ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

॥ পর্ব -ছয় ॥ (গতকালের পর) ভারতের মোটামুটিভাবে সব দৈনিকই নিয়মিত গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করত মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর এবং হানাদার পাক বাহিনীর গণহত্যা নারী ধর্ষণ ও শিশু হত্যার মতো অমানবিক ও পাশবিক কাহিনী। এতে প্রথম থেকেই বিপজ্জনক ব্যাপকভাবে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার মোটামুটিভাবে বলতে গেলে সম্পূর্ণভাবে বিরুদ্ধে চলে যায় শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি মুসলিম দেশ ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন মার্কিন সরকার ব্যতীত। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা উত্তরকালে কমনওয়েলস্থ প্রেস ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে লন্ডনে দুবছর তাদের বার্ষিক সভা ও ডিনারে যোগদান করে এবং কানাডায় অনুষ্ঠিত সভায় যোগদান করে আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের শক্তিশালী লেখনি দিয়ে আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। যুক্তরাজ্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারতসহ আরও কয়েকটা দেশের এমন কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে নানা আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টিও স্থান পেয়েছিল। তাদের অধিকাংশ অভিমত যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ স্বাধীনতার প্লোক্লামেশন থেকে শুরু করে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানের মতো অন্যতম একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করানো পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল দূরদর্শী কৌশলী সাহসী বলিষ্ঠ এবং উচ্চমানের সামরিক, রাজনৈতিক এবং মানসতাত্ত্বিক, কূটনৈতিক সাফল্য তারা মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন তারা বিশেষ করে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর মতো বলিষ্ঠ নেতাকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময়ে প্রতিটি বিষয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক এবং সর্বশেষে কূটনৈতিক আশা আকাক্সক্ষার সঙ্গে পুরোপুরিভাবে সমন্বয় সাধন করে স্বাধীনতা অর্জনের পথে ক্রমাগতভাবে এগিয়ে যেতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যথার্থভাবেই বলে থাকেন যে, কোন দেশ, জাতি অথবা গোষ্ঠী যখন একটা চরম পরিস্থিতি অথবা সঙ্কটের মধ্যে পতিত হয় তখনই শুরু হয় তাদের বিরুদ্ধে নানাদিক থেকে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের কালো হাতের হাতছানি। একটা অবাস্তব ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিম-ল নিয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন থেকেই স্বপ্রতিষ্ঠিত শাসকগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গ পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান নামক অঞ্চলে বসবাসকারী রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকগোষ্ঠীর প্রতি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামাজিকভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ ক্রমাগতভাবে চলার ফলে দেশটিতে এমন একটা বিরূপ ও বৈষম্যপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ফলে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রথম সার্বজনীন সাধারণ নির্বাচনে বাঙালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে পাকিস্তানের তথাকথিত এবং স্বপ্রতিষ্ঠিত সামরিক ও বেসামরিক শাসকগোষ্ঠী দেশটিকে পরিচালনা করার সব রকমের রাজনৈতিক ও নৈতিক অধিকার হারায় যা তারা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। শুরু হয় নতুন করে ষড়যন্ত্রের গুটি চালনা। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালী নিধনে। তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে বাঙালীরা আর কোনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারবে। তারা মনে করতো, বাঙালী বেসামরিক লোকদের ওপর এমনি ধরনের সামরিক অভিযান প্রতিহত এবং প্রতিরোধ করার প্রশ্ন তো উঠেই না। এদিকে বাঙালীরা তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে যার যা ছিল তাই নিয়ে ঘরে ঘরে গড়েছিল দুর্গ এবং তাই দিয়ে তারা গড়ে তোলে প্রতিরোধ আন্দোলন পাক সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পূর্বেই তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠন করা হয় প্রবাসী মুজিবনগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিব নিয়োগ করেন এবং তাদের অধীনে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে দৈনন্দিন প্রশাসনিক কূটনৈতিক, আর্থিক, পুনর্বাসন প্রভৃতি কার্যাবলী পরিচালনা করতে শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ক কার্যাবলী সমন্বয় করার দায়িত্ব দেয়া হয় তৎকালীন কর্নেল এমএজি ওসমানীকে এবং আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এক একজন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত হয়ে সারাদেশে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের অগ্রযাত্রা পরিহত করে এগিয়ে চলে বীরবিক্রমে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধে ক্রমাগতভাবে হানাদার পাকবাহিনী যখন দুর্বল হয়ে পড়ছিল এবং প্রতিদিনই যখন তাদের হাতহতের সংখ্যা বাড়তে ছিল এবং প্লেন ভর্তি করে পাক সেনাদের লাশ যাচ্ছিল তাদের দেশে, তখন তারা শুরু করে নতুন এক ষড়যন্ত্র তাদের এই ষড়যন্ত্রে সাহায্য-সহযোগিতা দেয় তৎকালীন মার্কিন সরকার। তাদের কলকাতার কনসাল জেনারেলের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে পাক সরকার বাংলার মীর জাফর নামে সমধিক পরিচিত এবং মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহম্মদ ও মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব এবং পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের একজন সাবেক কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম মাস্টারের সঙ্গে মিলিত হয়ে তথাকথিত পাকিস্তান কনফেডারেশন নামে একটা জগাখিচুড়ি প্রতিষ্ঠা করার নাম করে যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের ভেতরে অবস্থানরত কিছু মধ্যম স্তরের আওয়ামী লীগ নেতাদের হাত ধরে আলাদা একটা গ্রুপ করার প্রচেষ্টা নেয়, যাতে মুজিবনগর সরকারের মধ্যে কোন রকম একটা বিভক্তি সৃষ্টি করা এটাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব বলে তারা রাজনৈতিকভাবে এবং কূটনৈতিক চালে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে প্রচারণা চালিয়ে বিশ্বজনমত কিছুটা হলেও তাদের স্বপক্ষে নেয়ার প্রচেষ্টা চালাত। বিষয়টা পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে। তবে বাংলার মীর জাফর খন্দকার মোশতাকের এই জঘন্যতম দেশদ্রোহিতা এবং ষড়যন্ত্রের তথ্য যখন সবার কাছে জানাজানি হয়ে যায় তখন ভারত সরকার যেমন পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা বাঙালী সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করার পরই কেবল ভারতে অবস্থান করার সুযোগ দেয়া শুরু করল। একইভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও কঠোর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কেবল ভারতে অবস্থান করার অনুমতি দিত। এদিকে প্রতিরক্ষা সচিবের সভাপতিত্বে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমাদের সাপ্তাহিক প্রতিটি সভায়ও আমরা ষড়যন্ত্রকারীদের সম্ভাব্য আঘাত এবং প্রচেষ্টা বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলাপ আলোচনা করতাম। আমাদের আলোচনায় যাদের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়টি উঠে আসত তারা হলেন, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা সেনা কর্মকর্তা/সৈনিক ছাত্রলীগ/যুবলীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে আলাদাভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন বাহিনী। চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×