ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জিগোলো হতে চাইলে ইন্টারনেটে নিজের প্রোফাইল দেয়া যায়

প্রকাশিত: ২০:০৫, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

জিগোলো হতে চাইলে ইন্টারনেটে নিজের প্রোফাইল দেয়া যায়

অনলাইন ডেস্ক ॥ একটা আধো অন্ধকার ঘর। নীল, গোলাপী আলো জ্বলছিল। ওই ঘরটাতেই নিজেকে বিক্রি করতে গিয়েছিলাম আমি। বয়সে অনেক বড় এক মহিলা জিজ্ঞাসা করেছিল, "তুমি জানো কোথায় এসেছ? এখানে শরীর কেনাবেচা হয়, বুঝেছ?" সব জেনেশুনেই গিয়েছিলাম ওখানে। তাই জবাব দিয়েছিলাম, "হ্যাঁ। দেখতেই পাচ্ছি। তবে রোজগারের জন্য আমি সব কিছু করতে পারি।" ওই মহিলা যখন জবাব দিলেন, তখন খেয়াল করলাম ভাল করে, উনি নারী নন, হিজড়া। বলেছিলেন, "বেশ ভাব নিচ্ছ তো! এসব এখানে চলবে না, বুঝলে!" আমি যে পরিবার থেকে এসেছি, সেখানে কেউ কখনও ভাবতেই পারবে না যে আমি এই জায়গায় নিজেকে বেচতে এসেছি। দিনের বেলায় নয়-দশ ঘন্টা একটা আইটি কোম্পানিতে চাকরী করতাম। কিন্তু আমি বাধ্য হয়েছিলাম ওখানে যেতে। ওই হিজড়া বলেছিলেন, "যা, অফিসই কর তাহলে। এখানে কী করছিস?" বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ফেরার উপায় হয়তো ছিল, কিন্তু আমি তো ফিরে যাবার জন্য আসি নি! হঠাৎই ওই হিজড়া বেশ নরম হয়ে আমাকে বলেছিল, "তোর ছবি তুলতে হবে। ছবি না পাঠালে কেউ কথাও বলবে না এই মার্কেটে।" ছবি তোলার কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। যদি কোনও আত্মীয় স্বজনের হাতে আমার ছবি পড়ে, তাহলে তো সর্বনাশ!" কিন্তু যে কাজে নেমেছি, সেই নিয়ম তো মানতেই হবে। একবার ডানদিকে মুখ করে, একবার বাঁদিকে মুখ করে কয়েকটা ছবি তোলা হল। কয়েকটা 'বোল্ড' ছবিও তোলা হল। আমার সামনেই ওই ছবিগুলো হোয়াটস্অ্যাপে পাঠানো হল কাউকে। সঙ্গে লেখা হল, "নতুন 'মাল'। রেট বেশী লাগবে। কম পয়সার লাগলে অন্য ছেলের ছবি পাঠাচ্ছি।" আমার রেট ঠিক হচ্ছিল। মুহুর্তেই আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা, আই টি কোম্পানীতে চাকরী করা এক যুবক, ওদের কাছে নতুন পরিচিতি পেলাম, 'মাল' বলে। আমার দর ঠিক হল পাঁচ হাজার টাকা। ক্লায়েন্টের সঙ্গে সব কিছু করতে হবে - এমনই নির্দেশ। কোনও ফিল্ম নয়, এটা যে আমার নিজের জীবনেই ঘটতে চলেছে, সেটাই ভাবছিলাম তখন। একটা হলুদ ট্যাক্সিতে চেপে কলকাতার একটা বড়লোকদের পাড়ায় একটা বাড়িতে পৌঁছিয়েছিলাম। বসার ঘরে ঢুকে দেখলাম, একটা বিরাট বড় টিভি, আর ফ্রিজ আছে। ফ্রিজে মদের বোতল ভর্তি। আমার ক্লায়েন্ট ৩২-৩৪ বছর বয়সী এক বিবাহিতা নারী। মদ খেতে খেতে কথা বলছিলাম আমরা। উনি বলছিলেন, "আমি তো ভুল জায়গায় ফেঁসে গেছি। আমার স্বামী সমকামী। আমেরিকায় থাকে। ডিভোর্সও দিতে পারছি না। বিবাহ-বিচ্ছিন্না একজন মেয়েকে কে বিয়ে করবে? এদিকে আমারও তো ইচ্ছা-অনিচ্ছা রয়েছে! তুমিই বল আমি কী করব?" মদ খেতে খেতেই ওই মহিলা হিন্দি গান চালিয়ে দিয়ে নাচ করতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে বসার ঘর থেকে আমাকে বেডরুমে নিয়ে গেলেন। সবকিছু শেষ হওয়া পর্যন্ত বেশ নরম সুরে আদুরে গলায় কথা বলছিলেন। কিন্তু যেই কাজ শেষ হল, তখনই হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "এবার ভাগ এখান থেকে। কিছু বেশী টাকা দিয়েছিলেন উনি টিপস হিসাবে। তাকে বলেছিলাম, "আমি এই কাজ বাধ্য হয়ে করছি।" এই বাধ্য হয়ে এই লাইনে আসার শুরুটা কলকাতা থেকে অনেক দূরে আমার বাড়ি থেকেই শুরু হয়েছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। জন্মের পরেই বাবার চাকরীটা চলে গিয়েছিল। যত বড় হচ্ছিলাম ওঁর সঙ্গে দূরত্বটা বেড়েই চলেছিল। আমার স্বপ্ন ছিল এম বি এ পড়ব, কিন্তু জোর করে আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হল। চাকরী পেলাম কলকাতায়। অফিসে সবাই বাংলা বলে। আমি বলতে পারি না। তার ওপরে রয়েছে অফিসের রাজনীতি। আমি সেই চক্রের শিকার হলাম। অভিযোগ করেছিলাম, কোনও লাভ হয় নি। বাথরুমে গিয়ে কাঁদতাম। আমি যতক্ষণ সীটে থাকতাম না, সেই সময়টাও কেউ নোট করে বসকে বলে দিত যে 'এ এই সময় থেকে এই সময় অবধি সীটে ছিল না।' আমার আত্মবিশ্বাসটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ডিপ্রেশন শুরু হল আমার মধ্যে। ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, কিন্তু কোনও লাভ হয় নি। তখনই ঠিক করি যে এম বি এ পড়তেই হবে। তার জন্য চাই টাকা। কীভাবে রোজগার করা যায় বাড়তি টাকা, ইন্টারনেটে সেসবই সার্চ করতাম। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হবে। ইন্টারনেটেই প্রথম দেখতে পাই 'মেল এসকর্ট' বা জিগোলো হওয়ার রাস্তা। ফিল্মে দেখেছি জিগোলো ব্যাপারটা কী। কয়েকটা ওয়েবসাইট আছে, যেখানে জিগোলো হতে চাইলে নিজের প্রোফাইল দেওয়া যায়। নিজের প্রোফাইল লিখতে বেশ ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না, কী লিখব। কিন্তু আমার সামনে তখন দুটো পথ, আত্মহত্যা করা বা জিগোলো হয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিলাম। যেসব নারীদের সঙ্গে আমাকে কাজ করতে হয়েছে, তাদের মধ্যে যেমন বিবাহিতা মহিলা ছিলেন, তেমনই ডিভোর্সী, বিধবা বা অবিবাহিত মেয়েরাও ছিল। সবার কাছেই আমি 'মাল' হয়ে উঠেছিলাম। মানুষ বলে গণ্যই করত না কেউ। যতক্ষণ তাদের সব ইচ্ছে পূরণ করতে না পারতাম, ততক্ষণ ছাড়া পেতাম না। তবে সবাই কত ভাল ভাল কথা বলত! কেউ কেউ বলত স্বামীকে ডিভোর্স করে আমার সঙ্গেই নাকি থাকবে। তবে বেডরুমে যতটা সময় কাটাতাম, তারপরেই সব ভাব-ভালবাসা শেষ। সব প্রেম ভুলে গিয়ে কেউ বলত, 'চল বেরো এখান থেকে', কেউ বলত 'টাকা ওঠা, কেটে পড়।' গালিগালাজও কম খাই নি। এই সমাজ আমাদের কাছ থেকে মজাও লুটবে, আমার প্রস্টিটিউট বলে গালিও দেবে! একবার স্বামী-স্ত্রী - দুজনে একসঙ্গে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। লোকটি সোফায় বসে মদ খাচ্ছিল, আর আমি তার স্ত্রীর সঙ্গে বিছানায় ছিলাম। দুজনে যে ভেবে চিন্তেই আমাকে একসঙ্গে ডেকেছে, সেটা বুঝতেই পারছিলাম। হয়তো কোনও গোপন ডিজায়ার থাকবে এদের মনে। একজন মহিলা আমার ক্লায়েন্ট ছিলেন। বয়স প্রায় ৫০। তাঁর কাছে গেলেই আমার অন্যরকম অনুভূতি হত। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×