ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জেলখানায় আটক বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামি, জঙ্গীদের উদ্ধারে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় নীলনক্সা ছক কষে হুজি জঙ্গীরা;###;মাজেদ ভাট ও তেহরিক-ই জিহাদিল নেতা মোজাফফর শাহ বাংলাদেশে জঙ্গী হামলা চালাতে এই গ্রেনেড পাঠায় পাকিস্তান থেকে

আর্জেস গ্রেনেড রহস্য ॥ দীর্ঘ ১৪ বছরেও উন্মোচন হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১২ অক্টোবর ২০১৮

আর্জেস গ্রেনেড রহস্য ॥ দীর্ঘ ১৪ বছরেও উন্মোচন হয়নি

শংকর কুমার দে ॥ বহুল আলোচিত ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পরদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর থেকে উদ্ধার করা আর্জেস গ্রেনেড রহস্য দীর্ঘ ১৪ বছরেও উদ্ঘাটিত হয়নি। পাকিস্তান থেকে আর্জেস গ্রেনেড এনেছে জঙ্গী হরকত-উল জিহাদ (হুজি)। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে কারাগার উড়িয়ে দেয়াসহ আরও একটি বড় ধরনের নাশকতার ছক কষা হয়েছিল বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। কারণ সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পাঁচ আসামি। নিষিদ্ধ সংগঠন হরকত-উল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) সদস্যদের দিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামি, হুজিসহ জঙ্গী সংগঠনের বন্দীদের মুক্ত করার জন্য গ্রেনেড হামলার চক্রান্ত করা হয়েছিল কি-না বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে সিআইডি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলার পরপরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় একটি আর্জেস গ্রেনেড। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে উদ্ধার হওয়া ওই গ্রেনেডের রহস্যের জট খোলেনি। কারাগারের কঠোর নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে কারা কিভাবে গ্রেনেডটি ভেতরে নিয়ে গেল তার কূল-কিনারা করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তারা। গ্রেনেড উদ্ধারের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের দায়ের মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলা মামলার কয়েক আসামিকে কারাগারের ওই গ্রেনেডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল তখন। কিন্তু রহস্যের জট খোলেনি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ঘটনার পর ‘আর্জেস গ্রেনেডের’ উৎস ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে এই গ্রেনেড আনে জঙ্গীরা তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছে। গ্রেনেড হামলার সময় আর্জেস গ্রেনেড নিয়ে সবচেয়ে বেশি চাঞ্চল্য ও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছিল। সবার জিজ্ঞাসা ছিল হামলার জন্য বিপুলসংখ্যক আর্জেস গ্রেনেড কারা সংগ্রহ করেছে? কিভাবে এবং কোন দেশ থেকে সংগ্রহ করেছে? ঘটনার ১৪ বছর পরও এসব প্রশ্ন সবার মুখে মুখে ঘুরছে। তবে তদন্ত সংস্থা সিআইডি ও পুলিশের দফায় দফায় তদন্তের পর সব রহস্য বের হয়ে আসে। এ হামলার পেছনে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী, উর্ধতন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা, পাকি গোয়েন্দা সংস্থা, দেশী ও বিদেশী জঙ্গী নেতারা সরাসরি জড়িত ছিল। গ্রেফতারকৃতরা তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে পুরো ষড়যন্ত্র ও হামলার অপারেশনাল কার্যক্রমের বর্ণনায় উঠে এসেছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘সাক্ষীদের জবানবন্দী ও আসামিদের স্বীকারোক্তিতে প্রকাশ পায়, আসামি মুফতি হান্নান, কাশ্মীরী মাজেদ ভাট, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ জিএম ও মাওলানা আব্দুস সালাম ২০০৩ সালে ছিলেন কাশ্মীরভিত্তিক সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন নেতা। আসামি ও পাকি নাগরিক মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট ও তেহরিক-ই-জিহাদিল ইসলামী (টিজেআই) নেতা মুজাফফর শাহ্ মাওলানা তাইজউদ্দিন ও মুফতি হান্নানের সহায়তায় তাদের জঙ্গী কার্যক্রম বাংলাদেশে চালানোর জন্য পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড ও গুলি নিয়ে আসে। এই গ্রেনেডের কিছু অংশ মুফতি হান্নান তার সহযোগীদের মাধ্যমে ভারতে পাঠায় এবং কিছু গ্রেনেড মুফতি হান্নান ও মাওলানা তাইজউদ্দিন তাদের কাছে রেখে দেই এবং ২১ আগস্ট সেই গ্রেনেড দিয়েই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। গ্রেনেড হামলার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় আরও কয়েকটি গ্রেনেড মিললেও আলামত হিসেবে না রেখে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে ধ্বংস করা হয়। ঘটনার তিনদিন পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো স্পর্শকাতর এলাকা থেকেও একটি অবিস্ফোরিত আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। এই তাজা গ্রেনেডটিও সংরক্ষণ না করে ধ্বংস করা হয়। মুফতি হান্নান গ্রেফতার হওয়ার পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানিয়েছে, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলকে দিয়ে ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর আর্জেস গ্রেনেড দিয়েই হামলা চালানো হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে বিপুল নিজেও স্বীকার করেছে যে আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলার জন্য সে মুফতি হান্নানের কাছ থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করে এবং তার নির্দেশনা অনুযায়ী হামলা চালায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় গঠিত তদন্ত হয় কমিটি। তদন্ত কমিটি ওই ঘটনার চার দিনের মাথায় দায়সারা একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। আজও জানা যায়নি কে বা কারা কারাগারের ভেতরে গ্রেনেড ছুড়েছিল। এ ঘটনায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন লালবাগ থানায়। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলার পরদিন ২২ আগস্ট রবিবার সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ ও ৯০ নম্বর সেলের মাঝামাঝি ড্রেনের পাশে একটি আর্জেস ৮৪ মডেলের গ্রেনেড পড়ে থাকতে দেখে পরিচ্ছন্নকর্মী মিন্টু। এরপর তিনি সে কারারক্ষীকে ডেকে আনে। ওই কারারক্ষী গ্রেনেডটি দেখেই উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানান। এরপরই কারাগারের ভেতরে শুরু হয় ছোটাছুটি। খবর পেয়ে ও দিন দুপুরে সেনাবাহিনীর একটি বিস্ফোরক দল গ্রেনেডটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যই সেদিন কারাগার থেকে গ্রেনেড উদ্ধার নাটক সাজানো হয়েছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে গ্রেনেড রাখার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বরখাস্ত করা হয় ডেপুটি জেলার এনামুল কবির, কারারক্ষী আবদুল ওয়াহেদ, কারারক্ষী মাহফুজুর রহমান, দেলোয়ার হোসেন (১), দেলোয়ার হোসেন (২), আবদুল ওহাব, লোবেল মিয়া ও চান মিয়াকে। এছাড়াও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয় রাতে দায়িত্বরত কারারক্ষী নজরুল ইসলাম, গোয়েন্দা কারারক্ষী মোহাম্মদ নজরুল ও জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে। গ্রেনেড উদ্ধারের পরই আত্মগোপনে চলে যান কারারক্ষী সোহেল। কারাগারের ব্যারাকে সোহেলের রুম তল্লাশি করে সে সময় উদ্ধার করা হয়েছিল দুই লাখ টাকা। অনুপস্থিতির কারণে সোহেলকে চাকরিচ্যুত করা হয়। সিআইডি সূত্র জানায়, ওয়ান ইলেভেনের পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পুনঃতদন্ত শুরু হয়। সিআইডি কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশীট দাখিলের পরই কারাগার থেকে গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনা তদন্ত করা হবে। সে সময় সিআইডি গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনার সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য কারা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছিল। কারা কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে সিআইডির কাছে রিপোর্টও দিয়েছিল। সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বর্ধিত তদন্ত শেষ হলেই জেলখানা থেকে উদ্ধার হওয়া গ্রেনেড রহস্য জানা যাবে। এখন তো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার বিচার কাজ শেষ হয়েছে। এবার কি কারাগারের ভেতরের গ্রেনেড রহস্য উদঘাটিত হবে? ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে উদ্ধার হওয়া গ্রেনেড ঘটনার রহস্য দীর্ঘ ১৪ বছরের মধ্যে উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে ঘাতক চক্রের আরও একটি নীলনক্সার ছক প্রকাশ্যে আসবে। সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেছেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরের গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনার মামলা সিআইডি তদন্ত করছে। অতিদ্রুতই গ্রেনেডের রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করেছে, তারাই কারাগারে গ্রেনেডটি রেখেছে বলে প্রাথমিক পর্যায়ে ধারণা করা হচ্ছে। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে কে বা কারা কি উদ্দেশ্যে গ্রেনেড রেখেছিল সে রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তারা মনে করছেন আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে কারাগার উড়িয়ে দেয়াসহ আরও একটি নাশকতার নীলনক্সা ছক কষেছিল, যা আজও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।
×