীদের জীবনের ওপর সত্যিকারের প্রভাব রাখতে পারে এবং এ অঞ্চলে নারী অধিকারের দীর্ঘদিনের পথিকৃৎ তিউনিসিয়া যেন নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য দেশকে পথ দেখাতে পারে। এই লড়াইয়ের সামনের কাতারে রয়েছে তিউনিসিয়ার নারী গণতন্ত্রী সমিতি (এটিএফডি)। এই সংগঠনই তিউনিসিয়ায় প্রথম নারী আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। সমিতি এখনও এই আদি কেন্দ্রটি এবং সেই সঙ্গে আরও অনেক কেন্দ্র চালিয়ে আসছে। এই সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আহলেম বেলহাজ (৫৩) পেশায় শিশু মনস্তত্ত্ববিদ। তিনি তাঁর পেশা ও এসব কাজের মধ্যে সময়ের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন। তিনি বলেন, নারী অধিকার নিয়ে তার কাজের শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালে যখন তিনি নির্যাতিত বেশ কিছু মেয়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। এই মেয়েরা তাদের ধর্ষকদের বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। তখনকার আইন ছিল ২০ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ে ধর্ষিত হলে তার ধর্ষক যদি তাকে বিয়ে করে তবে সেই ধর্ষণকারী কারাদন্ড থেকে রেহাই পেতে পারে। এর দু’বছর পরই সেই পুরুষটি তাঁকে তালাক দিয়ে দিতে পারে। তাতে কোন বাধা নেই। বিবাহকে তখন ধর্ষণের লজ্জা ও অপমান থেকে বাঁচার একটা উপায় হিসাবে দেখা হতো। এই শ্রেণীর মেয়েরা বিয়ের ব্যাপারে শুধু ধর্ষক ও তার পরিবারের দিক থেকে নয়, তার নিজ পরিবারের দিক থেকেও চাপের সম্মুখীন হতো। ধর্ষণ দিয়ে যে বিয়ের শুরু সেই ধর্ষণই যে শেষ তা মোটেও নয়। তিউনিসীয় নারী গণতন্ত্রী সমিতির প্রাক্তন সভানেত্রী বেলহাজ বলেন, তিনি ও অন্য অধিকারবাদীরা নিজের ধর্ষককে বিয়ে করার এই ধারাটি তুলে দেয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। যাদের পক্ষে তারা এই আন্দোলন করেছিলেন তাদের মধ্যে ১২ বছরের এক বালিকাও ছিল যে তাঁর ধর্ষককে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। মেয়েটির বয়স ২০ বছর না হওয়া পর্যন্ত বেলহাজ তার পাশে দাঁড়িয়ে লড়েছেন। তার প্রতি ভয়ঙ্কর অত্যাচার করা হয়েছিল। এরপর গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন আইন চালু হয়। এ ছিল এক বিশাল পরিবর্তন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশটির নারী অধিকারকর্মীরা তাদের কঠোর সংগ্রামের সুফল দেখতে শুরু করে। নতুন আইনটি কিভাবে মেয়েদের মধ্যে অধিকতর আস্থার সঞ্চার করেছে তার ব্যাখ্যা করে মনস্তত্ত্ববিদ সেই ফির তেলিহ বলেন আগে কলঙ্কের কালিমা লেগে যাবে এই লোকলজ্জায় ধর্ষিতারা অভিযোগ বা মামলা দায়ের করতে দ্বিধা করত। নতুন আইন তার মধ্যে এই বোধ এনে দিয়েছে যে সে ধর্ষিতা কি-না তা বিচার করার দায়িত্ব আর কারোর নয়। সে যদি মনে করে যে, ধর্ষিতা বা সহিংসতার শিকার তাহলে নিজের অধিকারের জন্য তাঁর লড়াই করা উচিত। তিউনিসিয়ার পুলিশকে এখন ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে আসা নারীকে হাসপাতালে পাঠানোর প্রয়োজন হয়। সেখানে একজন ফরেনসিক ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে দেখবে। ইতিহাসগতভাবে পুলিশ বহুলাংশেই নারী নির্যাতন মোকাবেলার ক্ষেত্রে সমস্যার একটা অংশ ছিল। অভিযোগ আছে, এটা একটা সাধারণ রেওয়াজ ছিল যে কোন ধর্ষিতা থানায় অভিযোগ নিয়ে আসলে পুলিশ তাকে বোঝাত সে যেন অভিযোগটা বাদ দেয়। কিংবা স্বামীর হাতে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা থাকলে তাকে পরামর্শ দিত এটা একটা ঘরোয়া ব্যাপার যা স্বামীর সঙ্গে মিটিয়ে ফেলাই ভাল। নতুন আইনে এ জাতীয় অভিযোগ গ্রহণ না করলে পুলিশের জেল হয়ে যেতে পারে। ফরেনসিক ডাক্তাররা বলেন তারা এখন দৈনিক আরও বেশি সংখ্যক মহিলার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। মাহিদা শহরের একটি হাসপাতালের এমন এক ডাক্তার আবীর আসিয়াউ জানান তিনি এখন সপ্তাহে ছয় জন রোগী দেখছেন আগে যা ছিল দুইজন। এটা যে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য হয়েছে তা নয়, বরং বিচারের দাবিতে এগিয়ে আসতে মহিলারা অধিকতর ক্ষমতাবান হয়ে উঠছে বলে মনে করে এবং পুলিশও এই ঘটনাগুলোর ব্যাপারে আরও যথাযথভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে। নারী নির্যাতন পরিস্থিতির উন্নতির এসব লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা অধিকারকর্মীদের কাছে এখনও সুদূরের স্বপ্নই রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে অর্থ এক মস্তো বাধা। আইন যাতে নারীদের সুরক্ষার উন্নত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করে তার জন্য উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন কিভাবে হবে আইনে তা সুস্পষ্টভাবে বলা নেই এবং চলতি বছরের বাজেটেও তার কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। আইনে যদিও বলা আছে যে যেসব নারীর প্রয়োজন তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষকে করতে হবে। তবে সেই আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য অর্থের আলাদা কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। ধর্ষণের শিকার নারীরা এটিএফডির আশ্রয়কেন্দ্র এবং এর আইনগত ও মনস্তাত্ত্বি¡ক সমর্থনের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। তবে এর কর্মচারীরা জানিয়েছে যে তারা ঠিকমতো বেতন-ভাতা পায় না। ফাতেমা হামদর (৬০) প্রতিবেশীদের দ্বারা বছরের পর বছর ধরে নিগৃহীত হওয়ার পর এই সংগঠনটিকে খুঁজে বের করেছে। গরিব পরিবারের মহিলা হামদর থাকে তিউনিসের উপকণ্ঠে। কারুপণ্য তৈরি ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। পুলিশী ভূমিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে হামদর তার কাহিনী খুলে বলে। সে জানায় যে প্রতিবেশীদের শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে সে বার বার পুলিশের কাছে গেছে। কিন্তু পুলিশ তা কখনই আমলে নেয়নি। বেশ কয়েক দফা অভিযোগ পাওয়ার পর এক পুলিশ অফিসার এতই ক্ষেপে যান যে তাকে মারধর শুরু করে। তার মেয়ে মায়ের হাঁপানি আছে এ কথা বলে কাতর কণ্ঠে প্রহার থামানোর অনুরোধ করলে অফিসারটি তাকেও মারধর করে মাটিতে ফেলে দেয়। ততক্ষণে হামদর হাঁপানি শুরু হয়ে গেছে। নতুন আইন বাস্তবায়নে পুলিশকে সক্রিয় করে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিউনিসীয়রা বলে যে এই তো মাত্র ২০১১ সালে পতন ঘটা একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলে পুলিশের হাতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ছিল। সেখানে পুলিশকে সঠিকপথে নিয়ে আসা সবিশেষ কঠিন কাজ। তার পরও লোকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারী সংস্থা ক্রেডিফের পরিচালিকা ডালেন্ডা লার্গুচি তিউনিসিয়ায় নারীদের অবস্থা উন্নয়নের ওপর দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন সেখানে ছাত্ররা মানবাধিকার বিশেষ করে নারী অধিকার নিয়ে আলোচনা করে থাকে। তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রথম আমাদের সামনে নানা ধরনের বাধা আসত। কিছু কিছু পুলিশ অফিসার বলতেন, তিউনিসিয়ার মহিলারা ইতোমধ্যেই অনেক অধিকার ভোগ করে এসেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় সবাই বাস্তবতা উপলব্ধি করেছে এবং বলেছে তারা আরও ট্রেনিং লাভে আগ্রহী। তবে এখন যে বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন তা হলো বিচারকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন। এদের অনেকে এই আইনের ঘোরবিরোধী। দাম্পত্য জীবনে সহিংসতা প্রমাণ করা অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বিধায় বিচারকরা অপরাধীকে প্রায়ই ছেড়ে দেয়। কিছু নাগরিক অধিকার সংগঠন বিচারকদের মানসিকতার পরিবর্তন আনার জন্য ট্রেনিং কর্মসূচীর আয়োজন করলেও এ পর্যন্ত তারা তাদের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। সূত্র : টাইম
×