ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

সাফল্যের সোনারোদে মারিয়া-আঁখিরা

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সাফল্যের সোনারোদে মারিয়া-আঁখিরা

স্বর্ণসাফল্য বললেও কম বলা হবে। বাংলাদেশের কিশোরীরা রূপকথার সাফল্য দেখিয়ে চলেছে। ধারাবাহিক সাফল্যের অংশ হিসেবে এবারও এএফসি অনুর্ধ-১৬ মহিলা বাছাই ফুটবলে নিজেদের গ্রুপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দল হিসেবে এই টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় পর্বে উঠেছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা বিদায় নিয়েছে প্রথম পর্ব থেকেই। অসাধারণ সাফল্য পাওয়া বাংলার মেয়েদের এবারের মিশন দ্বিতীয় রাউন্ডের বাধা পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্ব নিশ্চিত করা। বাছাই পর্বের ২৯ দেশের মধ্যে সেরা আটে এখন বাংলাদেশ। প্রথম পর্ব টপকে যাওয়া বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, লাওস, চীন, ইরান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন্সকে নিয়ে হবে দ্বিতীয় রাউন্ডের লড়াই। দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলার পর চার দল উঠবে চূড়ান্ত পর্বে। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা কোথায় হবে এখনও ঠিক হয়নি। তবে খেলার সময় নির্ধারণ হয়ে আছে আগামী বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ। দ্বিতীয় পর্বের সেরা চারের সঙ্গে চূড়ান্ত পর্বে সরাসরি খেলবে উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও থাইল্যান্ড। এর মধ্যে প্রথম তিন দল গত আসরের চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ ও তৃতীয়। থাইল্যান্ড চূড়ান্ত পর্বের আয়োজক। এই আসরে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে সাফল্য পাচ্ছে। গত আসরেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিল। তবে এবার চূড়ান্ত পর্বের উঠতে পার হতে হবে আরেক ধাপ। বাংলাদেশের মেয়েরা থাইল্যান্ডে চোখ রেখেই শুরু করবে দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রস্তুতি। ৬ গ্রুপের মধ্যে মধ্যে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও চীন পূর্ণ ১২ নিয়ে প্রথম পর্ব টপকে দ্বিতীয় পর্বে উঠেছে। ৪ ম্যাচে বাংলাদেশ করেছে ২৭ গোল। কোন গোল হজম করেনি। প্রথম পর্বে গোল হজম না করা অন্য চার দল চীন, ইরান, থাইল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ করার পর এবার মারিয়া, আঁখি, তহুরাদের লক্ষ্য দ্বিতীয় রাউন্ড। বাংলাদেশ দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনও এই আশা করছেন। তিনি বলেন, মেয়েরা দীর্ঘদিন কঠোর পরিশ্রম করে এই ফল পেয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ম্যাচ বাই ম্যাচ জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া। মেয়েরা নিজেদের মতো করে খেলেই এ সাফল্য এনেছে। এখন আমাদের লক্ষ্য থাইল্যান্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা। আমাদের ভুটানে অনুর্ধ-১৮ সাফ আছে। আমরা এই টুর্নামেন্ট শেষে ৮ অক্টোবর থেকে এএফসি অনুর্ধ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রস্তুতি শুরু করব। জয় সব সময়ই মধুর। আর সেই জয়ের সঙ্গে যদি মিলে যায় শিরোপাপ্রাপ্তিও, তা হলে তো সোনায় সোহাগা। সেক্ষেত্রে চিত্তসুখটা নিঃসন্দেহে হবে দ্বিগুণ। এমনই অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। ২৩ সেপ্টেম্বর যে তাদের সোনার মেয়েদের হাত ধরে রচিত হয়েছে আরেকটি ঈর্ষণীয় সাফল্য। বাংলার বাঘিনীরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে পা রাখলো আরেকটি স্বপ্নের সিঁড়িতে। কমলাপুর স্টেডিয়ামে এএফসি অ-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের ‘এফ’ গ্রুপের শেষ ম্যাচে এবং ‘অঘোষিত’ ফাইনালে স্বাগতিক বাংলাদেশ ২-০ গোলে হারায় ভিয়েতনামকে। বাংলাদেশের হয়ে একটি করে গোল করে ফরোয়ার্ড তহুরা খাতুন এবং ডিফেন্ডার আঁিখ খাতুন। অস্ট্রেলিয়ান রেফারি ক্যাথেরিন জ্যাসউইচের নির্লজ্জ ও পক্ষপাতিতত্বমূলক রেফারিংও হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। তিনি বিস্ময়কর-অন্যায়ভাবে বাংলাদেশের আরও ৩টি গোল বাতিল করে দেন। এর আগেও ২০১৪ সালে একই আসরে (ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত) বাংলাদেশের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছিলেন পর পর দুটি ম্যাচে। সেবার দুটি ম্যাচেই জিততে জিততে হেরে গিয়েছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ। তবে এবার আর ক্যাথেরিনের কূটচাল কাজে লাগেনি। খেলা শেষে এক ক্ষুব্ধ-রসিক দর্শকের মন্তব্য, ‘শকুনির দোয়ায় গরু মরেনি!’ এই জয়ে এএফসি অ-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের ‘এফ’ গ্রুপে অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলো গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যারা। সেই সঙ্গে এই আসরের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল তারা। এই পর্বের খেলা ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। এই গ্রুপে স্বাগতিক বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গোল (২৭) করার পাশাপাশি একমাত্র দল হিসেবে একটি গোলও হজম করেনি। দ্বিতীয় পর্বে বাংলাদেশ ছাড়াও কোয়ালিফাই করা অপর সাত দল হলো : চীন, লাওস, ইরান, অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপিন্স এবং ভিয়েতনাম। তার মানে বাংলাদেশের কাছে হেরে মন খারাপ হয়নি ভিয়েতনামের। কারণ ফিিিলপিন্সের মতো তারাও হয়েছে দুই সেরা রানার্সআপ দলের একটি। এই জয়ে ‘এফ’ গ্রুপে ৪ ম্যাচে সর্বোচ্চ ১২ পয়েন্ট বাংলাদেশের। সমান ম্যাচে রানার্সআপ ভিয়েতনামের পয়েন্ট ৯। বাংলাদেশের নয়নাভিরাম খেলা দেখে গাঁটের পয়সা উসুল হয়েছে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আসা হাজার পাঁচেক দর্শকের। তিন ম্যাচে খেলে বাংলাদেশ-ভিয়েতনামের গোল (২৫) এবং পয়েন্ট (৯) সমান ছিল। ফলে সৃষ্টি হয় এক সমীকরণের। বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম ম্যাচটি যদি ড্র হতো, তাহলে সরাসরি টাইব্রেকার অনুষ্ঠিত হতো (কোন অতিরিক্ত সময় খেলা হবে না)। সেক্ষেত্রে বাইলজ অনুযায়ী কিন্তু ম্যাচের অফিসিয়াল ফল ‘ড্র’ই লেখা থাকত। সেক্ষেত্রে যে দলই হারুক না কেন, তারা প্রত্যেকেই ১ পয়েন্ট করে লাভ করত। টাইব্রেকারের আশ্রয় নেয়া হতো গ্রুপের শীর্ষ দল নির্ধারণ করার জন্য। বাংলাদেশ দল যদি টাইব্রেকারে হেরেও যেত, তাহলেও তাদের পরের পর্বে যাওয়ার সুযোগ বেঁচে থাকত। সেটা বেস্ট দুই রানার্সআপ দলের একটি হিসেবে। সেক্ষেত্রে অন্য পাঁচ গ্রুপের খেলা শেষ হওয়া এবং গ্রুপগুলোর পয়েন্ট টেবিলের চূড়ান্ত অবস্থার ওপর নির্ভর করতে হতো তাদের। ম্যাচ শেষে নিজেদের খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি রেফারির কড়া সমালোচনা করেন বাংলাদেশের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। মহিলা ফুটবলে এটা ছোটনের ষষ্ঠ সাফল্য। এর আগে তার অধীনে মহিলা দল জেতে ২০১৫ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত এএফসি অ-১৪ বালিকা আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ (সাউথ এ্যান্ড সেন্ট্রাল), ২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ (সাউথ এ্যান্ড সেন্ট্রাল), ২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এএফসি অ-১৬ মহিলা আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইপর্ব (সাউথ এ্যান্ড সেন্ট্রাল), ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ২০১৮ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত জকি ক্লাব গার্লস ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ ইনভাইটেশনাল ফুটবল টুর্নামেন্ট। ‘আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞ যে আমরা মূলপর্বে যাওয়ার পথে প্রথম ধাপ ভালভাবে অতিক্রম করেছি। মেয়েদের জানাচ্ছি স্যালুট।’ কথাগুলো বাংলাদেশ মহিলা ফুটবলের সফল-কিংবদন্তি কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের। তার শিষ্যরা ২-০ গোলে হারিয়ে দেয় ভিয়েতনামকে এবং এএফসি অ-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। কমলাপুর স্টেডিয়ামে খেলা শেষে ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ছোটন আরও বলেন, ‘এই মেয়েদের নিয়ে আসলে আমি কী বলব। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। আসলে কঠোর পরিশ্রম করলে যে ফল আসে সেটা আবারও প্রমাণ হলো। আমাদের মেয়েরা নিজেদের খেলা খেলেছে। ৯০ মিনিট পর্যন্ত তারা আধিপত্য বিস্তার করে খেলেছিল। একটা সময় দেখা গিয়েছিল প্রথমার্ধে ভিয়েতনাম একটু লড়াই করেছে। কিন্তু বিরতির পর ফিটনেসের কাছে তারা হার মেনেছে।’
×