ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিনাজপুরে সিধু-কানু স্মারক ভাস্কর্য

বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্য বিদ্রোহ বিপ্লবের প্রতিমূর্তি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্য বিদ্রোহ বিপ্লবের প্রতিমূর্তি

মোরসালিন মিজান ॥ এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম। নানাবিধ শোষণ বঞ্চনা তারা যেমন সহ্য করেছে, তেমনি আছে রুখে দাঁড়ানোর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে, দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পিছপা হয়নি কখনও। বুকের রক্ত দিয়ে বিপ্লব বিদ্রোহকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়কদের একজন সিধু মুরমু। অন্যজন কানু মুরমু। দুই সহোদর। ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের মহানায়ক ছিলেন তারা। ছিলেন অসীম সাহসী যোদ্ধা। ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে স্বদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সামান্য তীর ধনুক হাতে ব্রিটিশ ও তাদের দোসরদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ওটাই ছিল প্রথম সংগঠিত কোন প্রতিবাদ। ইতিহাসটি থেকে এখনও সকলে বিস্মৃত হননি। তবে আজকের প্রজন্মের অনেকেই অজ্ঞাত। উদাসীন। এ অবস্থায় নতুন খবর এই যে, সিধু কানুর বীরগাঁথা তুলে ধরতে দিনাজপুরের সড়কদ্বীপে সুউচ্চ ভাস্কর্য গড়া হয়েছে। কাহারোল উপজেলায় তিন রাস্তার মোড়ে নির্মিত ভাস্কর্য গত শনিবার উদ্বোধন করা হয়। যতদূর তথ্য- স্থানীয় সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম চৌধুরীর উদ্যোগ। উদ্যোগের ফলে বহুকাল পর চমৎকারভাবে সামনে এসেছে সাঁওতাল বিদ্রোহ ও কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস। অবশ্য এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলেও, নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল আরও আগে। গত শীতে কান্তজী মন্দির ঘুরে নিলফামারী শহরে ফেরার সময় ভাস্কর্যটি প্রথম এই প্রতিবেদকের চোখে পড়ে। উঁচু বেদির ওপর তীর ধনুক হাতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন সিধু ও কানু। দু’জনরেই পেটানো উদোম শরীর। রোদে পোড়া বৃষ্টিতে ভেজা গড়ন। আদিম চেহারা আর মালকোঁচা দেয়া লুঙ্গি। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক ব্যঞ্জনা তৈরি করে। ফিগারগুলোর পেছনে বিশাল খোলা আকাশ। আকাশের নীলটাকে মনে হচ্ছিল ক্যানভাস। ক্যানভাসে যতœ করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গণসংগ্রামের ইতিহাস। ফাইবার মাধ্যমে গড়া মূল ফিগারের ভেতরের অংশ ফাঁকা হলেও, বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না। নিচের অংশে আবার সিমেন্টের ঢালাই। ভিতটা তাই বেশ মজবুত হয়েছে। একইসঙ্গে সিধু কানুর আপসহীন দৃঢ় চেতনার প্রকাশ ঘটে স্মারক ভাস্কর্যে। ফিগার দুটির উচ্চতা সাড়ে ১৩ ফিট। বেদিসহ উচ্চতা আরও বেড়ে হয়েছে ৩০ ফিট। তাই অনেক দূর থেকে অনায়াসে দেখা যায়। আগে যারা অনন্য সুন্দর প্রতœসম্পদ কান্তজী মন্দির দেখতে গিয়েছেন, তাদের কথা আলাদা। এখন যারা যাবেন, পথিমধ্যে দেখা হয়ে যাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের মহা নায়কদের সঙ্গে। মূল ভাস্কর্যের নিচে বেদি ঘিরে আবার ম্যুরালের কাজ করা হয়েছে। গোলাকার দণ্ডের চারপাশে দৃশ্যমান করা হয়েছে কৃষক আন্দোলনের নেত্রী সংগ্রামী ইলা মিত্র, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, গুরুদাস তালুকদার প্রমুখের প্রতিকৃতি। এভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও, কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসটি চমৎকার তুলে ধরা হয়েছে। ভাস্কর্য গড়া ও ম্যুরাল প্রতিকৃতি তৈরির কাজ করেছেন শিল্পী প্রদ্যোত কুমার। সহ-শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষ। দু’জন ঢাকায় বসেই মূল কাজ করেন। পরে ফিগারগুলো বহন করে দিনাজপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্থাপনও করা হয় প্রায় বছর খানেক আগে। এর পর থেকেই কৌত‚হলী দৃষ্টি। আবেগঘন ফিরে দেখা। সংলগ্ন সেতুটিতে ওঠার সময়, সেতু থেকে নামার সময় অনেক পর্যটকই গাড়ি থামাচ্ছিলেন। ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। এভাবে লম্বা সময় পার হওয়ার পর ভাস্কর্যের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। এ উপলক্ষে সেখানে বিশেষ অনুষ্ঠানমালারও আয়োজন করা হয়। আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাঁওতালদের কৃষ্টি ও জীবন সংগ্রামের নানা দিক তুলে ধরেন আয়োজকরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভাস্কর প্রদ্যোত কুমারও। রবিবার কর্মস্থল ঢাকায় ফিরেছেন তিনি। কী অভিজ্ঞতা? জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, কোন শিল্পীর জন্য এর চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না। প্রায় দুই বছর আগে ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন থেকেই কাজটি কেমন হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করছিলাম। আমরা কাজ করি প্রায় এক বছর ধরে। সিধু কানুর মতো মহানায়কদের ভাস্কর্য বলেই নিজের ভেতরে আলাদা একটা দায় বোধ করেছি। সেই দায় থেকে যতটা সম্ভব তাদের মূর্ত করার চেষ্টা করেছি। সিধু কানু এখানে প্রতীকী। এর মধ্য দিয়ে সাঁওতাল বিদ্রোহ তথা এ অঞ্চলের মানুষের গণসংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। রিয়ালিস্টিক কাজের দিকে এমনিতেও ইতিহাসটির কথা মনে পড়ে যায়। সাঁওতাল বিদ্রোহের ঘটনবালী স্মরণ করিয়ে দেয় সিধু কানু স্মারক ভাস্কর্য। কে না জানে, আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতালরা অপেক্ষাকৃত নিরীহ। অল্পে সন্তুষ্ট। কিন্তু এ কারণেই হয়ত ব্রিটিশ সা¤্রজ্যবাদী গোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের বিশেষ টার্গেটে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশদের ইন্দনে স্থানীয় জমিদার, জোতদার, মহাজনেরা তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ক্রমে শোষণ বঞ্চনা নারীর প্রতি অবমানা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। পরিস্থিতিই দুর্বল ভীরু সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ করে। রুখে দাঁড়ানোর নতুন ইতিহাস গড়ে তারা। ১৭৮০ সালে সাঁওতাল নেতা তিলকা মুরমুর নেতৃত্বে সূচনা হয়েছিল গণসংগ্রামের। ১৭৮৫ সালে তিলকা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়লে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু বিদ্রোহ দমানো যায়নি। ১৮১১ সালে বিভিন্ন নেতাদের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের দানা বাধে গণআন্দোলন। এর পর ১৮২০ সালে তৃতীয় বারের মতো সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ হয়। সংগ্রাম গড়ে তুলে। ১৮৩১ সালে চতুর্থবারের মতো শুরু হয় সংগ্রাম। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সামনে আসেন সিধু ও কানু। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সাঁওতালদের নিয়ে তারা বিরাট সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে অংশ নেয় ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ। পরে তাদের নিয়ে কলকাতা অভিমুখে গণযাত্রা বের করেন বীর সিধু কানু। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে ওটাই ছিল এ ধরনের প্রথম গণযাত্রা। সেই আদলেই এখন লংমার্চ ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। পদযাত্রা থেকে সিধু ও কানুকে গ্রেফতারেরও জোর চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ সাঁওতালরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে শত্রæ পক্ষের ১৯ জনকে খতম করে তারা। এরপর টানা আট মাস ধরে চলে সাঁওতাল বিদ্রোহ। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ফেব্রæয়ারির প্রথম সপ্তাহে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইরত অবস্থায় শহীদ হন সিধু মুরমু। দ্বিতীয় সপ্তাহে ফাঁসি দেয়া হয় কানু মুরমুকে। আহারে জীবন! অপসহীন সংগ্রাম। দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে আলোকজ্জ্বল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। আজ তারা নেই। তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাসটি ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে স্মারক ভাস্কর্য।
×