ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফার্মাসিস্টরাই আপনার ওষুধ বিশেষজ্ঞ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ফার্মাসিস্টরাই আপনার ওষুধ বিশেষজ্ঞ

গতকাল বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘ওয়ার্ল্ড ফার্মাসিস্ট দিবস’ পালিত হয়েছে। এবার এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘ফার্মাসিস্টই আপনার ওষুধ বিশেষজ্ঞ’ (Pharmacists : your medicines experts)। গত বছরের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘ফার্মাসিস্টরা আপনার সেবায় নিয়োজিত (From research to health care: your phamacist is at your service)। আমরা খুব ভাল করেই জানি, উন্নততর জীবনের জন্য, সমৃদ্ধ জাতির জন্য চাই সুস্থ ও সাবলীল মানুষ, চাই চেতনা ¯িœগ্ধ আলোকিত ঋদ্ধ মানুষ। একটি সুন্দর সাবলীল জীবনের জন্য সুস্থ থাকা অনিবার্য। জীবনের অনন্ত চাহিদার মাঝে সুস্থতাই প্রথম চাওয়া। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। স্বাস্থ্যসেবাকে রাষ্ট্রের অন্যতম করণীয় হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রকৃত জননায়ক হিসেবে মানুষের এই আকাক্সক্ষাটি বাংলাদেশের সংবিধানে রূপদান করেছিলেন। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) অনুসারে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব এবং অনুচ্ছেদ ১৮(১) অনুসারে জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বর্তমানে দেশে জনগণ সরকারী ও বেসরকারী খাতে যে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে তা পরিসর ও গুণগত মানের দিক থেকে আরও উন্নীত করা প্রয়োজন। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১-এর মূলমন্ত্র ছিল ‘সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও জরুরী চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফার্মেসি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ফার্মেসিকে একটি পেশাগত বিষয় এবং ফার্মাসিস্টদের পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তার ও নার্সের ভূমিকা যেমন অপরিসীম ঠিক তেমনিভাবে ওষুধের সংরক্ষণ, গুণগতমান, সঠিক ওষুধ নির্বাচন ও ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্য স্বাস্থ্য সেবায় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের ভূমিকাও অপরিহার্য। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা নিজেদের পেশাগত দক্ষতা দিয়ে ওষুধ শিল্পে (উৎপাদন, মাননিয়ন্ত্রণ, মানের নিশ্চয়তা বিধান, গবেষণা ও উন্নয়ন, বিপণন, উৎপাদন পরিকল্পনা, ডিসপেন্সিং, রেগুলেটরি এফেয়ারস, বিজনেজ ডেভেলপমেন্ট ও রফতানি), সরকারী সংস্থায়, বেসরকারী হাসপাতালে, কমিউনিটি ফার্মেসিতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ওষুধ শিল্পের বিকাশে এক আমূল পরিবর্তন। বর্তমানে দেশের চাহিদার ৯৮% ওষুধ দেশে উৎপাদন হচ্ছে এবং ১৮২টি দেশে ওষুধ রফতানি হচ্ছে। এখন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা দেশের অনেক বড় ওষুধ কোম্পানিগুলোতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ওষুধের অপব্যবহার রোধ ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য দেশে মডেল ফার্মেসি চালু করা হয়েছে। মডেল ফার্মেসিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কর্তৃক ওষুধ সংরক্ষণ, ডিসপেন্স এবং ওষুধ সম্পর্কে তথ্যাদি দেয়ার পাশাপাশি ওষুধ সেবনবিধি সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করে যাচ্ছে। বর্তমানে ২০০টির অধিক মডেল ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে, তাদের কর্মপরিবেশ ও দায়িত্ব পালনের জন্য ‘ফার্মেসি ইনচার্জ/ফার্মেসি ম্যানেজার’ হিসেবে পদায়নের জন্য ফার্মেসি কাউন্সিল উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এছাড়া এদেশের কিছু সংখ্যক বেসরকারী হাসপাতালে ইতোমধ্যে উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা তথা ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে আসছে। আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ ব্যতীত গুণগত স্বাস্থ্যসেবা দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। আমাদের দেশে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ছাড়াই ওষুধ সংরক্ষণ, ডিসপেন্সিং ও ওষুধ বিতরণ করা হয়ে থাকে। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট হাসপাতালে নিযুক্ত হলে এদেশের হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও তাদের পদোন্নতির সুযোগ করে স্বাস্থ্যসেবাকে আরও উন্নতকরণের বিষয়টি এখন সময়ের দাবি। ২০০৭ সালের তথ্য অনুসারে দেশে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের সংখ্যা ছিল ২৭৬০ যা বর্তমানে ১৩৪০০। বর্তমানে ১২টি সরকারী ও ২৭টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর গড়ে ৪০০০ জন ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল থেকে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট হিসেবে রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছে। তবে, দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে না। আমরা জানি, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ এর ২৪নং অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্যবিষয়ক মানব সম্পদ থেকে জ্ঞান ও দক্ষতার সর্বোচ্চ সুফল অর্জনের লক্ষ্যে সর্বস্তরের জন্য একটি সঠিক ও চাহিদাভিত্তিক মানব সম্পদ উন্নয়ন পদ্ধতি গড়ে তোলা এবং চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থ্য জনশক্তির সকল স্তরে নিয়োগ, পদোন্নতি পদায়ন ও বদলির নীতিমালা বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬ এর ৪.৩ অনুচ্ছেদে ওষুধের যৌক্তিক ও নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ৪.৩ অনুচ্ছেদের ‘ঙ’ উপ-অনুচ্ছেদে দেশে পর্যায়ক্রমে সকল সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগে ‘হসপিটাল ফার্মেসি (Hospital Pharmacy) কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের হসপিটালে কর্মরত ফার্মাসিস্টদের তুলনামূলক বিবরণী : মালয়েশিয়া: ফার্মাসিস্ট ও জনসংখ্যার অনুপাতিক হার = ১:২৩১৫ সিঙ্গাপুর: ফার্মাসিস্ট ও জনসংখ্যার আনুপাতিক হার = ১:২১৩০ ইংল্যান্ড: ফার্মাসিস্ট ও জনসংখ্যার আনুপাতিক হার = ১:১০০০ থাইল্যান্ড: ২০ শয্যার বিপরীতে ২ জন ফার্মাসিস্ট, ৩০ শয্যার বিপরীতে ৩ জন ফার্মাসিস্ট, ৬০ শয্যার বিপরীতে ৩ জন ফার্মাসিস্ট, ৯০-১২০ শয্যার বিপরীতে ৫ জন ফার্মাসিস্ট। এমতাবস্থায়, দেশে সরকারী হাসপাতালগুলোতে (জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) ওষুধের নিরাপদ সংরক্ষণ, ওষুধের অপব্যবহার রোধ ও যৌক্তিক ব্যবহারে ফার্মাসিস্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রান্তিক পর্যায়ে ওষুধ বিপণন ও ডিস্পেন্সিং ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনয়নের লক্ষ্যে সরকারী হাসপাতালগুলোতে উন্নততর বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বহির্বিভাগ ফার্মেসিতে ১ (এক) জন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ও আন্তঃবিভাগে প্রতি ৫০ (পঞ্চাশ) শয্যার বিপরীতে ১ (এক) জন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগদান এবং নিয়োগকৃত ফার্মাসিস্টদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে জনশক্তির সকল স্তরে পদোন্নতির লক্ষ্যে হসপিটাল ফার্মেসিতে নিম্নলিখিত পদবিন্যাস করা যেতে পারে : হসপিটাল ফার্মেসিতে (Hospital Pharmacy) প্রস্তাবিত ফার্মাসিস্ট নিয়োগের পদবিন্যাস : উল্লিখিত পদসমূহের কার্যপরিধি সংযুক্ত করা হলো (কপি সংযুক্ত)। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও নার্স এই ০৩ (তিন) শ্রেণীর পেশাজীবী রয়েছে। ডাক্তারদের জন্য স্বাস্থ্য এবং নার্সদের জন্য নার্সিং ও মিডওয়াইফারি পৃথক ০২ (দুই)টি অধিদফতর রয়েছে। এই অধিদফতর দুটির মাধ্যমে নিয়োগকৃত ডাক্তার ও নার্সদের সার্ভিস সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকল পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, মূল্যায়নসহ যাবতীয় প্রশাসনিক, আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হয়। এমতাবস্থায়, প্রস্তাবিত পদবিন্যাসের আলোকে হাসপাতালগুলোতে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগ ও কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের ন্যায় ফার্মেসি সার্ভিসেস পরিদফতর/অধিদফতর গঠন করে জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার এখনই উৎকৃষ্ট সময়। কেননা বাংলাদেশে এখন ১২,৭৩৭ জন রেজিস্ট্রাট গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট রয়েছে (এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশে কর্মরত) ৫,৭০০ জন ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট এবং ৫৫,০০০ সি প্রেড ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। এই দক্ষ জনগোষ্ঠীকে দেশের কাজে লাগাতে হলে রেজিস্ট্রাট ফার্মাসিস্টদের বেশি বেশি করে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে সরকারী কাঠামোতে নিয়োগ দেয়া খুবই জরুরী। গ্রীক চিকিৎসক গেলেনকে বলা হয় ‘ফাদার অফ ফার্মাসিস্ট’, তিনি সেই সময়ই বুঝতে পেরেছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে ফার্মাসিস্ট কতটা জরুরী। লেখক : এম মোসাদ্দেক হোসেন, সহসভাপতি, ফার্মেসি কাউন্সিল এবং সুভাষ সিংহ রায়, সাবেক সহসভাপতি, ফার্মেসি কাউন্সিল
×