ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তিতে নোবেল পেলেন নাদিয়া মুরাদ

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ১২ অক্টোবর ২০১৮

শান্তিতে নোবেল পেলেন নাদিয়া মুরাদ

কঙ্গোর চিকিৎসক ডেনিস মুকওয়েজির সঙ্গে ২০১৮তে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পেলেন কুর্দি মানবাধিকার কর্মী নাদিয়া মুরাদ। যুদ্ধকালীন ও সশস্ত্র সংগ্রামের সময় যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে অবদান রাখার জন্য তাদের এই পুরষ্কার দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে নোবেল কমিটি। নাদিয়া মুরাদ বাসে তাহা, জন্ম ১৯৯৩, ইরাকের কোজো গ্রামে; ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের এক কৃষক পরিবারে। তার বয়স যখন ১৯ দক্ষিণ ইরাকের কোজো শহরে বসবাসকারী ইয়াজিদিদের ঘেরাও করে আইএস জঙ্গীরা। সেদিন নাদিয়ার ছয় ভাই সহ হত্যা করা হয় ছয়শত ইয়াজিদিকে। যৌনদাসী হিসেবে অপহরণ করা হয় গ্রামের নারীদের। সে বছর আইএস কর্তৃক অপহৃত ৬ হাজার ৭ শত নারীর একজনে পরিনত হন নাদিয়া। তার ভাষায় তাকে দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, পালানোর চেষ্টা করলেই খেতে হত বেদম পিটুনি, দেওয়া হতো সিগারেটের ছ্যাঁকা। করা হত উপুর্যপরি ধর্ষণ। বার বার চেষ্টার পর এক সময় পালাতে সক্ষম হন নাদিয়া। প্রতিবেশী এক পরিবারের সহযোগিতায় আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকা পেরিয়ে ঠাঁই পান উত্তর ইরাকের ডুহক রিফিউজি ক্যাম্পে। রাওঙ্গা ক্যাম্পে একটি কনটেইনারে বাসকালীন ২০১৫তে তার জীবনকাহিনী প্রকাশিত হয় বেলজিয়াম দৈনিক লা লিব্রে বেলজিকিউ-তে। এরপর ১ হাজার নারী শিশুর সঙ্গে রিফিউজি প্রোগ্রামের আওতায় ঠাঁই জোটে বাদেন-গুতেনবার্গ, জার্মানিতে। ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলে মানব পাচারের মানবিক সংকটের দিকটি বর্ণনা করেন। নিরাপত্তা পরিষদে মানব পাচার সংক্রান্ত সমস্যাটি তিনিই প্রথম তুলে ধরেন। এ ভাবেই তিনি পরিনত হন তাদের মুখপাত্রে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানব পাচার ও রিফিউজি সমস্যার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে সচেষ্ট হন। তিনি যেমন শরনার্থীদের কাছে পৌঁছেছেন, তেমনি শুনেছেন গণহত্যা, বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিতা নারী পুরুষের কথা। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের সমস্যা সংকটের কথা তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে। ২০১৬ এর সেপ্টেম্বরে এ্যার্টনি আমাল ক্লুনি ইউনাইটেড নেশন্স অফিস অন ড্রাগস্ এন্ড ক্রাইম এর সামনে নাদিয়া মুরাদকে আইএস কমান্ডারদের অপরাপধের বিরুদ্ধে ক্লায়েন্ট হিসেবে গণ্য করার আহ্বান জানান। ক্লুনি গণহত্যা, ধর্ষণ, মানব পাচার বিষয়টিকে আই এস রীতিমত বিশাল বাণিজ্যে রূপ দিয়েছেন বলে জানান। নিজের কর্মকা-ের জন্য ব্যাপক হুমকির মোকাবেলা করতে হয়েছে নাদিয়াকে। সেপ্টেম্বর ২০১৬ গুডউইল অ্যাম্বাসেডর ফর হিউম্যান ট্রাফিকিং অব দ্যা ইউনাইটেড ন্যাশন নির্বাচিত হন। ৩মে ২০১৭ সালে ভ্যাটিকান সিটিতে সাক্ষাত করেন পোপের সঙ্গে। সেই সাক্ষাতে আই এস অধিকৃত অঞ্চলে নিগৃহীত ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষকে সাহায্যের আবেদন জানান। দাবী করেন ইরাকের সংখ্যালঘুদের জন্য একটি সায়ত্বশাসিত অঞ্চল গঠনের। কথা বলেন ইরাক এবং সিরিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংকট নিয়ে। তেমনি তুলে ধরেন অভ্যন্তরীণ বাস্তচ্যুত ও দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের কথা। তার প্রকাশিত বই ‘দ্য লাস্ট গার্ল : মাই স্টোরি অব ক্যাপটিভিটি, এন্ড মাই ফাইট এগেইনস্ট দ্য ইসলামিক স্টেট’ ক্রাউন পাবলিকেশনের ব্যানারে প্রকাশিত হয় ৭ নভেম্বর ২০১৭। প্রকাশনার সাথে সাথেই আলোড়ন তোলে সারা বিশ্বে। সহিংসতার বিভৎস বিবরণে হতবাক হয়ে পড়েন প্রতিটি বিবেকবান মানুষ। নাদিয়ার ভাষায় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এ নির্মমতার গল্প তুলে ধরেছেন এমন নয়। বরং কাউকে না কাউকে সে কথা বলতেই হত। আমি কেবল সে দায়িত্বটুকু পালন করেছি। তবে কেবলমাত্র একজন নির্যাতিত নারীর পরিচয়ে কখনই বাঁচতে চাননি নাদিয়া মুরাদ। জীবনের কাছে হেরে যেতে রাজি ছিলেন না কখনই। যে পথ তিনি পাড়ি দিয়ে এসেছেন সে পথে ভেঙে পড়ত অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু নাদিয়া ভেঙে পরেননি। শুধু নিজের কথা ভাবেননি। ভেবেছেন তার মত নির্যাতিত, নিপীড়িত আর সকলের কথা। তাদের জন্য কাজ করেছেন। ক্রমেই হয়ে উঠেছেন মানবতাবিরোধী সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় যোদ্ধা। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে তাকে এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করল নোবেল শান্তি কমিটি। এর আগে ২০১৬ সালে নাদিয়া মুরাদ ও লামিয়া আজি বাশার যৌথভাবে পেয়েছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ মানবাধিকার বিষয়ক পুরস্কারÑ শাখারভ পুরস্কার। লামিয়া মুরাদের গল্প আমাদের এই বার্তাই দিয়ে যায় যে সাহস এবং ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করলে যে কোন বিরূপ পরিস্থিতি কাটিয়ে, নিজের জীবনের পথ তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। সারা বিশ্বে সাহস আর সংগ্রামী নারীর এক নাম নাদিয়া মুরাদ।
×