ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলার বাঘিনীরা অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ॥ বাংলাদেশের দুর্দান্ত নৈপুণ্যে শেষ ম্যাচে উড়ে গেল ভিয়েতনামও

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাংলার বাঘিনীরা অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ॥ বাংলাদেশের দুর্দান্ত নৈপুণ্যে শেষ ম্যাচে উড়ে গেল ভিয়েতনামও

রুমেল খান ॥ সব শঙ্কা, সব ষড়যন্ত্র, সব প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে বিজয়ী হওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। সেই কাজটিই সূচারুভাবে করে দেখালো বাংলার বাঘিনীরা। রবিবার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখলো তারা। ঢাকার কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘অঘোষিত’ ফাইনালে দাপুটে জয় কুড়িয়ে নেয় বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৬ জাতীয় নারী ফুটবল দল। ২-০ গোলে হারিয়ে দেয় প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ভিয়েতনামকে। গোল স্কোরার আঁখি খাতুন এবং তহুরা খাতুন। খেলার প্রথমার্ধে বিজয়ী দল এগিয়ে ছিল ১-০ গোলে। এই জয়ে এএফসি অনুর্থ-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের ‘এফ’ গ্রুপে অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলো গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যারা। সেই সঙ্গে এই আসরের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো তারা। এই পর্বের খেলা ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। রবিবার সকালে অন্য ম্যাচে আরব আমিরাত ১-০ গোলে হারায় বাহরাইনকে। এই গ্রুপে স্বাগতিক বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গোল (২৭) করার পাশাপাশি একমাত্র দল হিসেবে একটি গোলও হজম করেনি। জয়টা কাক্সিক্ষই ছিল। কিন্তু খলনায়িকা রেফারির কারণে সেই জয় পেতে অনেক সংগ্রাম, অনেক টেনশন করতে হয়েছে। বাংলাদেশ রবিবারের খেলায় জিতলেও ম্যাচের অস্ট্রেলিয়ান রেফারি ক্যাথেরিন জ্যাসউইচের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বমূলক রেফারিং ছিল চোখে পড়ার মতো। অন্যায়ভাবে তিনি বাংলাদেশের তিনটি গোল বাতিল করে দেন। নইলে আরও বড় ব্যবধানে জিততে পারতো বেঙ্গল টাইগ্রেস দল। তাদের চমৎকার নয়নাভিরাম খেলা দেখে গাঁটের পয়সা উসুল হয়েছে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আসা হাজার পাঁচেক দর্শকের। এই জয়ে ‘এফ’ গ্রুপে ৪ ম্যাচে সর্বোচ্চ ১২ পয়েন্ট বাংলাদেশের। সমান ম্যাচে রানার্সআপ ভিয়েতনামের পয়েন্ট ৯। এর আগে বাংলাদেশ হারায় বাহরাইনকে ১০-০, লেবাননকে ৮-০ এবং আরব আমিরাতকে ৭-০ গোলে। আর ভিয়েতনাম হারায় আমিরাতকে ৪-০, বাহরাইনকে ১৪-০ এবং লেবাননকে ৭-০ গোলে। তিন ম্যাচে খেলে বাংলাদেশ-ভিয়েতনামের গোল (২৫) এবং পয়েন্ট (৯) সমান ছিল। ফলে সৃষ্টি হয় এক সমীকরণের। বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম ম্যাচটি যদি ড্র হতো তাহলে সরাসরি টাইব্রেকার অনুষ্ঠিত হতো (কোন অতিরিক্ত সময় খেলা হতো না)। সেক্ষেত্রে বাইলজ অনুযায়ী কিন্তু ম্যাচের অফিসিয়াল ফল ‘ড্র’ই লেখা থাকতো। যে দলই হারুক না কেন, তারা প্রত্যেকেই ১ পয়েন্ট করে লাভ করতো। টাইব্রেকারের আশ্রয় নেয়া হতো গ্রুপের শীর্ষ দল নির্ধারণ করার জন্য। বাংলাদেশ দল যদি টাইব্রেকারে হেরেও যেত তাহলেও তাদের পরের পর্বে যাওয়ার সুযোগ বেঁচে থাকতো। সেটা বেস্ট দুই রানার্সআপ দলের একটি হিসেবে। সেক্ষেত্রে অন্য পাঁচ গ্রুপের খেলা শেষ হওয়া এবং গ্রুপগুলোর পয়েন্ট টেবিলের চূড়ান্ত অবস্থার ওপর নির্ভর করতে হতো তাদের। উল্লেখ্য, এএফসি অনুর্ধ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে মোট ছয়টি গ্রুপ আছে। প্রতি গ্রুপে ৫টি করে মোট ৩০ দেশ খেলবে। ছয় গ্রুপের ছয় চ্যাম্পিয়ন এবং সেরা দুই রানার্সআপ দল মোট আটটি দল খেলবে দ্বিতীয় রাউন্ডে। এই আট দল থেকে সেরা চার দল খেলবে তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্বে। এই পর্বে যোগ্যতা অর্জন করা চার দলের সঙ্গে সরাসরি খেলবে আগেই যোগ্যতা অর্জন করা আরও চার দেশÑ স্বাগতিক থাইল্যান্ড, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান। এই আসরে (এএফসি অনুর্ধ-১৬ মহিলা আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইপর্ব, সাউথ এ্যান্ড সেন্ট্রাল) নিজেদের মাঠে ২০১৬ সালেও বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তারপর এই আসরের মূলপর্বে (২০১৭ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত) অংশ নেয়। মূলপর্বে অংশ নিয়েছিল আট দল। বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে খেলেছিল বাংলাদেশ। ডাগআউটে কোচ ছোটন। গ্যালারিতে তখন হাজারও ছোটন। দর্শকরাই যেন কোচের ভূমিকায়! ‘এগিয়ে যাও,’ ‘সাবাশ! মারিয়া’ ‘গোল কর’ বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসার টানেই এমন আবেগে আপ্লুত কমলাপুর স্টেডিয়ামের হাজার পাঁচেক দর্শক। ম্যাচের শুরু থেকে মারিয়া-ঋতুপর্ণাদের বোতলবন্দী করে রাখতে চেষ্টার কমতি রাখেনি ভিয়েতনামের মেয়েরা। তারপরও নিজেদের মেলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে ছোটন-শিষ্যারা। পুরো ম্যাচে বাংলাদেশের প্রাধান্যই ছিল লক্ষ্যণীয়। বল নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে ছিল তারাই (৭৫%-২৫%)। ৩৭ মিনিটে ডানপ্রান্ত থেকে বল নিয়ে ঢুকে পড়ে ডান পায়ের জোরালো শটে ভিয়েতনামের জালে পাঠায় শামসুন্নাহার জুনিয়র। ডাগআউটে তখন ছোটন পল স্মলিকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে মেতেছেন। গ্যালারিতেও উল্লাস। কিন্তু গোল হবার বেশ কিছুক্ষণ পর লাইন্সম্যানের সঙ্গে কথা বলে অফসাইড দেখিয়ে গোলটি বাতিল করেন রেফারি ক্যাথেরিন। কোচের সঙ্গে হতবাক গ্যালারির দর্শকরাও। প্রথমার্ধের ইনজুরি টাইমে (৪৫+১ মিনিট) অবশেষে ‘বৈধ’ গোলের দেখা পায় স্বাগতিক দল। বাংলাদেশের একটি আক্রমণ থেকে ভিয়েতনামী গোলরক্ষক দাও থির হাত থেকে বল ফস্কে গেলে নিচু ও ড্রপ হেডে বল জালে ঠেলে দেয় তহুরা (১-০)। এবারও গোল হবার পর বেশ ‘আগ্রহ’ নিয়ে গোল বাতিল করতে লাইন্সম্যানের সঙ্গে কথা বলতে যান ক্যাথেরিন। এবার গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ে তুমুল উত্তেজনা। ক্ষেপে গিয়ে প্রতিবাদ করেন দর্শকরা। শেষ পর্যন্ত একরকম বাধ্য হয়েই গোলের সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য হন রেফারি। ৫৯ মিনিটে আরেকবার ‘সফল’ হন রেফারি। তহুরার বাঁ পায়ের শট পোস্টে জড়ালেও আবারও অফসাইডের খোঁড়া অজুহাতে বাঁশি বাজিয়ে গোল বাতিল করেন তিনি। ৬৪ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করে বাংলাদেশ। কর্নার থেকে বল পেয়ে শামসুন্নাহারের (জুনিয়র) শট ডান পোস্টে লেগে ফেরত আসে। ফিরতি বলে আঁখির শট ফিরিয়ে দেয় গোলরক্ষক। এবার দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় গোলরক্ষককে পরাস্ত করতে সক্ষম হয় এই দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডার (২-০)। খেলা শেষ হবার মিনিট পাঁচেক আগে তহুরার আরেকটি গোল অফসাইডের অজুহাতে আবার বাতিল করেন রেফারি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশের মেয়েরা।
×