ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদন ॥ এক বৈষম্যহীন মানবপ্রেমের দলিল

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদন ॥ এক বৈষম্যহীন মানবপ্রেমের দলিল

Secret Documents of Intelligence branch on father of the nation—Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman; Volume-I – ১৯৪৮-১৯৫০ পাঠ করে আমার মধ্যে যে ভাবতরঙ্গের জন্ম হয়েছে তারই সারমর্ম নিম্নলিখিত বিষয়। এতে অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। দ্বিমত পোষণ করা প্রত্যেকের আপন অধিকারের সীমার মধ্যেই পড়ে। রাজ্য আর রাষ্ট্রের মৌলিক পার্থক্য মুসলিম লীগ রাজনীতিকরা, মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা, রাষ্ট্রনায়ক-রাষ্ট্র কর্মচারীরা বুঝতে পারেনি অথবা বুঝতে চায়নি। রাজকীয় প্রজাতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের হেরফের নিয়ে যে ভাবেনি সেটা প্রত্যেকের কার্যকলাপ-তৎপরতার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। গণতন্ত্র নাগরিকের কতগুলো মৌলিক অধিকার স্বীকার করে—একই সঙ্গে আকাক্সক্ষা ও মনোভাবনার স্বাধীনতা স্বীকৃত। অনেক ব্যাপার রাজার রাজ্যে রাজদ্রোহ বলে বিবেচিত হলেও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত। কথা বলা, মত প্রকাশ, চলাফেরার স্বাধীনতা, জীবন-জীবিকার অধিকার এসবই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই বোধটি- ধারণাটি ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রটির কোন রাষ্ট্রনায়ক অথবা রাষ্ট্র কর্মচারী কার কার্যকলাপেই দৃষ্ট হয় না। মুহম্মদ আলী জিন্না, লিয়াকত আলী খান, শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দী, ইস্কান্দর মির্জা, আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া সবাই একই কাতারের লোক। কারও ভাবনাতেই রাজকীয় ভারত উপনিবেশ নাগরিক অধিকার মূল সূত্রে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আবির্ভূত, তার কোন চেতনা কারও কার্যকলাপেই নজর কাড়ে না। এ যেন শরিকি বাটোয়ারা দুই শরিক হিন্দু-মুসলমানের বাড়ি পেন্সিলের একটানে ভাগ করে সীমারেখা টেনে দিল। পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, দিল্লী, বাংলা- খানেই দুই ধর্মের ভ্রাতৃ দাঙ্গায় মানবতা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, নিহত হয় শান্তি। এভাবেই ভারত ডোমিনিয়ন ও পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিকের জন্ম। যত রক্তপাতই হোক, যত ক্ষতি স্বীকার জনপরিসর করুক শাসন, শোষণ, বঞ্চনা-অবহেলা, আইনি মারপ্যাঁচে নাগরিককে হয়রানির কোন অবসান হয় না- বরং মাত্রা বৃদ্ধিই পায়। রাষ্ট্র কর্মচারীরা, রাজকর্মচারীদের চেয়ে আরও বড় নিষ্পেষক ও নিষ্ঠুর নির্যাতকে রূপ নেয়। ধর্ম আর রক্তের বাতাবরণে যে রাষ্ট্রের উদ্ভব সে রাষ্ট্রে ন্যায়-নীতি ও নাগরিক অধিকার অস্বীকৃত যে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খুবই গতানুগতিকভাবে দুটি রাষ্ট্র পৃথিবীবুকে ‘আবির্ভূত’ হয়। দুটি দেশের মধ্যে কোন দেশের রাষ্ট্র পরিচালকই বিবেচনায় নিলেন না একটা ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো পরিবর্তন না ঘটিয়ে কী করে গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা যায়? ব্রিটিশ ভারতের পেয়দা থেকে সর্বোচ্চ মুখ্য সচিব পর্যন্ত কোন রদবদল না ঘটিয়ে রাষ্ট্র দুটির ‘শুভযাত্রা’ (?) ঘটে। যে রাষ্ট্রের ‘শুভযাত্রা’ পটপরিবর্তন না ঘটিয়ে শুরু হয় সে রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকার দাবিকারী কোন ব্যক্তিকে ‘শত্রু পক্ষ’ মনে করাটাই কি স্বাভাবিক নয়? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এই ডকুমেন্টের প্রতিবেদন আমার মতামতেরই প্রতিফলন মাত্র। আমরা প্রথমে Intelligence Branch-i Sub-Inspector-এর ১৩.০১.১৯৪৮ সালের প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করছি— Sir, I beg to report that being deputed by D.S.1. I had been to “Burdwan House” Ramna, Dacca. The Muslim League Party Meeting started at 6.30 P.M. Hon’ble Ministers I.I. Chundregar, Abdur Rab Nistar and Pirjada Abdus Sattar were present in the meeting. At about 5.45 P.M. a deputation of about 30 girls both Hindu and Muslim came in a procession shouting slogans “Inquilab Zindabad” “আমাদের দাবি মানতে হবে”, and saw the H.P.M. at his residence., The deputation was led by Miss Layla who ventilated their grievances and urged the H.P.M. for reopening their college without delay. Some unknown persons distributed leaflets (1) under the heading “পাকিস্তানের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা নষ্ট করিও না”, issued by Idris Ahmad, President South Bakarganj Santi Prachar Samiti, Mahepur, Khepupara, a copy of the same is attached. Another leaflet (2) under the heading “পূর্ব পাকিস্তানের কন্ট্রোল রহিত কাউন্সিল অব এ্যাকশনের বিজ্ঞপ্তি”, issued by Barkat Ali, Pleader, Barisal, and Md. Azezur Rahman (Amerul Mozahedin) Joint Secretary, Eastern Pakistan Anti Control Council of Action, was also distributed by some other unknown persons. A copy of the same is enclosed. Some unknown workers of Eastern Pakistan Muslim League workers camp sold booklets @3/- each entitled ‘পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগা জনসাধারণ কৈফিয়ত দিতে হবে আমাদের দাবি’, Published by Sk. Mujibar Rahman, B.A. and Naimuddin Ahmad, B.A. (Hon.) Eastern Pakistan Muslim League workers camp of 150 Mogultooly, Dacca. A copy of the booklet is enclosed. About 300 persons collected in front of the “Burdman House” most of whom were found to be interested only in seeing the Dominion Ministers. Nothing untoward happens and the crowd dispersed when they were not allowed to enter the compound of Burdwan House. This is for your information. Submitted. Sd/- Illigible S.I, I.B., 13.1.48. এতেই প্রমাণ হয় আমি পূর্বে যে মত প্রকাশ করেছি তার যৌক্তিকতা। IB-i Sub-Inspector চাকরিতে যোগ দিয়েছিল ব্রিটিশ ভারতে। তার দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল ভারতীয় স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা কে কোথায় যায়, কার সঙ্গে দেখা করে, কী কথা বলে তা জানা এবং উর্র্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো। সেই কাজটি IB-i SI যথার্থ নিষ্ঠার সঙ্গে ১৩.০১.১৯৪৮ সালেও করেছেন। ইতোমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের তরুণ প্রজন্মের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন এবং শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর ‘চেলা’ বলে পূর্ববাংলার রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত তাদের কাছে ‘শত্রু পক্ষে’র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে চিহ্নিত। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ষড়যন্ত্র করে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী হতে দেননি। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর ‘চেলা’ শেখ মুজিবের গতিবিধি নজরদারিতে তো রাখতেই হবে। তাই ১৩.০১.১৯৪৮ তারিখে নবগঠিত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল পূবর্বঙ্গে মুজিবের নামে নতুন খাতা খোলা হয়। এখানেই আমার প্রশ্ন, শেখ মুজিব কি হঠাৎ করে ’৪৮ সালে উদয় হয়েছেন? ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবের বয়স ২৮ বছর। আমরা জানি, ১৯৪০ সালে শেখ মুজিব কলকাতার কারমাইকেল হোস্টেলে থাকেন এবং ইসলামিয়া কলেজে পড়েন। শেখ মুজিবের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তৎকালে তিনি কলকাতায় যথেষ্ট রকম রাজনৈতিক তৎপরতায় তৎপর ছিলেন। যেখানে ১৫ খণ্ডের বিশাল আকারের কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মত দিয়েছেন- সেখানে তিনি যদি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে অথবা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মুজিবের পাকিস্তান স্বাধীনতা-পূর্ব গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও কলকাতার তৎপরতা বিষয়ক ওই Report সংগ্রহ ও সন্নিবেশিত করতে আগ্রহ প্রকাশ করে তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানাতেন- তাহলে ভারত সরকার অবশ্যই সৌজন্য প্রদর্শন করতো। তাহলে কর্মকাণ্ডটি আরো সমৃদ্ধ এবং তথ্যবহুল হতো তাই নয়- বাস্তবানুগ হতো বলে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ আছে। তা হয়নি বলে আলোচনা থামিয়ে দেয়া যাবে না, যা হয়েছে তাও কম নয়। এই পরিসরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতে হবে; একই সঙ্গে সংগ্রাহকদের- যারা এই শ্রমসাধ্য কাজটি করেছেন। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের প্রথমেই অধার্মিক কাজ- বৈষম্যের জন্ম দেয় করাচীকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণা করে। করাচী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মশহর। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের মহান নেতা। মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গণতন্ত্র এবং ধর্ম দুটিই মার খায়। অস্বীকৃত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার, উপেক্ষিত হয় বাঙালীর আবেগ-ভালবাসা। অবজ্ঞার সঙ্গে প্রচার শুরু হয় বাংলা হিন্দুর ভাষা, উর্দু ইসলামের ভাষা- উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৩.১.৪৮-র প্রতিবেদনটিকে শুধু ঘটনা ভাবলে চলবে না। বর্ধমান হাউজে ওইদিন শুধু মুজিব আর তার সহযোগী গেছেন তাই নয়, কৌতূহলী দর্শকও গেছেন। যাদের আগ্রহ রাজ্যের (Dominion) ক্ষমতাধর মন্ত্রী দেখা। জনগণ ইতোপূর্বে ঢাকায় এত মন্ত্রীর আনাগোনা দেখেনি। মন্ত্রী দেখতে কেমন এবং নিজেদের চেয়ে আলাদা কী না তেমন কৌতূহল আর কী। Most of whom were found to be interested only in seeing the Dominion Ministers” বলে মুজিব ও তার সঙ্গী-সাথীর আগমনকে হাল্কা করতে চেয়েছেন। কিন্তু বর্ধমান হাউসে উপস্থিত সবার হাতে ছিল বিভিন্ন দাবি সংবলিত ফেস্টুন। ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’, ‘পাকিস্তানের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা নষ্ট করিও না’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের কন্ট্র্রোল রহিত কাউন্সিল অব এ্যাকশনের বিজ্ঞপ্তি’ এবং মুজিব ও নঈমুদ্দিনের নামে প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগা জনসাধারণকে কৈফিয়ত দিতে হবেÑ আমার দাবি। উপস্থিতির গুরুত্ব কম দেখাতে ঔপনিবেশিক কায়দাই ‘দারোগা’ ব্যবহার করে। তামাশা দেখার লোক তখন পাওয়া যেত না। পুলিশের ত্রিসীমানায় সাধারণ মানুষ ঘেঁষতে ভয় পেত। রাজ অতিথির দর্শন তারাই চাইত যারা সমাজের উঁচু তলার লোক, নতুবা দেশগতপ্রাণ আন্দোলনকারী। উপস্থিত কেউ দর্শক ছিল না, ছিল আন্দোলনকারী। মুজিব অনুগামী-অনুসারী না হলেও মুজিবসঙ্গী। এই প্রতিবেদনে এও স্পষ্ট হয়, স্বাধীনতা আন্দোলন বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলন কতটা মেকি এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপার ছিল মাত্র। সুপরিকল্পিত কোন ব্যাপারই যদি হবে তবে স্বাধীন পাকিস্তানে ব্রিটিশরাজের আইন-বিধি প্রচলন থাকে কী করে? একটানে সব বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কথা সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। কিন্তু অচলায়তন ভাঙেনি বলেই মাত্র ছয় মাসের মাথায় স্বাধীনতাকামী মানুষ পুনরায় হাতে ফেস্টুন, কণ্ঠে দাবি তুলে Dominion-G--র মন্ত্রীর সামনে উপস্থিত হয়। (অসমাপ্ত) লেখক : প্রবীণ রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী
×