ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তারেক-কামাল ঐকমত্য

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

তারেক-কামাল ঐকমত্য

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে নয় বরং নেত্রীর মুক্তি, কথিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে পুরোপুুরি ব্যর্থ বিএনপি অস্তিত্ব রক্ষায় শেষ পর্যন্ত নিজেরাই নামসর্বস্ব জোটেই যোগ দিচ্ছে। ড. কামাল হোসেন ও একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বেই গড়ে ওঠা ঐক্য প্রক্রিয়াতেই এখন আশার আলো দেখছেন বিএনপির নেতারা। তৃণমূলের ব্যাপক আপত্তির পরও ড. কামাল ও বি. চৌধুরীর দ্বারে ধরনা দিচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। যাকে বিএনপির দেউলিয়াপনা রাজনীতির চেহারা হিসেবে অভিহিত করেছেন রাজনীতিবিদরা। নতুন প্রক্রিয়ায় ‘বিএনপির পায়ের তলায় মাটি পেতে পারে’ বলে আশা করছেন বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিবীজীরা। তবে দেশের সব সঙ্কটের সমাধানের ঘোষণা দিয়ে হঠাৎ ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে হাজির হওয়া ড. কামাল ‘বিশেষ কিছু’র আশায় এক মাসের মধ্যেই জামায়াতসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্বাধীনতাবিরোধী দল ইস্যুতে ইউটার্ন নিয়েছেন। বিএনপির সমর্থনে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার আশায় জামায়াতসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্বাধীনতাবিরোধী দল নিয়ে তাদের এখন আর আপত্তি দেখা যাচ্ছে না। তাদের আন্দোলনে যোগ দিতে বিএনপিকেও ছেড়ে আসতে হয়নি তাদের রাজনৈতিক মিত্র স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতকে। বরং শনিবার রাজধানীতেই সমাবেশেই স্বাধীনতাবিরোধী, উগ্রবাদী দল ও সংগঠন একাকার হয়ে গেছে। যেখানে এক-এগারোর কুশীলবদের নিয়ে সক্রিয় হয়েছে বিএনপিও। তথ্য মিলছে বিএনপি-ড. কামালের ৭ দফা গোপন চুক্তিরও। এক অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি ‘বড় কিছু’ পাওয়ার আশায় ড. কামাল স্বাধীনতাবিরোধী দল ও এক-এগারো কুশীলবদের নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন? বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়তে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন গত এক মাস আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিষয় দলটির ব্যক্তিগত যা জোটের বিষয়ে আসবে না। শর্ত হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছিল জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়েও। ড. কামাল শর্ত দিয়ে বলেছিলেন, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে বিএনপির। জামায়াতে ইসলামী থাকলে সেই জোটে থাকবেন না বলেও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন ড. কামাল। আরও বলেছিলেন, আমরা বিএনপিকে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছি, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোনভাবেই গণফোরাম জোট করবে না। ড. কামালের দ্বিতীয় শর্তে উল্লেখ করা হয়েছিল, বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জোটগতভাবে করা যাবে না। এ বিষয়ে জোট কিংবা ড. কামালকে কোনভাবেই জড়ানো যাবে না। তৃতীয় শর্তের বিষয়ে বলা হয়েছিল, জোটগতভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া যাবে না। এর সঙ্গে জোটের কোন সম্পর্ক থাকবে না। গণফোরামের পক্ষ থেকে বিএনপির তিন শীর্ষ নেতাকে সাত দফা লিখিতভাবে দেয়া হয়েছিল। তবে এক মাস না যেতেই দেখা যাচ্ছে ড. কামাল হোসেন বিএনপির নেতৃত্বে থাকা সব স্বাধীনতাবিরোধী দল ও সংগঠনকে দূরে ঠেলতে রাজি নন। শনিবারের সমাবেশে এসব বিষয়ে ড. কামাল ও তার জোটকেও কোন আপত্তি করতে দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত ‘জাতীয় ঐক্যে’ স্বাধীনতাবিরোধী, উগ্রবাদী দল একাকার ॥ ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গবর্নর আবদুল মোতালেব মালেকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্য মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বে খেলাফত মজলিশের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের উপস্থিত ছিলেন মঞ্চে। মঞ্চের প্রথম সারিতে ছিলেন আহমদ আবদুল কাদের। মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে দন্ডিত নেতার দলকে সঙ্গে নিয়েই হয়েছে ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশ। আর এই সমাবেশ থেকেই একসঙ্গে কর্মসূচীর ঘোষণা এসেছে। আবার স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি সম্পর্ক ত্যাগেরও ঘোষণা দেয়নি। ফলে ‘জাতীয় ঐক্যে’ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা দলটিও পরোক্ষভাবে থাকছে না, এটি বলারও সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে গ্রেফতারের পর ইসহাকের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। ১৯৭৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলার বাণী পত্রিকার একটি খবরের শিরোনাম ‘দালাল মন্ত্রী ইসহাকের যাবজ্জীবন কারাদ-’। ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর ইসহাক আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন আর কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দলে যোগ দেন। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ভেঙ্গে গেলে তিনি একটি অংশের প্রধান নেতা হন। খেলাফত মজলিশ নামে তার দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়। এখনও তিনি বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটে আছেন। ইসহাকের নেতৃত্বে দলের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরেই সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৮২ সালে সংগঠনের সভাপতিও হন। রাজনৈতিক দলের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা নিয়ে বি. চৌধুরীর বক্তব্যের সঙ্গে আবার তার কর্মকা-ের মিল নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। তার দল বিকল্পধারার একজনকে নিয়েও আছে অভিযোগ। সমাবেশে মঞ্চের সামনের সারিতে ছিলেন হেফাজতের ঢাকা মহানগরের আমির মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস। যার একটি রাজনৈতিক দলও আছে। উগ্রবাদী কর্মকা-ের দায়ে অভিযুক্ত এ দল আছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটেও। এই দলটির সঙ্গে আছে জামায়াতের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। এদিকে গণফোরাম নেতা ড. কামালে হোসেনের ডাকে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যোগ দিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান জোনায়েদ সাকী। এটা মেনে নিতে পারছেন না জোটের অন্যরা। আর জোটের প্রধান শরিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবিÑ এ বিষয়টি নিয়ে বৈঠক ডেকেছে। সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স সরাসরিই সাকির ভূমিকা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। সাকীর এই সমাবেশে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘সিপিবির কথা পরিষ্কার। বাম জোটকে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। নির্ভর করব জনগণের শক্তির ওপর। প্রিন্স বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আমরা একটা বাম গণতান্ত্রিক তৃতীয় শক্তির উত্থান চাই। আমরা সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা গতকাল জাতীয় ঐক্যে যাদের দেখলাম যেখানে জামায়াত নেতারাও ছিল। যেটা পত্র-পত্রিকায় এসেছে। বাম গণতান্ত্রিক জোট ‘জাতীয় ঐক্যের’ সঙ্গে নেই। জোটের শরিক গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐক্যের অনুষ্ঠানে। এ বিষয়ে জোটের পক্ষ থেকে আলোচনায় বসা হবে। সাকীর প্রতি বিরক্ত প্রিন্স আরও বলেন, বাম গণতান্ত্রিক জোটে আমরা যারা আছি। সবাইকে জোটের নীতি ও আদর্শ মেনে চলতে হবে। সিবিপি জোটের প্রধান। আমাদেরও জোটের সব নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে চলতে হবে। বিএনপি-ড. কামালের ৭ দফা গোপন চুক্তি ॥ ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বিএনপির একটি গোপন চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে এক সঙ্গে নির্বাচন করবে তারা। জানা গেছে, ড. কামাল হোসেনের জামাতা ডেভিড বার্গম্যানের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি হয়। এই চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর গতকাল বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে নেয়ার ঘোষণা দেয়। বিএনপির অধিকাংশ সিনিয়র নেতা, কারও নেতৃত্বে যাওয়ার বিরোধী ছিলেন। বরং তাদের অবস্থান ছিল যে, কোন ঐক্য করতে গেলে তার নেতৃত্ব বিএনপির হাতেই থাকতে হবে। এ নিয়ে ঐক্য প্রক্রিয়ায় অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছিল। তবে তারেকের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপির যোগদান নিশ্চিত হলো। সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবে। যেহেতু জামায়াত নিবন্ধিত নয়, তাই আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াত নেই। তবে জামায়াত জাতীয় ঐক্যের সব কর্মসূচীতে অংশ নেবে। ড. কামাল হোসেন এবং তারেক জিয়া দু’জনই একমত হয়েছেনÑ ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে যাবে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, ৭ দফা সমঝোতার ভিত্তিতে বিএনপি ড. কামাল হোসেন ঐক্য হয়েছে। এই ৭ দফা চুক্তির মূল বিষয়গুলো হলো এরকম : ১. ড. কামাল হোসেন হবেন ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রধান নেতা। ২. ঐক্য প্রক্রিয়ার স্বার্থে নির্বাচন পর্যন্ত সময়ে তারেক জিয়া নেপথ্যে থাকবেন। বিএনপির নেতৃত্ব দেবেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অথবা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৩. নির্বাচনে ১০০ থেকে ১২৫টি আসন বিএনপি তার শরিকদের ছেড়ে দেবে। এই ছেড়ে দেয়া আসনে অন্তত ১৫টি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দেয়া হবে। ৪. নির্বাচনে জয়ী হলে ড. কামাল হোসেন হবেন প্রধানমন্ত্রী। ৫. ড. কামাল হোসেনের সরকার স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবে, তার বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করবে, তারেক জিয়াকেও মুক্তভাবে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবে। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। ৬. নির্বাচনে জয়ী হলে বর্তমান সংবিধান সংশোধন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। ৭. দুই বছর পর ড. কামাল বিএনপির কাউকে প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়ে পদত্যাগ করবেন। জানা গেছে, এই গোপন চুক্তি আপাতত প্রকাশ করা হবে না। নির্বাচনে জয়ের পরই এই চুক্তি প্রকাশিত হতে পারে। তবে জাতীয় ঐক্যে ষড়যন্ত্র টের পাচ্ছে তৃণমূল বিএনপি। জাতীয় ঐক্যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। তারা বলছেন, জাতীয় ঐক্যের নামে একটি নীলনক্সা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যে আসা দলগুলোকে সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছে বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা। মূলত জিয়া পরিবারের রাজনীতির অধ্যায় বিলীন করতেই জাতীয় ঐক্যের নামে যড়ষন্ত্র করছে শীর্ষ নেতারা বলে মনে করছেন তারা। তৃণমূল বিএনপির নেতারা দলটির শীর্ষ পর্যায়ে বলেছে, এর মাধ্যমে জিয়া পরিবারের দুই সদস্য এবং বিএনপির প্রধান তারেক রহমান এবং খালেদা জিয়া ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কেননা, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের নেতৃত্বে বিএনপি স্থলে থাকছে ড. কামাল হোসেন অথবা অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ফলে সরকারও চলবে তাদের ইশারায়। বি. চৌধুরীর বাসায় গিয়ে ক্ষমা চাইলেন বিএনপি নেতারা ॥ বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় সংঘটিত কিছু ঘটনার জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির দুই নেতা এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শুক্রবার বি. চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে বৈঠককালে এই দুঃখ প্রকাশ করেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। নির্বাচন সামনে রেখে ‘যুক্তফ্রন্ট’ ও ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার’ সমাবেশের আগের দিন শুক্রবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে বি. চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে সোয়া এক ঘণ্টা বৈঠক করলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তিন বিএনপি নেতা। চারদলীয় জোট সরকারের সময় চাপের মুখে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করে বিএনপি। শুধু তাই নয়, ওই সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের অপদস্থ করা হয়; যা নিয়ে এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষুব্ধ ছিলেন বি. চৌধুরী। বি. চৌধুরী ও তার পরিবারের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য ভেতরে ভেতরে নিষ্পত্তির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় বিএনপি। কিন্তু দলটির পক্ষ থেকে এই প্রথমবারের মতো সিনিয়র তিন নেতা গিয়ে এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বললেন। বিএনপির দেউলিয়াপনা রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ ॥ আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির নেতারা কামাল হোসেন ও একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে আন্দোলনে আশা দেখছেন। এজন্য নামসর্বস্ব দলের নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন বিএনপি নেতারা। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদকে দেখা যায়নি। জানা গেছে, তিনি ভারত সফরে আছেন। তবে শুরু থেকেই এই জোটের বিরোধিতা করে আসছেন তিনি। এ কারণেই ২০ দলের অনেক নেতাকে এই সমাবেশে যোগ দিতে দেখা গেলেও দেখা যায়নি অলির দলের কোন নেতাকে। ঐক্যের নেতাদের দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপিকে অলি আহমেদ আগেই বলে গিয়েছেন, জনসমর্থনহীন, জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে এগিয়ে গেলে কোন কাজ হবে না। বিএনপিকে আরও কৌশলী হতে হবে। যাদের সাপোর্টার নাই তাদের নিয়ে ঐক্য করে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে নিজেদের সংগঠন শক্তিশালী করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি এখন দেউলিয়া দল। দেশের মানুষ তাদের বর্জন করেছে। তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ধানের শীষ এখন পেটের বিষ। এখন বিএনপি মহাসমাবেশের ডাক দিলেও সামবেশে লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ আওয়ামী লীগের সমাবেশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, নির্বাচনের সময় এলেই ওয়ান ইলেভেনের কুশীলব এবং তাদের দোসররা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এবারও তারা নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট করার নামে চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। জোট করেন, অসুবিধা নেই, কিন্তু সাবধান ষড়যন্ত্র করবেন না। ষড়যন্ত্র করলে এক বিন্দু ছাড় দেয়া হবে না। মাঠে-ময়দানে প্রতিহত করা হবে। যতই ষড়যন্ত্র করেন, নির্বাচন যথাসময়ে সংবিধান অনুযায়ী হবে। এর বাইরে চিন্তার কোনো সুযোগ নেই। কামাল হোসেনের ঐক্যকে ষড়যন্ত্রের ঐক্য বলে মন্তব্য করেছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যের মূলশক্তি থাকবে বিএনপি ও জামায়াত। ড. কামাল ও বদরুদ্দোজা চৌধুরী থাকবেন শুধু সাক্ষী গোপাল। এই ঐক্য কোন ফল দেবে না। আন্দোলন দূরে থাক, তারা একত্রে কোন কাজই করতে পারবেন না। ড. কামাল হোসেনের মতো জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনটি এখন জগাখিচুড়ি অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। আন্দোলন তো দূরের কথা, এই ঐক্য আসলে তাদের মধ্যে কোন ঐক্যই আনতে পারবে না। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের কাছে তাদের ষড়যন্ত্রের ঐক্য ধুয়ে বিলীন হয়ে যাবে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ড. কামাল হোসেন আসলে বিএনপি-জামায়াত রক্ষার কাজে নেমেছেন। রাজাকার বাঁচানোর কাজে তিনি বিএনপি-জামায়াতের নামকরা উকিল। এক সময় ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন- তিনি বিএনপি সমিতির রাজাকার উকিল হবেন না। অবশেষে নামকরা উকিলের মক্কেল হলো বিএনপি-জামায়াত। বিএনপি ও ড. কামাল হোসেনের দাবি এক এবং অভিন্ন। তাদের লক্ষ্য খালেদা উদ্ধার এবং বিএনপি-জামায়াত ও জঙ্গীকে রক্ষা করা। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোগ ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক কর্মকা-ের সমালোচনা করে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ড. কামালের কথা-কাজের মিল নেই। তার ভূমিকা সবসময় রহস্যজনক। তিনি আসলে পাকিস্তানেরই লোক। মন্ত্রী বলেন, বেশ কিছুদিন আগে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে তিনি যাবেন না। এখন দেখা যাচ্ছে, বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে ঐক্য করেছেন তিনি। বিএনপি তো জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেয়নি। ড. কামাল হোসেন জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। বাংলাদেশের জন্য ড. কামাল হোসেনের কোন দরদ নেই। তার ভূমিকা দেখে আমিসহ স্বাধীনতার স্বপক্ষের সকল শক্তি বিস্মিত হয়েছি। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে চলছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সঙ্গে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির লড়াই। রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে বিএনপি এখন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ধরনা দিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক। তিনি বলেন, জনগণের ওপর আস্থা হারিয়ে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পরেছে বিএনপি। বিএনপির মতো একটি দেউলিয়া দল আরেক দেউলিয়া ড. কামালের কাছে আত্মসমর্পণ করে বাঁচতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, দেউলিয়াদের ঐক্য জাতীয় ঐক্য হতে পারে না। এটি মূলত ষড়যন্ত্রের ঐক্য। কিন্তু বিএনপির এমন অবস্থার কারণ কি? এর মধ্য দিয়ে তাহলে কি অর্জন করবেন বিএনপি? বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী মনে করেন, ঐক্যেও ভবিষ্যত পরিষ্কার না হলেও এটি বিএনপি জন্য কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করতে পারে। ঐক্যজোটের যারা নেতা আছেন, তারা জনগণের কাছে খুব পরিচিত। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে তারা কতটুকু ভোটার টানতে পারবেন তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে এ রাজনৈতিক ঐক্য হলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ‘পায়ের তলায় মাটি পাবে’ বলে উল্লেখ করেন দিলারা চৌধুরী। তার ধারণা একদিকে মাঠ পর্যায়ে বিএনপির সমর্থন এবং নেতাকর্মী আছে, অন্যদিকে ড. কামাল হোসেন এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পরিচিতি আছে। এ দুটো বিষয় একত্রিত হলে বিএনপির জন্য রাজনৈতিক সুবিধা হবে বলেই মনে করেন দিলারা চৌধুরী।
×