ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ রাশেদুল হক

পৃথ্বী শ’র ঝড় তোলা অভিষেক

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১০ অক্টোবর ২০১৮

পৃথ্বী শ’র ঝড় তোলা অভিষেক

ভারতীয় ক্রিকেটে জাতীয় দলে আসার আগেই যাদের নামের পাশ্বে ‘বিস্ময়-প্রতিভা’ তকমা যুক্ত হয়েছে পৃথ্বি শ’ তাদের শেষ জন। শিখর ধাওয়ান বাদ পড়ার পর থেকেই গুঞ্জন চলছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হতে যাচ্ছে মহারাষ্ট্রে জন্ম নেয়া ১৮ বছর বয়সী হার্ডহিটার এই ব্যাটসম্যানের। শুধু অভিষেকই নয়, আগমনে ক্রিকেটবিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছেন শিশুসুলভ চেহারার ছোট্ট এই মানুষটি। জীবনে প্রথমবারের মতো মাঠে নেমে মাতিয়ে দিয়েছেন ছোটখাটো গড়নের বিরল এই প্রতিভা। রাজকোটে সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে খেলেছেন ১৩৪ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংস। পৃথ্বীর অভিষেক যাঁর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি করে তুলনা চলে আসছিল, সেই শচীন টেন্ডুলকরও আবেগাপ্লুত উত্তরসূরির ব্যাটিং দেখে। ‘জীবনের প্রথম ইনিংসেই তোমার থেকে এ রকম আগ্রাসী ব্যাটিং দেখে ভাল লাগল। এই রকম ভয়ডরহীন ব্যাটিংই করে যাও।’ টুইটারে লিখেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি। অভিষেক টেস্টে পৃথ্বীর চেয়ে কম বয়সে (১৮ বছর ৩২৯ দিন) আর কোন ভারতীয় সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারেননি। তবে তারচেয়ে কম বয়সে ভারতের পক্ষে শতক হাঁকানোর রেকর্ডটা শচীনের। রাজকোটের সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে সবার নজর ছিল পৃথ্বির দিকে। কারণ শিখর ধাওয়ান কিংবা মুরালি বিজয় ও করুন নায়ারের মতো ব্যাটসম্যানরা দলেই সুযোগ পাননি। অথচ ১৮ বছর বয়সী এ তরুণের অভিষেক হয়েছে। শুরু থেকেই তিনি ক্যারিবীয় বোলারদের ওপর চড়াও ছিলেন। প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামার জন্য বিন্দুমাত্র অস্বস্তি ছিল না তার মধ্যে। এর কারণ তার কিশোর বয়স থেকে দুর্দান্ত কিছু রেকর্ড। ১৪ বছর বয়সে স্কুল ক্রিকেটের এক ইনিংসে ৫৪৬ রান, ১৭ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেকে নেমেই সেঞ্চুরি, সর্বশেষ প্রথম শ্রেণীর আসরে ৫টি সেঞ্চুরি। এমন রেকর্ডগুলো যার দখলে তিনি কোনভাবেই ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার মতো অবস্থানে নেই সেটা ক্যারিবীয় বোলাররা হাড়ে-হাড়েই টের পেয়েছে। লোকেশ রাহুল ইনিংসের প্রথম ওভারেই সাজঘরে ফিরেছেন, তবু বিচলিত হননি পৃথ্বী। দ্বিতীয় উইকেটে পূজারার সঙ্গে ২০৬ রানের বিশাল জুটি গড়ে ক্যারিবীয় বোলারদের কোণঠাসা করে ফেলেন। পৃথ্বি তুলে নেন ৯৯ বলে সেঞ্চুরি। টেস্ট অভিষেকে এটি তৃতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। এর আগে শিখর ধাওয়ান ৮৫ বলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মোহালিতে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডোয়াইন স্মিথ ৯৩ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন অভিষেকে। তবে অভিষেক টেস্টে তারচেয়ে কম বয়সে কোন ভারতীয় ব্যাটসম্যান শতক হাঁকাতে পারেননি। আব্বাস আলী বেগ ১১২ রান করেছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওল্ডট্র্যাফোর্ডে ১৯৫৯ সালে। তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর ১২৬ দিন। অবশ্য ভারতের হয়ে টেস্টে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ড শচীনের। তিনি ১৭ বছর ১০৭ দিন বয়সে হার না মানা ১১৯ করেন ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৯০ সালে। পরবর্তী দুটি রেকর্ডও তারই দখলে, ১৮ বছর ২৫৩ দিনে ১৯৯২ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ১৪৮ এবং একই সিরিজে পার্থে ১৮ বছর ২৮৩ দিন বয়সে ১১৪ রান করেছিলেন। এরপরই পৃথ্বির অবস্থান। সার্বিকভাবে টেস্ট ইতিহাসে পৃথ্বির চেয়ে কম বয়সে অভিষেকে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন মাত্র ৩ জন। বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল ১৮ বছর হওয়ার আগেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বিশ্বরেকর্ড ধরে রেখেছেন। দ্বিতীয় স্থানে আছেন জিম্বাবুইয়ের হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। পাকিস্তানের সেলিম মালিক ৬ দিন ছোট বয়সে সেঞ্চুরি করেছেন পৃথ্বির চেয়ে। সবমিলিয়ে টেস্ট ইতিহাসে ১৫তম ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরি হাঁকালেন তিনি। তবে মাত্র তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম শ্রেণী ও টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি হাঁকানোর গৌরব দেখিয়েছেন পৃথ্বি। এর আগে ভারতের গুড্ডাপা বিশ্বনাথ ও অস্ট্রেলিয়ার ডার্ক ওয়েলহ্যাম এই দুটি অর্জনের মালিক ছিলেন। ১৫৪ বলে ১৯ চারে ১৩৪ রান করার পর দেবেন্দ্র বিশুর বলে তাকেই ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন। এটি ভারতের পক্ষে অভিষেকে চতুর্থ সেরা ব্যক্তিগত ইনিংস। শিখর ধাওয়ান তার অভিষেক ইনিংসটি ১৮৭ পর্যন্ত টেনে নিয়েছিলেন, রোহিত শর্মা করেছিলেন ১৭৭, বিশ্বনাথের উইলো থেকে বেরিয়েছিল ১৩৭। ১৮ কিংবা এরচেয়ে কম বয়সে পৃথ্বির ইনিংসটি টেস্ট ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ভারতের ২৯৩তম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক হয় পৃথ্বি শ’র। শচীনের মতো মুম্বাই ক্রিকেটমহল তাঁকেও চিহ্নিত করে বিস্ময়-প্রতিভা হিসেবে। জুনিয়র থেকে সিনিয়র, সব স্তরের ক্রিকেটেই পৃথ্বী দুরন্ত ধারাবাহিক। ভারতের অনুর্ধ-১৯ দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৮ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান মুম্বাইর রান মেশিনে পরিণত হয়েছেন। মাত্র গত বছরই রঞ্জি ট্রফিতে তার প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ার শুরু হয়। সেমিফাইনালে মুম্বাইর হয়ে চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি করে নিজের জাত চেনান। এ পর্যন্ত ১৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন। আর তাতেই নির্বাচকরা তাকে দলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, ১৪ ম্যাচেই পৃথ্বি ১ হাজার ৪১৮ রান করেছেন। যেখানে তার গড় ৫৬.৭২। স্ট্রাইক রেট ৭৬.৬৯। সেঞ্চুরি রয়েছে ৭টি। হাফ সেঞ্চুরি ৫টি। সর্বোচ্চ ১৮৮ রান! ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীরও মনে ধরেছে পৃথ্বীর ব্যাটিং। কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান পৃথ্বী। না হলে কেউ রঞ্জি, দুলীপ আর টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি করতে পারে না। পৃথ্বীকে দেখে মনে হয়েছে, ও ব্যাকফুটে খুব শক্তিশালী। বছরের শেষে অস্ট্রেলিয়া সফরেও আশা করব ও সফল হবে। কারণ ব্যাকফুটে পৃথ্বী সাবলীল। যেটা অস্ট্রেলিয়ায় ওকে সাহায্য করবে।’ প্রশ্ন করা হয়, আপনার কি মনে হয়, পৃথ্বী এসে যাওয়ায় ভারতের ওপেনার সমস্যা অনেকটা মিটে গেল? জবাবে সৌরভ বলেন, ‘এখন তো পৃথ্বী সবে খেলা শুরু করল। আরও কিছুটা সময় দিতে হবে।’ পৃথ্বীকে ইদানীং যিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন, সেই ভারতের কোচ রবি শাস্ত্রী বলছেন, ‘অভিষেকেই চাপমুক্ত এবং ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার জন্য অভিনন্দন। বীরু এবং মাস্টারের ছায়া কিছুটা দেখতে পেলাম।’ পূজারা আউট হওয়ার পরেই ব্যাট করতে নেমে পৃথ্বীকে অভিনন্দন জানান অধিনায়ক বিরাট কোহলি। বীরেন্দ্র সেহবাগের টুইট, ‘পুরোটাই শয়ের শো। অভিনন্দন পৃথ্বী শ। এই তো সবে শুরু হল। ছেলেটার মধ্যে অনেক দম আছে।’ পৃথ্বীরই শহর মুম্বইয়ের আর এক প্রাক্তন ক্রিকেটার সঞ্জয় মাঞ্জারেকর টুইটে লিখেছেন, ‘অভিষেকেই সেঞ্চুরির জন্য অভিনন্দন। খুব ভাল লাগল দেখে যে, পৃথ্বী একশো স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করলেও কখনও মনে হয়নি ঝুঁকি নিচ্ছে।’ শুধু ভারতীয় ক্রিকেটাররাই নন, বিদেশের মাটি থেকেও এসেছে অভিনন্দনবার্তা। সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়তক মাইকেল ভন যেমন লিখেছেন, ‘১৮ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকে কী খেলল পৃথ্বী! দেখে মনে হচ্ছে, আরও একজন ভারতীয় মহাতারকা এসে গেল।’
×