ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম নওরোজ

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী কবিতায় বিষয়-ভাবনা

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ১২ অক্টোবর ২০১৮

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী কবিতায় বিষয়-ভাবনা

বাংলা ভাষায় এমন অনেক কবি আছেন যাঁরা দু-একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেই কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭) দীর্ঘজীবন পার করলেও তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা হাতেগোনা। তবুও তিনি কবি স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছেন স্বল্পসংখ্যক কবিতার গুণে। কবি আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫) মাত্র তিনখানা কাব্য রচনা করে বাংলা কবিতায় প্রতিষ্ঠিত। এমন কি হেলাল হাফিজ (১৯৪৮) একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) রচনা করেই বাংলা কবিতায় স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছেন। এ রকম উদাহরণ অনেক আছে। কবি তুষার রায়ের (১৯৩৫-১৯৭৭) ‘ব্যান্ডমাস্টার’ (নতুন সংস্করণ ২০০৯)। কবিতা-প্রেমিকদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। এ রকমই কম কবিতা লিখেছেন বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (১৯২৮-২০১৪)। তবে কবি হিসেবে তিনি খুব একটা খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী নিজেই তাঁর ‘কবিতা সংগ্রহে’র (অনন্যা, ঢাকা-২০০১) ভূমিকাতে লিখেছেন-‘আমার কলমে কবিতার ধারা কোনদিন প্রবল ছিল না। মাঝে মাঝে রুদ্ধ হয়েছে, এমনও হয়েছে হয়তো এখানেই শেষ, তবে থেমে যায়নি শেষ পর্যন্ত। যখন নিজের কবিতা লেখার বিরতি এসেছে, তখন অন্যের কবিতা, অন্য ভাষার কবিতার অনুবাদে মন দিয়েছি।’ ফলে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী কবির চেয়ে গবেষক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক হিসেবে বেশি খ্যাতি লাভ করেছেন। জিল্লুর হরমান সিদ্দিকীর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি। এগুলো : ‘হৃদয়ে জনপদে’ (১৯৭৫) ‘চাঁদ ডুবে গেলে’ (১৯৮০), ও ‘আসন্ন বাস্তিল’ (১৯৮৮)। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতায় প্রেম ও বৈচিত্র্যময় পৃথিবী বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। তাঁর কবিতা পাঠের মাধ্যমে দেখা যায়, তাঁর কবিতায়- প্রেম, প্রকৃতি, দেশ, সময়, বিচিত্র পৃথিবীর মায়াসহ অনেক কিছুই বর্তমান। তাঁর প্রথম কাব্য ‘হৃদয়ে জনপদে’র প্রথম কবিতা ‘উৎসর্গ’। এই কবিতাতে তিনি প্রেমিকার সান্নিধ্য কামনা করেছেন। প্রেমিকার চোখের কোণে একটুখানি হাসি, বুকের মধ্যে সুখের ছোঁয়া পেতেই কবির আকুতি। কবিতাটির শেষ স্তবকে কবি শব্দনদীর গভীর জল থেকে কবিতা রচনার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। সবই প্রেমিকার জন্য। অন্য এক কবিতায় (আমার দুঃখকে) তিনি প্রেমিকার সঙ্গে অভিসার করতে চান গোপনে। এবং তাঁর দয়াময়ীও এসেছে গোপনে, কিন্তু কবি শীতল সাহচর্য পেতে চান না। তিনি চান উষ্ণ সাহচর্য। কবি বলছেন : চিরদিন গোপনতা ভালবাসি, সে কথা জেনেই তুমি কি গোপনে এলে দয়াময়ী। কিন্তু বেশিক্ষণ ও শীতল সাহচর্য অসহ্য আমার। একই কবিতায় কবি বাল্যের সহচরীকে মনে করেছেন। তাকে এখনও ভুলে যাননি। শৈশব-স্মৃতিচারণার মাধ্যমে তিনি যৌবনে এসে পৌঁছেছেন। প্রেমিকাকে সম্মান দিয়েছেন। অহেতুক শরীরের প্রয়োজনে ভালবাসেননি। আবার ঘন ঘন অভিসারও চান তিনি । কবির উচ্চারণ : এমন বিরতিহীন অভিসার অসহ্য আমার প্রেম শুধু নারীতেই বন্দী থাকেনি। প্রকৃতিগত প্রেমের কথাও উল্লিখিত হয়েছে অনেক কবিতায়। পারিপার্শ্বিক জীবনে ভয় তাঁর হৃদয়ে ছায়া ফেলে। যেন এক দুর্বিষহ জীবন। জীবনের অতলান্তে বেড়ে ওঠে প্রকৃতি ও প্রেম। কবি নারী থেকে প্রকৃতিতে, প্রকৃতি থেকে নারীতে বার বার আসা-যাওয়া করেছেন। নারীর সামান্য ছোঁয়াতেই কবি খুশি হয়েছেন। সারাদিন আমি আমার বৃত্তে ঘুরি আর তুমি ঘোরো তোমার বৃত্তপথে- কখনো ক্বচিত মাঝে মাঝে ছোঁয়াছুঁয়ি আমরা তৃপ্ত সেইটুকু অল্পতে। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী কবি-জীবনের শুরুতে যে প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন। আজ তা আর মনে পড়ে না। কোথাও হারিয়ে গেছে। অথবা, তাঁর স্মৃতিচারণা শুধুই মিথ্যা। কোন প্রেমকেই কেউ ভুলতে পারে না। মানুষ হিসেবে কবির পক্ষেও ভোলা সম্ভব নয়। কবি বলেন : জানি তোর প্রেমের ফাল্গুনে প্রেমের কবিতা লিখেছিলি, সেই ক্রবাদুর পদাবলী আজ তোর মনেও পড়ে না। এ রকমই কবির প্রেম। জটিল আবার সরল। জটিলতার মধ্যে সরলতা, আর সরলতার মধ্যে জটিল প্রেমানুভূতি। প্রকৃতি কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতার একটা বড় অংশ দখল করে আছে। প্রকৃতির উদ্দেশ্যে প্রকৃতি নয়, কবিতার উদ্দেশ্যেই তিনি প্রকৃতিকে এনেছেন শব্দে, বাক্যে ও ছন্দের মমতায়। কবি প্রথমেই দেশ ও প্রকৃতির বন্দনা করেছেন। বাংলাদেশের আবহমান জীবনাচরণের মধ্যে প্রকৃতির মাধুর্যতা কাব্যিক করে তুলেছেন। প্রকৃতি-চেতনার ভেতরেই তাঁর স্বদেশ প্রেমের উৎস বিদ্যমান। কবি বলেন : এ এক আশ্চর্য দেশ- বাংলাদেশ- অফুরন্ত প্রাণের সবুজে ঝলমল, শিষ দেয়া দোয়েলের দেশ, শালুক শাপলার দেশ শালপাতা নারিকেল সেগুনের শিমুলের দেশ নরম মাটির দেশ, শীতল জলের দেশ দুপুর রৌদ্রের দেশ, সন্ধ্যার ছায়ার দেশ- ... ... ... ... গাজনে যাত্রায় মারফতি মুর্শিদী গানে গ্রামের সোহাগে আর গঞ্জের গুজবে রূপে আর রসে আর প্রেমে আর বঞ্চনায় বাংলাদেশ- ... ... ... ... পদ্মা আর যমুনার যুগল বেণীতে যার শতাব্দীর সম্ভাবনা দোলে। কবিতার এ অংশে শ্যামল বাংলাদেশের চিরায়ত সৌন্দর্যের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে বুনে দিয়েছেন দেশপ্রেমের বীজ। স্বদেশের ঝড়-বন্যা-মারীতে শোকার্ত কবি। বন্যাপ্লাবিত দেশ ও বন্যার্ত মানুষদের কষ্টের কথা স্মরণ করেছেন। জল অমঙ্গল হয়ে আসে, জল মঙ্গলের বার্তা নিয়ে আসে। তবুও আমার দেশ। তার সুখে সুখী, তার দুঃখে দুঃখী। এ রকমভাবেই গড়ে উঠেছে কবিতার শরীর। প্রথমত, বন্যার কারণে- গাঙের কূলে গাঁয়ের বুকে দেয় ছোবল ছোট মাটির কুটির খানি চায় কেবল ঊর্ধ্বফণা সরীসৃপ- বানের জল। এভাবেই গড়িয়েছে স্বদেশের সুখ-দুঃখ আর কবির প্রকৃতি-চেতনা ও দেশপ্রেম। একই কবিতার ভিন্ন ভিন্ন স্তবকের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রেম ও প্রকৃতি। উল্লিখিত কবিতায় বন্যার্তদের কষ্টের কথা বললেও জল যে মঙ্গলও হতে পারে সে কথা উচ্চারণ করতে ভোলেননি কবি। তাঁর ভাষ্য : -এখানে দাঁড়াও এসে, থামো এই জলের কিনারে, বলো প্রার্থনার স্বরে, যারে ধুয়ে নিয়ে যা প্লাবন, ভেসে যাক সমস্ত জঞ্জাল, শোকের শ্রাবণ হোক উৎসবের অজস্র শ্রাবণ। অনেক কবিতায় কবি শৈশবকে মনের ভেতরে ফিরিয়ে এনেছেন। একই সঙ্গে শৈশবের গ্রাম, জন-মানুষ, হাট-বাজার, পোশাক, কৃষিকর্ম সব যেন এক সঙ্গে গাঁথা ফুলের মালা। কবির কাছে যা পুরনো। আসলে তা পুরনো নয়। কারণ কবির দেখা গ্রামের এখনও কোন পরিবর্তন হয়নি। সেই মরা-বলদ আর একটুকরো কাঠের লাঙ্গল বর্তমান। কোন কোন গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছলেও গ্রাম-জীবনের আহামরি কোন পরিবর্তন লক্ষণীয় নয়। ‘পৌরাণিক’ কবিতায় কবি গ্রাম-জীবনের নিখুঁত চিত্র তুলে ধরে বলেন : ...বিশেষত গ্রীষ্মকালে সারাদিন মাঠে খেটে পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম পাড়ায় ছোট ছোট ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িতে ফেরার আগে গাঁয়ের উত্তরে মাঠের ফাঁকায় সেই গম্ভীর কাছারি- গভীর শনের ছাউনি-ঘাসের চত্বর যেখানে বসলে দৃষ্টি মাঠ পার হয়ে দিগন্তের কোলঘেঁষা গ্রামে গিয়ে ঠেকে- এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম দেখার দৃশ্য, তাঁর শৈশব, নবগঙ্গা নদী, তাঁর বংশধররা- কবিকে স্মৃতিমগ্ন করে। দীর্ঘ জীবন নগরে থাকায় বর্তমানের গ্রাম-ছবি কবিতায় সম্পূর্ণতা পায়নি। এ রকম স্মৃতিকাতরতা তাঁর আরো আরো কবিতায় দৃশ্যমান। তিনি শূন্যচারী গ্যাগারিন নন। মাটিতে পা রেখে দেখেছেন পৃথিবীর মুখ। দেখেছেন সভ্যতা, ভেতরে ধারণ করেছেন সভ্যতার শিল্পীদের প্রতি মমতাবোধ। পৃথিবীর ইতিহাস মানে মানুষেরই ইতিহাস। কবির উচ্চারণ : মানুষের হাতে গড়া হাতে ভাঙা পৃথিবী আমার চির বিস্ময়ের পাত্রী। পৃথিবীর ইতিহাস তাই আপাতত আমার দৃষ্টিতে মানুষের ইতিহাস। আপাতত বলে মনে হওয়ার কিছু নেই। সত্যি কথা এটাই যে সভ্যতার ইতিহাস তথা পৃথিবীর ইতিহাস মানুষেরই গড়া। উল্লিখিত কবিতাটি বেশ দীর্ঘ। এই কবিতাটিতে প্রকৃতিবোধ এবং দেশ ও পৃথিবীর কথা চিত্রিত হয়েছে। ‘জনাকীর্ণ সভাগৃহ’ কবিতাটিতে দার্শনিক প্রত্যয়ের সঙ্গে ইতিহাসের নেতাজি সুভাস বসু ও বক্তিয়ার খিলজীর কথা উচ্চারিত হয়েছে। ‘বাংলার শার্দুল’ কবিতায় বঙ্গবন্ধু ও এ কে ফজলুল হকের কথা এসেছে। তবে তা খুবই গতানুগতিকভাবে। যে কারণে কবিতা দুটির বিষয় প্রাণ ছুঁয়ে গেলেও শিল্পসৌন্দর্যের জায়গাটি শূন্য পড়ে থাকে। ‘প্রহরের গান’ কবিতাটি কবি ‘ফররুখ আহমদ’কে উৎসর্গ করেছেন। কবিতাটিতে ফররুখ আহমদের কথা স্মরণে রেখেও তিনি নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা, ক্লান্তির কথা উচ্চারণ করেছেন। কবি কবিতাটির শেষ স্তবকে যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন তা বোধসম্পন্ন সব মানুষকে ব্যথাতুর করে তুলবে। কবি লেখেন : এই গুমটের দিন, দেশে দেশে শীতল যুদ্ধের দিন, খ্রিস্ট ও বুদ্ধের দিন- (নিঃস্ব দেশ হাত পাতে, বিশ্বব্যাংক দেয় যদি ঋণ) অস্থির শান্তির দিন, নিষ্ঠুর ক্রান্তির দিন- এদিনের গান নেই? নেই এই প্রহরের গান? দেশপ্রেমিক কবির এই কষ্টগাথা মিথ্যা নয়। কত দেশ গাছতলা থেকে দশতলায় উঠে গেল, বাংলাদেশ যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। এ কষ্ট একা কবির নন, প্রতিটি বাঙালীর। তবুও দুঃখভারাক্রান্ত মনে কবি স্মরণ করেন জাগরণের কথা, হৃদয়, জনপদ, বায়ান্না, ঊনসত্তর, একাত্তরের কথা এবং বিজয়ী আত্মায় ফুটিয়ে তুলতে চান সুখে ভরা দেশকে। কবির আশাবাদ : আহা যতো ঘাটের মাঠের লোক, ধানের পাটের লোক সুখী হোক ওরা সুখী হোক... ‘হৃদয়ে জনপদে’ কাব্যে কবি যেসব বিষয়কে গ্রহণ করে কবিতা লিখেছেন, তাঁর পরবর্তী কাব্য দুটিও প্রায় কাছাকাছি ভাষ্যই ধারণ করেছে। ‘চাঁদ ডুবে গেলে’ কাব্যটির নাম জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) কবিতার একটি পঙ্ক্তির অংশ। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ। কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতাতেও প্রকৃতি বিদ্যমান, কিন্তু আলোচ্য কবির কবিতাতে জীবনানন্দের মতো কাব্যশক্তি নেই। এই কাব্যের প্রথম কবিতাটির নাম ‘কেন এ বিদেশী চাঁদ’। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকার, আল বদরের উত্থান দেখে কবি ভীত। কবি এদের এদেশের মানুষ বলে মনে করেন না। দেশশক্ররা অন্য কোনো দেশের। তার পরেও তারা এদেশের সংসদ ভবনে যায়। গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ে। কবি হতভম্ব, শূন্য-চিন্তা-ভাবনা, জিজ্ঞাসাহীন। বিচিত্র বিন্যাসে গড়া আমাদের আপন আকাশে আমাদের অরক্ষিত অপ্রাচীর সরল চত্বরে কেন আসে, কেন চাঁদ, কেন এ বিদেশী চাঁদ, যার ঠিকানা জানি না যার উদ্দেশ অজানা। কেন আসে আমার আকাশে ওই আবার বিদেশী চাঁদ, কেন? এ কাব্যে কবি বহির্জগৎ এবং অন্তর্জগতের কথা একটু বিমূর্তভাবে প্রকাশ করেছেন। কবি সমস্ত জঞ্জাল থেকে মুক্ত দেশ ও মানুষকে দেখতে চান। তিনি জানেন বক্তা থাকে না, বক্তব্য থেকে যায়। সেই বক্তব্য কখনও চিরায়ত, কখনও ক্ষণস্থায়ী। ‘বক্তা ও বক্তব্য’ কবিতায় এ রকমই বলা হয়েছে। কিছু কিছু কবিতায় মৃত্যুভয় ‘ভয়’ হিসেবেই উক্ত হয়েছে দার্শনিক প্রত্যয় লাভ করতে পারেনি। কিছু কবিতায় কবি মৃত্যুকে কাছে ডেকেছেন। অন্তর্জগতের কথা বলতে বলতে কবি একই কবিতায় দেশ-জাতি, তার ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে টেনে আনেন, এতে কবিতার বিষয়গত তন্ময়তা নষ্ট হলেও একটা বক্তব্যকে কবি শেষ পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে দেন। মৃত্যুর ‘চিরহরিৎ চত্বরে’ যেতে কবির ইচ্ছা নেয়। তিনি ঘৃণা করেন। কবি পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে মৃত্যুর কথা ভাবতে চেয়েছেন। কখনো মৃত্যু সুন্দরের গাঁথা, কখনও অসুন্দরের ব্যথা। কবি ছেচল্লিশের দাঙ্গা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মরে যেতে পারতেন। কপালগুনে বেঁচে গেছেন। কবির প্রথম কথা- মৃত্যুকে ভীষণ ঘৃণা করি- এই একবিতায় কবি অন্যত্র বলছেন- সে-ই শুধু তীব্র আর গূঢ় আর আকস্মিক সে-ই শুধু দীর্ণ জীর্ণ জীবনের অলঙ্কার সে-ই উচ্চ করতালি যে-সময় যবনিকা নামে সে-ই মৃত্যু ইচ্ছা হয় তাকে ভালোবাসি এই কাব্যে মৃত্যুকে এ রকমভাবে আর কোন কবিতাই ভাবেননি। মূলত, তাঁর অধিকাংশ কবিতায় মানুষ, বাংলাদেশের চিরায়ত জীবন ও ঐতিহ্য উচ্চারিত হয়েছে। ‘সূচনা’ কবিতার প্রথম স্তবকে ‘ঈশ্বরভাবনা’ ইতিবাচক রূপেই প্রকাশ পেয়েছে। এ বিষয়ে তিনি দ্বন্দ্ব-তাড়িত। মীমাংসাহীন। ‘আসবে না কেউ’ একটি দেশ প্রেমের কবিতা। কবি ‘তৃষ্ণা মেটাই আমি বাংলার জলে’ এ রকম আশাবাদী কবিতার পাশাপাশি কিছু আত্মজৈবনিক কবিতাও লিখেছে। কবিতা তো জীবনেরই প্রকাশ। সেহেতু কবিতা আত্মজৈবনিক হবে এটাই সত্য। ‘কিছু এলোমেলো চিন্তা আনন্দ নগরে,’ ‘ইচ্ছা’ প্রভৃতি কবিতা আত্মজৈবনিক। এসব কবিতায় কবি বেঁচে থাকার আনন্দ-বেদনা, নাতি-নাতনিদের সঙ্গ দেয়া, সুন্দরের পরিবর্তে এক অন্ধকার জগতে আবির্ভাবের ভেতরে নিজের যাপিত জীবনকেই প্রকাশ করেছেন। ‘ইচ্ছা’ নামক কবিতায় আবার কবির রাজনৈতিক মতাদর্শ স্পষ্টতা পেয়েছে। প্রধানত, একজন কবির কাব্যবিচারের ক্ষেত্রে কবির রাজনৈতিক ও সামাজিক বোঝাপড়াটা স্পষ্ট করে জানা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে কবি বলেছেন : আমি চাই জনগণতন্ত্রীবাদী প্রতিবাদী সমাজতন্ত্রীর সমূহ স্বপ্নকে,... এখানে স্পষ্ট যে কবি সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে। কবি তাঁর রাজনৈতিক চেতনা স্পষ্ট করেই বাংলাদেশের ভাষা-শহীদ, শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালীবোধকে প্রকাশ করেছেন। কবি জানেন ‘রাজা যায়, রাজা আসে’ কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটে না। সাধারণ মানুষের প্রত্যহ জীবনের কষ্ট মঞ্চের ভাষণে যতই বলা হোক, বাস্তবে তা উল্টো। ভোট দেয়ার কথা, জনগণ ভোট দেয়। নেতা নির্বাচিত হয়। নেতা থাকে ঢাকার বিলাসবহুল আস্তানায়। জনগণের খড়ের ছাউনির কোন পরিবর্তন হয় না। কবি দেশ-মাতৃকার হন্তারকদের উদ্দেশ্যে ঘৃণা ভরে বলেছেন : একি দৃশ্য উপহার দিয়ে গেলে, হে গুপ্ত ঘাতক পলাতক মঞ্চের আড়ালে তুমি গোপন বন্দরে কোন অন্ধকারে দুর্গম জঙ্গলে নির্বাপিত জনপদ থেকে বিষাক্ত বিবর তুমি ভারী কর নিষিদ্ধ প্রশ্বাসে আন্তর্জাতিক বৈরী রাজনীতি, পুঁজিবাদের দাপট, পুঁজিবাদীদের চক্রান্ত, তৃতীয় বিশ্বকে শোষণ করা, আফ্রিকাতে বর্ণবাদ জিইয়ে রাখা- এসবও তাঁর কবিতায় এসেছে। এশিয়ায় আফ্রিকায় অরণ্যের অন্ধকারে শিকারি বাঘের চোখ জ্বলে। ‘আসন্ন বাস্তিল’ কাব্যগ্রন্থটির রাজ্য-পাট আরও একটু বিস্তৃত। আরও একটু দেশের প্রতি অনুগত। জন্মভূমির প্রতি দায়বদ্ধ, মায়াময়। এই কাব্যের প্রথম কবিতাটির শিরোনাম ‘রাত্রির রোমশ বাহু’। কবিতাটিতে প্রতিবেশের বিবমিষা, হৃদয়গত বেদনার অনুভূতি, রাজনৈতিক চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম থেকে পড়তে পড়তে এলে কবির প্রতিকূল সমাজ-জীবনের বর্ণনার মুখোমুখি পড়তে হয়। ‘যদিও মুক্তি সেনারা এসেছিল’ এই একটি বাক্য একাত্তরের যুদ্ধময়, মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা মনে করিয়ে দেয়। উক্ত বাক্যটি লিখিত না হলে প্রতিবেশের অন্ধকার ক্ষতের কথাই প্রাধান্য পেত। মূলত, পূর্ববর্তী কাব্য দুটি থেকে এ কাব্যের বিষয়গত দূরত্ব খুব বেশি নেই। ‘ভাঙে না বাঙালি’ কবিতায় বাঙালীর একাত্মতা প্রকাশ পেয়েছে। ‘কোন ঠিকানায়’ কবিতাটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া অধিকাংশ কবিতায় প্রতিবেশের অন্ধকারতাড়িত সময়, স্মৃতিকাতরতা, দুঃসময়, দুশ্চিন্তা এসবই প্রাধান্য পেয়েছে। ‘নানুরে পাইনি তাকে’ কবিতাটির বিষয় যে কোন পাঠককে জীবনের পাঠ নিতে কৌতূহলী করে তুলবে। তবে কবিতাটির শেষ দুই পঙ্ক্তির বিষয় ভাবনা অগত্য মানা যায় না। ...প্রেম, বোঝা গেল, সত্যই বিরল। এবং এ পৃথিবীতে অতি অল্প ঠাঁই কবিতার। প্রেম মানুষে-মানুষে বিরল। একটি ডালের সঙ্গে পাখির, মায়ের সঙ্গে শিশুর, নদীর সঙ্গে নৌকা, নারীর শরীরের সঙ্গে শইড়, ক্ষেতের সঙ্গে ফসলের- এসবে প্রেমের বিরলতা নেই। মানুষ প্রতিদিন হন্তারক হয়ে উঠছে, এক্ষেত্রে বলা যায় প্রেম সত্যিই বিরল। পৃথিবীতে কবিতার ঠাঁই অল্প নয়। পৃথিবীতে কবিতার জায়গা অতি অল্প- এ রকম ভাবা অন্তত কবি ও কবিতাপ্রেমিক কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে মানায় না। তাঁর কিছু কবিতায় শহুরে সকাল, নগ্ন সভ্যতার প্রতি ঘৃণা, নিসর্গ প্রিয়তা প্রকাশ পেয়েছে। ‘আসন্ন বাস্তিল’ কবিতায় বাস্তিল দুর্গ ভেঙে পৃথিবীর সব বন্দী নিজেদের মুক্ত করে নিয়েছে- এ রকম শুভ সংবাদের পাশে কবি একটি শান্ত, সৌম পৃথিবীর আকাক্সক্ষা করেছেন। এই একটি বিষয় জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর অধিকাংশ কবিতায় এসেছে। ‘ভগ্নভাস্কর্য’ কবিতার শেষাংশে ‘কুড়াল’ শব্দটি সভ্যতাকে ধ্বংস করার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে ‘এই সভ্যতা মানুষের গড়া’ বলে মানুষের স্থান সবার ওপরে রেখেও কবি হতাশ। আবার আশাবাদীও। কবি বলেন : ...আমি এই সদ্য বিগত বৈশাখী পূর্ণিমায়, আমার এ দুঃস্বপ্নকে এই বৈশাখী আগুনে আজ পুড়িয়ে দিলাম। হতাশার মূল কারণ সভ্যতা মানুষের গড়া, আবার তারাই সভ্যতাকে ধ্বংস করছে। উল্লিখিত কবিতাংশে কবি ধ্বংস, হতাশাকে পিছে ফেলে আশাবাদের কথা ব্যক্ত করতে ইচ্ছুক। ‘ফাল্গুন-চৈত্রের কবিতা’ একটি দীর্ঘ কবিতা। কিন্তু এর বিষয়াদি দীর্ঘ নয়। এই কবিতায় শহীদ জোহা, তাঁর ঋণ কখনই শোধ করা যাবে না; এ রকম বলে কবি হঠাৎ করেই গ্রাম্য মহাজন, শৈশবের স্মৃতিমুগ্ধতা, প্রকৃতির কাছে ফেরার আকাক্সক্ষা, অতীতের বাংলাদেশ, বর্তমানের বাংলাদেশকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ কবিতার কলা-কৈাশলকে ধারণ করতে পারেননি। পারা আর না-পারাকে ছাপিয়ে আমরা এক নজরে দেখে নিলাম তাঁর কাব্যের বিষয়বৈভব। বিষয়-ভাবনার মধ্যে কিছু দুর্বলতাও লক্ষ্য করা যায়। তাঁর কবিতায় ত্রিশ দশকের ও তাঁর কালের কবিদের প্রভাবও লক্ষ্য করা গেছে। ‘জলমগ্ন বাংলাদেশ’ কবিতাটির চতুর্থ স্তবক কবি অয়িম চক্রবর্তীর ‘বাংলাদেশ’ কবিতার প্রভাব সুস্পষ্ট। ‘প্রহরের গান’ কবিতার চতুর্থ স্তবকে কবি শামসুর রাহমানের বর্ণনাভঙ্গি ও নিত্য ব্যবহার্য শব্দাবলীর প্রভাব লক্ষণীয়। ‘ফাল্গুন-চৈত্রের কবিতাটি কবি সৈয়দ শামসুল হকের ‘চৈত্রে রচিত পঙ্ক্তিমাল’ কাব্যের নাম স্মরণ করিয়ে দেয়। শুধু শিরোনামেই নয়, বিষয়েরও মিল চোখে পড়ে। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী মূলত কবি। তাঁর কবিতা ধোঁকা দেয় না, আশান্বিত করে তোলে। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী অগাধ পা-িত্যের মালিক ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কবিতায় হবে না। যে কারণে তিনি প্রবন্ধ, গবেষণা ও অনুবাদ সাহিত্যে নিজেকে ব্যয় করেছেন বেশি এবং এক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছেন। কবি হিসেবেও তার গুরুত্ব ছোট করে দেখার নয়।
×