ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অকালে না ফেরার দেশে হ্যান্ডবলের গুরু জাহিদ

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১০ অক্টোবর ২০১৮

অকালে না ফেরার দেশে হ্যান্ডবলের গুরু জাহিদ

বাবা-মা ও চার ভাই-বোনের সংসারে জাহিদ দ্বিতীয় ও একমাত্র ছেলে সন্তান। তাই তিনি ছিলেন সবার আদরের। স্কুল হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার মাধ্যমেই হ্যান্ডবল অঙ্গনে তথা ক্রীড়াঙ্গনে পদার্পণ। কায়সার জাহিদ আহমেদ তার বুদ্ধিদীপ্ত খেলা ও আধুনিক কলাকৌশলের মাধ্যমে ছোট বেলাতেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। যোগ্যতা দিয়েই বাংলাদেশ জাতীয় যুব দলে নিজের জায়গা করে নেন। প্রতিদিন মাঠে আসা, হ্যান্ডবলের প্রশিক্ষণ নেয়া ও হ্যান্ডবল খেলে তার দিনগুলো ভালই কাটছিল। ২০০৪ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিতব্য এশিয়ান যুব হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় যুব দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। পরবর্তীতে জাহিদ বাংলাদেশ জাতীয় খো খো দলে খেলোয়াড় হিসেবে জায়গা করে নেন এবং পরে খো খো জাতীয় দলের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৩ মে ২০১২ সালে, বান্দরবান জেলার লামায় কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে শারীরিক শিক্ষক হিসেবে তার চাকরি হয়। চাকরিতে যোগ দেয়ার পর ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে জীবনে। জাহিদ তার মেধা ও মেধাসম্পন্ন কলাকৌশলের মাধ্যমে স্কুলের হ্যান্ডবল দলটিকে একটি শক্তিশালী দল হিসাবে গড়ে তোলেন। অল্পদিনের মধ্যেই তার হ্যান্ডবল দল অপরাজেয় হয়ে ওঠে। মাদ্রাসা ও স্কুল শিক্ষা বোর্ডের আয়োজনে প্রতিযোগিতায় তার স্কুল হ্যান্ডবল দল অপরজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। স্কুলের পাশাপাশি তার নামও বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। পাল্টাতে থাকে জাহিদের জীনও। তার ধ্যান-ধারণা সবই এই স্কুলের ছাত্র আর খেলা নিয়ে। কি করে তার স্কুল হ্যান্ডবল দলকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় এই ছিল তার একমাত্র স্বপ্ন। জাহিদ বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনে আবেদন করেন জাতীয় প্রতিযোগিতায় তার স্কুল হ্যান্ডবল দলকে খেলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। বাংলাদেশ হ্যান্ডবল থেকে আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে জানানো হয় এটা সম্ভব না। কিন্তু জাহিদ পেছনে তাকানোর ছেলে নয়। তাই কোয়ান্টাম হ্যান্ডবল ক্লাব নামে হ্যান্ডবল লীগে অংশ নিয়ে তার স্কুলের ছেলেদের নিয়ে দল গঠন করেন। জাহিদের প্রশিক্ষণে তার দল প্রথম বারই বাজিমাত করে লীগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। তার দল প্রথম বিভাগ হ্যান্ডবল লীগে খেলার গৌরব অর্জন করে। পরের বছরও জাহিদের হ্যান্ডবল দল চমকপ্রদ খেলা প্রদর্শন করে প্রথম বিভাগ হ্যান্ডবল লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আইএইচএফ চ্যালেঞ্জ ট্রফিতে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ হ্যান্ডবল দলের প্রশিক্ষণ শিবিরে জাহিদের হ্যান্ডবল দলের পাঁচজন খেলোয়াড় ডাক পান। দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণের পর বাংলাদেশ জাতীয় যুব দলে জাহিদের গড়া দুজন খেলোয়াড় জায়গা করে নেন। অন্যান্য খেলোয়াড়দের সাঙ্গে সেই দুজনের চমৎকার ক্রীড়াশৈলী ও আক্রমণাত্মক খেলার সুবাদে পাকিস্তানকে হারিয়ে রানার্সআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে অনুষ্ঠিতব্য আইএইচএফ চ্যালেঞ্জ ট্রফিতে জাহিদের প্রশিক্ষণে গড়া প্রায় ৭-৮ জন খেলোয়াড় প্রশিক্ষণ শিবিরে ডাক পান। কিন্তু পাকিস্তানে নিরাপত্তার অভাবের কারন দেখিয়ে তারা প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে একজন সহজ সরল শান্তশিষ্ট সাধারণ মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করে তোলেন। ওর মধ্যে সেই উত্তেজনা নেই সেই চঞ্চলতা। একজন ধীর স্থির শান্ত, একেবারেই অন্যরকম এক জাহিদ। খুব ধীরে ধীরে কথা বলেন। খুব ধীরে ধীরে চলাচল করেন। সব কিছুই ওর ধীর স্থির। এর মধ্যেই বাংলাদেশ অলিম্পক এ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে ইন্টার ন্যাশনাল হ্যান্ডবল ফেডারেশন থেকে উচ্চতর হ্যান্ডবল প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের আমন্ত্রণ আসে। সবার বিবেচনায় জাহিদের নাম মনোনিত হয়। বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাহিদকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য হাঙ্গেরিতে পাঠানো হয়। চার মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ফাইনাল পরীক্ষায় ভালভাবে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। পরিবারের সাঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে লামায় তার স্কুলে যোগ দেন। আবারও তার ছেলেদের নিয়ে শুরু করেন হ্যান্ডবল প্রশিক্ষণ। এ বছরের জুলাই মাসে শুরু হয় প্রিমিয়ার হ্যান্ডবল লীগ। জাহিদের কোয়ান্টাম হ্যান্ডবল ক্লাবসহ মোট ১০টি দল অংশ নেয় এই লীগে। প্রথম খেলাতেই ভারতীয় খেলোয়াড় সমৃদ্ধ নারিন্দা বয়েজ ক্লাবকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে। এভাবেই সব ক্লাবকে হারিয়ে কিউট প্রিমিয়ার লীগ ২০১৮ চ্যাম্পিয়ন হয় জাহিদের কোয়ান্টাম। বাংলা ক্লাবের কাছে কেন হালেন সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উওর দিতে গিয়ে জাহিদ বলেন বিশ্রাম ছাড়া প্রতিদিন খেলার কারণে ছেলেরা ক্লান্ত। তাই এই হার। প্রিমিয়ার লীগে প্রশিক্ষক হিসেবে জাহিদের এই কৃতিত্বে হ্যান্ডবল ফেডারেশনের কর্মকর্তারা খুব খুশি। অন্তত বাংলাদেশ হ্যান্ডবলের জন্য একজন ভবিষ্যত প্রশিক্ষক হিসেবে জাহিদকে গণ্য করলেন। দু-একজন কর্মকর্তা এমনও বললেন এরপর যুবদলের খেলোয়াড়দের লামায় পাঠিয়ে দেব। ওখানেই যুব দলের ক্যাম্প হবে। জাহিদ প্রশিক্ষণ দেবে। কিন্তু কিছুদিন পরই আমাদের স্বপ্ন চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেল এক অকল্পনীয় দুঃসংবাদে। লামায় সড়ক দুর্ঘটনায় সবার প্রিয় জাহিদ মারা গেলেন। অপমৃত্যু হলো একটি ভবিষ্যতের, অপমৃত্যু হলো আমাদের স্বপ্নের। স্কুল ও মাদ্রাসা বোর্ডের প্রতিযোগিতায় খেলা শেষে ফুটবল ও কাবাডি দল নিয়ে ফিরছিলেন স্কুলে। পথেই এই দুর্ঘটনা। ড্রাইভার গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারালে সবাইকে নিয়ে পড়ে যায় প্রায় ১৫০ ফুট নিচে। গাড়িতে থাকা সবাই কমবেশি আহত হন। কিন্তু মারা গেলেন শুধু একজন। তিনি জাহিদ, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ভবিষ্যত। চোখে ভাসতে থাকে তার সফলতার মুহূর্তগুলো। এই তো কয়েকদিন আগে তার দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তার ছেলেরা সবাই মিলে তাকে আকাশে উড়িয়েছিলেন। শূন্য থেকে নিচে পড়েছিলেন খেলোয়াড়দের দৃপ্ত হাতে। দুর্ঘটনা স্থল থেকে এ্যাম্বুলেন্সে করে চিটাগাং মেডিক্যালে নেয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। রাতেই তার লাশ নিয়ে ঢাকায় রওনা হয় এ্যাম্বুলেন্সটি। বয়স ৮০ ছুই ছুই বাবার জন্য এই জোয়ান ছেলের লাশ কত বড় বোঝা, তা কেবল বাবাই অনুমান করতে পারেন। তারপরও তার বাবা এই লাশ কাঁধে নিয়ে গেছেন প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছেলেটিকে কবর দেয়ার জন্য। জাহিদের যুবতী স্ত্রী, যার অনেক রঙিন স্বপ্ন ছিল। সেই রঙিন স্বপ্ন কবর দিয়ে তিনি এখন সাদা কাপড় পরেই সারাটা জীবন কাটাবে। জাহিদের তিন বছরের ছোট শিশু কখনও মায়ের কোলে কখনও দাদার কোলে কখনও চাচা, ফুপির কোলে। সবার দিকে হাজারও প্রশ্ন নিয়ে তাকাচ্ছে, ও বুঝতে পারছে না অনেকেই এমন করে কাঁদছে কেন। ভালবাসা আদর ¯েœহ বোঝার আগেই হারালেন সবচেয়ে বড় সম্পদ প্রিয় পিতাকে। ছোট একটা অবুঝ শিশু বোঝাতে পারে না, বলতে পারে না, কিন্তু অনুভব করে ঠিকই বাবা-মা, দাদা-দাদির আদর ভালবাসা। অনেকের আদর ¯েœহের সঙ্গে খুঁজবে বাবার আদর ¯েœহ ভালবাসা। ও বলতে পারবে না বোঝাতে পারবে না, কিন্তু ঠিকই অনুভব করবে এখন যত ভালবাসা আদর ¯েœহ পাচ্ছে ওখানে ওর বাবার পরশ নেই। যতদিন ওর শিশু মন থেকে ওর বাবার স্মৃতি না মুছবে ততদিন ওর বাবাকে খুঁজবে। বাড়ির বারান্দায় ঘরের বিছানায় অথবা আকাশের তারায়। এই কোমলমতি ছোট শিশুটি আর কখনও বাবার কোলে উঠতে পারবে না। সারাজীবন বঞ্চিত থাকবে বাবার ভালবাসা আদর, ¯েœহ থেকে। জাহিদের স্ত্রী, একেবারেই গোবেচারা চেহারা, শরীরের গড়ন একেবারে ছিপছিপে, দেখে মনে হয় স্কুল পড়ুয়া কোন মেয়ে। সবচেয়ে বড় কথা জাহিদের পরিবার অসচ্ছল । তবে কোন কিছুর অভাব নেই। কারণ ওদের যা আছে তা নিয়েই সস্তুষ্ট। তবে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যের অকাল মৃত্যুতে তার পরিবার কিছুটা হলেও সমস্যার সম্মুখীন বর্তমানে। জাহিদের জানাযা শেষে বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের কর্মকর্তারা জাহিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। জাহিদের বাবা হ্যান্ডবল ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের (কোহিনুর ভাই, স্বপন, সালাউদ্দিন, জাহাঙ্গীর) একটা কথাই শুধু বলেন। মাঝে মাঝে এই মেয়েটার (জাহিদের কন্যা সন্তান) একটু খবর নিয়েন। এই ছোট্ট অবুঝ মেয়েটির মায়াবি চেহারা আমাদেরও ভাবনায় ফেলেছে। কি হবে ওর আগামী, কি হবে ওর ভবিষ্যত। এই লেখার মাধ্যমে ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে ছেলে ক্রীড়াঙ্গনে কাজ করে গেছেন। তার বিধবা স্ত্রী ও অবুঝ সন্তানের জন্য তাদের ভবিষ্যতের জন্য তিনি যেন পাশে দাঁড়ান, সহযোগিতার হাত বাড়ান। জাহিদ ও তার পরিবার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বার বার একটি কথাই মনের মাঝে উঁকি মারছিল, জাহিদসহ জাহিদের স্কুল দলের খেলোয়াড়দের গাড়িতে (টেম্পো ধরনের, যাকে স্থানীয়রা চান্দের গাড়ি বলে।) ড্রাইভার, হেলপারসহ ২৪-২৫ জন ছিল। অথচ এত বড় দুর্ঘটনায় মারা গেছে শুধুমাত্র একজন, আমাদের প্রিয় জাহিদ। লেখক ঃ মোঃ নূরুল ইসলাম সহ-সভাপতি বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশন
×