ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা নওফল হায়দার

বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে উইন্ডমিল অপার সম্ভাবনা বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ০৭:০২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে উইন্ডমিল  অপার সম্ভাবনা বাংলাদেশের

বিদ্যুত এমন একটি উপাদান যেটার চাহিদা সময়ের চাইতেও বেশি। বিশ্ব অর্থনীতিতে বিদ্যুত ব্যাপক অবদান রাখছে। বাংলাদেশের সাফল্যে বিদ্যুত উন্নয়ন একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশকে এখনও বেশ কয়েকটি সূচকে সাফল্য আনতে হবে। এরই মধ্যে সরকার পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। সেই সঙ্গে দেশে অচিরেই চালু হতে যাচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিশাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ও উপকূলীয় অঞ্চলে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহে সময়োপযোগী ও আধুনিক মানের, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হলো বায়ুবিদ্যুত। যেটাকে আমরা প্রযুক্তির ভাষায় বলি উইন্ডমিল। উইন্ডমিল, এটি হচ্ছে বায়ুকল। এক ধরনের যন্ত্র যা পাল বা ব্লেডের মাধ্যমে আবর্তনশীল শক্তির মাধ্যমে বায়ু শক্তিকে বিদ্যুত শক্তিতে রূপান্তর করে। মানব সভ্যতার প্রথম দিকে এটি ব্যবহার করা হতো শস্য উৎপাদনে। কারণ সেই সময়টায় শস্য উৎপাদনে কোন উন্নত ডিভাইস কিংবা প্রযুক্তি ছিল না। পরবর্তীতে মানুষ এটির ভিন্ন একটি ব্যবহার খুঁজে পায়; যান্ত্রিক টার্বাইন ব্যবহার করে কলকারখানা এবং বাসাবাড়িতে বিদ্যুত সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয় বিভিন্ন দেশে। আধুনিক ইউরোপে উইন্ডমিলের সংখ্যা আনুমানিক ৫ লাখ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বায়ু বিদ্যুত ১১৮৯৫ মেগাওয়াট, যা গোটা ইউনিয়নের নতুন বিদ্যুতক্ষমতার হিসেব অনুযায়ী ২৬.৫ শতাংশ। উইন্ডমিলগুলো এমন এলাকায় বেশি বসানো হয়েছিল, যেখানে নদীগুলোতে খুব সামান্য পানি ছিল। সেসব নদীর পানি শীতকালে বরফ হয়ে যেত। শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক উৎস হিসেবে বায়ু এবং পানি শিল্পের গুরুত্ব বেড়েছে দিনদিন। উনিশ শতকের শেষ সময় পর্যন্ত প্রচুর সংখ্যক উইন্ডমিল নির্মিত হয়েছে। নেদারল্যান্ডসে ১৮৫০ সালের কাছাকাছি সময়ে প্রায় ১০ হাজার উইন্ডমিল নির্মাণ করা হয়; সেগুলোর মধ্যে এক হাজার এখনও টিকে আছে। এগুলো কিছু ছাতু মিলে বাণিজ্যিকভাবে অপারেটিংয়ে সাহায্য করছে। বর্তমানে নিষ্কাশন মিলের অনেক আধুনিক পাম্পিং স্টেশন ব্যাকআপ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিল্প বিপ্লবের তুলনায় শিল্পের ওপর একটি বড় ধরনের প্রভাব ছিল এইসব শস্য মিলের। যুক্তরাষ্ট্রে বায়ুশক্তি গত কয়েক বছরে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। ২০১৩ সালের হিসাবে দেশটির মোট ক্ষমতা ৬১১০৮ মেগাওয়াট ছিল। এই ক্ষমতা শুধুমাত্র চীন অতিক্রম করতে মার্কিন বায়ু শিল্পে গত ১৭ বছর ধরে ১৫.৬ শতাংশ গড়ে বার্ষিক বৃদ্ধি (১৯৯৫-২০১১) ছিল। ২০১৪ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র বায়ুশক্তি থেকে ১৭৭.৪৪ টেরাওয়াট প্রতি ঘণ্টায় শক্তি উৎপন্ন করে যা মোট বৈদ্যুতিক শক্তির ৪.৩৩ শতাংশ। বায়ু শক্তি শতাব্দী ধরে মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মানুষ কমপক্ষে ৫ হাজার ৫৫০ বছর আগে থেকে বায়ুু শক্তি পালতোলা নৌকা, জাহাজ এবং সেচ পাম্প চালানোর জন্য ব্যবহার করে আসছে। চার্লস ফ্রান্সিস ব্রুস (১৮৪৯- ১৯২৯) ১৮৮৭-৮৮ সালে একটি বাতচক্র (বায়ু টারবাইন) নির্মাণ করেন যা একটা ব্যাটারি মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদনের জন্য জেনেরেটরের সাতে যুক্তছিল। ১৮৯১ সালে ডেনিশ পদার্থবিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক পল লা চউর প্রথম ‘বায়ুু ঘূর্ণনযন্ত্র’ পরীক্ষা করেন। ১৯০০ সালের কাছাকাছি তিনি বায়ুু-চালিত বিদ্যুত প্ল্যান্ট বিকাশ শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন কয়লা ও তেলের ঘাটতি ছিল তখন এফএল স্মিথ কোম্পানি ৬০-৭০ কিলোওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বায়ুু টারবাইন নির্মাণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন তেল এবং কয়লা আবার ছিল প্রধান শক্তির উৎস, বায়ুু শক্তির আগ্রহ আবার লীন হয়ে যায়। এরমধ্যে ১৯৭০ সালে ডেনমার্কে ১২-১৫ মি উচ্চতা ও ২০ মি থেকে ব্যাস বিশিষ্ট বায়ুু ঘূর্ণযন্ত্র নির্মাণ করে, যা থেকে ২০০ কিলোওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৭০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসা আধুনিক ও আকারে বড় আকৃতি বিশিষ্ট বায়ুু টারবাইন নির্মাণের জন্য গবেষণা চালু করে। ১৯৭৩ সালে বিশ্বে শক্তি সঙ্কটের কারণে সবার কাছে বায়ুু শক্তি নিয়ে আবার ক্রমবর্ধমান আগ্রহের সৃষ্টি হয় ও বিকাশ সাধন করে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই বাড়তি চাহিদার কথা মাথায় রেখে ভবিষ্যতে বিদ্যুত উৎপাদনের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মতো বায়ুশক্তিকে ব্যবহার করার কথা ভাবা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ বিদ্যুত উৎপাদনের উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। যার ফলে কলকারখানা এবং বাসাবাড়িতে গ্যাসের সঙ্কট প্রায়শই দেখা যায়। বাংলাদেশে খুব সামান্য পরিমাণে বায়ুু শক্তি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ১৯৮২ সালে একটি প্রারম্ভিক গবেষণায় দেশের ৩০টি আবহাওয়া তথ্য স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা থেকেপ্রাপ্ত বায়ুগতি ছিল শুধুমাত্র বায়ুু শক্তি উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। একটি বায়ু পাম্প সেট পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো মুহুরি বাঁধ এলাকায় একটি ০.৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সম্পন্ন বায়ুু শক্তি পাইলট প্রকল্প শুরু করে যা জাতীর পাওয়ার গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত। বিশ্ব বায়ু শক্তি পরিষদের রিপোর্ট অনুসারে, বায়ু শক্তির মাধ্যমে ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বের বিদ্যুত চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে। তাদের হিসাবে, বায়ু শক্তি কাজে লাগিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫,৪০০ টেরাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। যদিও পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশসমূহ যদিও বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অজস্র সম্ভাবনা থাকলেও অগ্রগতি বেশ ধীর। কারণ বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে তথ্য উপাথ্যের দুষ্প্রাপ্যতা বিদ্যমান। বাংলাদেশে মাত্র দুটি বায়ু বিদ্যুত প্রকল্প বর্তমানে সক্রিয় আছে। যদিও সমসাময়িককালে বায়ু শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার প্রয়াসে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করছে যা মূলত বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে অনেকখানি বৃদ্ধি করেছে। যদিও ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের একটি চমৎকার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার সর্বাধিক ৫টি স্থানে এক বছরব্যাপী বায়ু শক্তির সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। স্থানগুলো হলো-ফেনীর মুহুরীদাম, কক্সবাজার, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কুয়াকাটা ও খেপুপাড়া। সমীক্ষার পর সবচেয়ে উপযোগী স্থানে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র্র বাস্তবায়নের পরিকল্পনাও হাতে নেয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো পরিশেষে এই পরিকল্পনাটির সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশে বায়ু প্রবাহের মাত্রার হিসেবে মহেমখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ হাতিয়ার মতো সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ উয়িন্ডমিল টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বেশ উপযুক্ত। বায়ু শক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি শক্তির একটি অফুরন্ত উৎস। প্রকৃতি তার অমোঘ বিধানে আমাদের বাতাস দিয়ে চলেছে অনন্তকাল ধরে। এর কোন মেষ নেই। তাছাড়া আমাদের দেশ মূলত গ্যাস বিদ্যুত প্রকল্পের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বিদ্যুত উৎপাদনের প্রায় ৮৬ শতাংশ জ্বালানি চাহিদা মেটানো হয় গ্যাস দিয়ে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান। কেননা গ্যাস হচ্ছে অনাবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। ফলে যদি আমরা বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বায়ু শক্তির বিকল্প উৎসের কথা না চিন্তা করে তবে একটা সময় আমাদের বিরাট সমস্যার মুখে পতিত হতে হবে। তাছাড়া, বায়ু শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুত শক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে বসবাসরত মানুষের জীবনমানও উন্নত করা সম্ভব। এসব এলাকার মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম হলো মৎস্য আহরণ। কিন্তু মৎস্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকার অভাবে তাদের কষ্টার্জিত মৎস্য অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। যদি উয়িন্ডমিল প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদন করে উপকূলীয় মানুষদের দোরগোড়ায় বিদ্যুত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় তবে উপকূলীয় অঞ্চলের এসব মানুষদের সমস্যা বহুলাংশে সমাধান করা সম্ভব। এটি শুধু উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন সাধন করবে না, বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। বায়ু টারবাইন জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত সরবরাহ করবে বিরতিহীনভাবে। শহর বা শহরতলিতে অধিক ভোল্টেজ এবং ফ্রিকোয়েন্সির যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ছোট বায়ু টারবাইন গ্রিড সিস্টেম ছাড়া ব্যবহার করা হয় এবং চাহিদা অনুযায়ী বায়ু বিদ্যুত সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে পরিবর্তিত ব্যাটারি ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে বাতাসের গতি দ্বারা একটি বিদ্যুত উৎপাদিত বায়ুঘূর্ণনযন্ত্র আউটপুট ওয়াট উৎপাদিত হবে যা বিদ্যুত উৎপাদনে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ বিদ্যুত বোর্ড আশা করছে, ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এই উইন্ডমিল আমাদের দেশের বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে। তাই এটি বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদার সম্ভাব্য সমাধান। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিদ্যুতে স্বনির্ভর একটি উন্নত দেশ।
×